দীর্ঘকাল বাঁচার আকাঙ্ক্ষা মানুষের দীর্ঘদিনের। যুদ্ধ, নানা রকম মহামারী, অজানা অসুখের কারণে মানুষের গড় আয়ু কয়েক শতাব্দী আগেও খুব বেশি ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর আগেও মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৪ বছর। অথচ গত একশ বছরে বিজ্ঞান আর চিকিৎসার উন্নতির ফলে মানুষের আয়ু বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু এরপরেও মানুষ প্রকৃতির সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণী না। রহস্যময় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে হাজারো রকমের প্রাণী, যাদের অনেকের যখন জন্ম হয়েছে তখনো পৃথিবীতে দাসপ্রথা বহাল ছিল কিংবা আমেরিকা নামে কোন দেশই ছিল না! মানুষের মত নেই তাদের বুদ্ধিমত্তা, নেই প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করার কোনো আধুনিক অস্ত্র। কিন্তু প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে থেকেই তারা বেঁচে রয়েছে বছরের পর বছর। চলুন জানা যাক সবচেয়ে দীর্ঘজীবী কিছু প্রাণীর সম্পর্কে।
সামুদ্রিক কুয়াহগ
মলাস্কা পর্বের প্রাণী এটি, নাম থেকেই বোঝা যায় এর বাস সমুদ্রে। এটি মূলত এক ধরণের ঝিনুক। ২০০৬ সালে আইসল্যান্ডে একদল বিজ্ঞানী ৫০৭ বছর বয়স্ক একটি কুয়াহগ খুঁজে পান। এ ধরণের প্রাণীদের বয়স নির্ধারণের জন্য তাদের খোলসের উপর তৈরি রিং গণনা করা হয়। বিজ্ঞানীরা প্রথমে এর বয়স ৪০০ বছর ধারণা করলেও পরে ভালো করে পরীক্ষায় দেখা গেছে এর বয়স ৫০৭ বছর। বিজ্ঞানীদের হাতে ধরা পড়ার পর এর মৃত্যু ঘটে, ফলে এটি সহজেই বলা যায় যে মানুষের হাতে না পড়লে আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকত এই প্রাণীটি।
Arctica islandica সামুদ্রিক কুয়াহগের বৈজ্ঞানিক নাম। ২০০৬ সালে এর বয়স ৫০৭ বছর, এর মানে হচ্ছে প্রাণীটির জন্ম ১৪৯৯ সালে! এর যখন জন্ম তার মাত্র কয়েক বছর আগে কলম্বাস আমেরিকা পৌঁছেছেন, ভারতবর্ষে মোঘলরা তখনো আসেইনি! মারা যাবার পর আইসল্যান্ডে পাওয়া প্রাণীটির নাম রাখা হয় ‘মিং’। ১৪৯৯ সালে চীনে মিং সাম্রাজ্যের সূচনা হয়, তার সাথে মিল রেখেই এ নামকরণ করা হয়। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বিজ্ঞানীরা খুঁজে না পেলেও ধারণা করা হয় শরীরে শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট তৈরি করার ফলে এদের বার্ধক্যজনিক কোনো সমস্যা হয় না, ফলে বেঁচে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
গ্রীনল্যান্ড হাঙ্গর
উত্তর আটলান্টিকে বাস করা গ্রীনল্যান্ড হাঙরদের উপর ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের এক গবেষণায় ২৮টি হাঙ্গরের বয়স নির্ধারণ করা হয় কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে। এ সময় ৪০০ বছর বয়স্ক একটি মেয়ে হাঙ্গরের খোঁজ পান বিজ্ঞানীরা। গ্রীনল্যান্ড হাঙর সাধারণত ১৫০ বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয়। সে হিসেবে এই হাঙরটি তার যৌবন কাটিয়েছে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, পার করেছে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, দুটি বিশ্বযুদ্ধ, এমনকি বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধও।
মজার ব্যাপার হলো কার্বন ডেটিংয়ে একদম নিখুঁত বয়স বের করা যায় না, সে হিসেবে হাঙরটির বয়স ২৭২ বছর হতে পারে আবার ৫১২ বছরও হতে পারে! তবে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ করে এর বয়স ৪০০ বা এর আশেপাশে বলেই মনে করেন। কার্বন ডেটিং থেকে বয়স নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়, এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল বায়েসিয়ান পরিসংখ্যান। তবে যেটাই হোক, এই হাঙরটি সবচেয়ে বেশি বয়সী মেরুদন্ডী প্রাণী ছিল সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রীনল্যান্ড হাঙরের বৈজ্ঞানিক নাম Somniosus microcephalus.
জায়ান্ট কচ্ছপ
প্রথম দুটো প্রাণী ছিল পানির, এবার একটু ডাঙার দিকে চোখ ফেরানো যাক। ডাঙায় বাস করা সবচেয়ে বেশি বয়সী জীবিত প্রাণী একটি জায়ান্ট কচ্ছপ, যার নামকরণ করা হয়েছে জোনাথন। দক্ষিণ আটলান্টিকের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে গভর্নরের বাসভবনে এর বাস।
১৮৩ বছর বয়সী এ কচ্ছপটির জন্ম উনবিংশ শতাব্দীতে। ঠিক কীভাবে ব্রিটিশদের অধীনস্থ সেন্ট হেলেনায় এর আগমন এ ব্যাপারে কেউই সঠিক কিছু বলতে পারে না। তবে এ পর্যন্ত ৩৩ জন গভর্নর সেন্ট হেলেনায় এসেছেন, সবাই তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন জোনাথন যেন তাদের দায়িত্বকালে মারা না যায়। Geochelone nigra বৈজ্ঞানিক নামের এ ধরণের কচ্ছপ সাধারণত ২৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে, সে হিসেবে জোনাথনের হাতে এখনো অনেক সময় বাকি রয়েছে। তবে দ্বীপবাসী ঠিক করে রেখেছে জোনাথন মারা গেলে তার খোলসটি প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেয়া হবে, সেই সাথে তৈরি করা হবে জোনাথনের একটি ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু।
সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণীদের তালিকায় থাকবে আরো একটি জায়ান্ট কচ্ছপ, যার নাম ‘অদ্বিতীয়’। এ নামটি বাংলা হবার কারণ ২০০৬ সালে মারা যাবার আগ পর্যন্ত এর বাস ছিল কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায়। ১৮৭৫ বা ১৮৭৬ সালে আলিপুর চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠার সময় অদ্বিতীয়কে রাখা হয় চিড়িয়াখানায়। গুজব প্রচলিত আছে এই কচ্ছপটি একসময় রবার্ট ক্লাইভের পোষা কচ্ছপ ছিল। কিন্তু এ তথ্যের কোনো ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া না যাওয়ায় এর সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়।
অদ্বিতীয়ের বয়স নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। অনেকে বলে থাকেন এর বয়স ১৫০ বছরের মতো, আবার অনেকে বলে থাকে এর বয়স ২৫০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট উপসংহারে এখনো পৌঁছতে পারেননি। তবে যদি ২৫০ বছরের দাবি ঠিক হয়, তবে অদ্বিতীয় সবচেয়ে দীর্ঘজীবী কচ্ছপ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
বোহেড তিমি
আবারো ফেরা যাক সমুদ্রে, এবারে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী স্তন্যপায়ী প্রাণী। আগেরগুলোর মতো কোনো নির্দিষ্ট তিমি পাওয়া না গেলেও এ ধরণের তিমিরা ২০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। উত্তর আটলান্টিক, উত্তর প্রশান্ত এবং আর্কটিক মহাসগারের ঠান্ডা পানিতে এদের বাস।
Balaena mysticetus বৈজ্ঞানিক নামের পূর্ণবয়স্ক বোহেড তিমি লম্বায় ৫০ থেকে ৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদের জেনেটিক সিকোয়েন্সে বিশেষ কিছু জিন আছে যা তাদের ডিএনএ সারিয়ে তুলতে পারে। তবে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের আগে ব্যাপক হারে শিকারের ফলে বোহেড তিমির সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিকভাবে আইন করে বোহেড তিমি রক্ষা শুরু হয় এবং এরপর থেকে এদের সংখ্যা আবার বাড়া শুরু হয়েছে।
রওঘেয়ে রকফিশ
রকফিশ সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা অন্যতম একটি প্রাণী। সবচেয়ে বেশি বয়স্ক রকফিশ ছিল ২০৫ বছর বয়স্ক। পূর্ণবয়স্ক রকফিশ প্রায় আড়াই ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে এদের পাওয়া যায়। সমুদ্রের দেড়শ থেকে সাড়ে চারশ মিটার গভীরতা পর্যন্ত এরা যেতে পারে।
রেড সি আরচিন (Urchin)
এবারো সামুদ্রিক প্রাণী, আলাস্কা থেকে শুরু করে মেক্সিকোর ঊপকূল পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরে এদের পাওয়া যায়। দেখতে কাঁটাযুক্ত গাছের মতো হলেও এটি আসলে একটি প্রাণী। Echinodermata পর্বের এ প্রাণী ২০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
নাম রেড হলেও এটি গোলাপী, কমলা বা বেগুনি রঙেরও হয়ে থাকে। কম গভীর পানির যেখানে স্রোতের তীব্রতা কম সেখানকার পাথুরে এলাকায় এদের পাওয়া যায়। এদের পুরো শরীর তীক্ষ্ম কাঁটা দিয়ে মোড়ানো থাকে, এই কাঁটাগুলো ‘টেস্ট’ নামক একটি শক্ত খোলকের উপরে হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি বয়সী আরচিনটি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সমুদ্র উপকূলে পাওয়া গিয়েছিল।
এসবের বাইরেও আরো অসংখ্য প্রাণী রয়েছে যারা তাদের প্রজাতির অন্যদের থেকে অনেক বেশিদিন বেঁচেছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলোর নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র না থাকায় তালিকায় যোগ করা হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন এককোষী প্রাণীদের যদি হিসেবে ধরা হয়, তাহলে দশ হাজার বছর পুরনো প্রাণীও পাওয়া যায়। তবে এককোষী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্যদের ক্ষেত্রে মারা যাওয়া ব্যাপারটা বহুকোষীদের মতো না। তাই তাদেরও তালিকায় যোগ করা হয়নি।
ফিচার ইমেজ- toptenz.net