অর্কিড এর সৌন্দর্য, নাটকীয় আকৃতি, এবং রং দিয়ে বছরের পর বছর ধরে উদ্ভিদপ্রেমীদের মুগ্ধ করেছে। এই চমৎকার ফুলগুলো প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর আগে প্রথম দেখা গিয়েছিল, এবং তারপর বিষুব রেখা থেকে আর্কটিক সার্কেল ও হিমালয় থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। গবেষকরা জুরাসিক যুগ থেকে মেসোজোয়িক যুগ (১৯৫-১৩৬ মিলিয়ন বছর আগে) এবং সেনোজোয়িক যুগেও (৬৪ মিলিয়ন বছর আগে) অর্কিডের অস্তিত্ব খুঁজে পান। বিশ্বব্যাপী ২৫,০০০-এরও বেশি প্রজাতিসহ অর্কিড উদ্ভিদ রাজ্যের বৃহত্তম পরিবারগুলোর মধ্যে একটি। আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও চাষাবাদের সুবাদে অর্কিডের ১,০০,০০০ ভিন্ন জাত উদ্ভাবিত হয়েছে, এবং এর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
অর্কিডের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ‘ইনকোয়ারি ইন্টু প্লান্টস’ নামক গ্রন্থে, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালের দিকে যেটি লেখা হয়েছিল অ্যারিস্টটলের ছাত্র থিওফ্রাস্টাস দ্বারা। ডিওসকোরিডস নামক একজন গ্রীক উদ্ভিদবিদ এবং চিকিত্সক প্রথম শতাব্দীতে এই গাছগুলোকে স্পষ্টভাবে ‘অর্কিড’ হিসাবে চিহ্নিত করেন, এবং তার রচিত ডি মেটেরিয়া মেডিকা মধ্যযুগ পর্যন্ত একটি আদর্শ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কনফুসিয়াস তার ঘরে অর্কিড রাখতেন, এবং তিনি অর্কিডের সুগন্ধির প্রশংসা করে একটি কবিতাও লিখেছিলেন।
ইংরেজিতে Orchidaceae নামে পরিচিত এই গাছদের ২,০০০ বছর আগে গ্রীক দেশে Orchis নামে ডাকা হতো। অর্চিস (Orchis) বলতে মূলত অর্চিস মোরিওকে (Orchis Morio) বোঝায়, যা এখনও সেই অঞ্চলে রয়েছে। নামটির অর্থ ‘অণ্ডকোষ’, যার আসল কারণ মূলের দিকে তাকালে বোঝা যায়। রোমান আমলে (৪৭৬ খ্রি.) অর্কিড শিকড় একটি কামোদ্দীপক হিসেবে খাওয়া হতো। উনিশ শতকে এবং শিল্পযুগের আগমনের ফলে অর্কিডকে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সভ্যতায় প্রতিস্থাপন করা সহজ হয়ে ওঠে। গ্লাস উৎপাদনের অগ্রগতি গ্রিনহাউজ নির্মাণের সুবিধা দিয়েছে এবং এটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে অর্কিডের উৎপাদনকে সহজ করে তোলে, যেখানে ধনী, সংস্কৃতিমনা সমাজের মানুষ বিরল এবং সুন্দর অর্কিডের নমুনা সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
অর্কিড গৃহস্থালির গাছ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। এদের সুদৃশ্য ফুল, রঙের বিশাল পরিসর কয়েক মাস ধরে চলতে পারে। কিছু অর্কিডের সুন্দর ঘ্রাণও আছে। সঠিকভাবে যত্ন নিলে এরা অনেক বছর বাঁচতে পারে। অর্কিড পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়; গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকা থেকে আন্দিজ পর্যন্ত এদের বিচরণ। এই কারণে বিভিন্ন অর্কিডের যত্নের প্রয়োজনীয়তাগুলো আলাদা। তাই সর্বদা নির্দিষ্ট অর্কিডের জন্য নির্দিষ্ট লেবেল এবং যত্নের নির্দেশাবলী অনুসরণ করা উচিত।
অর্কিডের বৈচিত্র
মথ অর্কিড (ফ্যালেনোপ্সিস/Phalaenopsis)
মথ অর্কিড বা ফ্যালেনোপসিস, বাগানের কেন্দ্রে কিংবা সুপারমার্কেটগুলোতে পাওয়া যায়। এদের বিস্তৃত পরিসরের রঙ রয়েছে, এবং সহজেই বৃদ্ধি ঘটে। কম্পোস্ট কিংবা মাটির পরিবর্তে এদের একটি বিশেষ ছালের মধ্যে বেড়ে তুলতে হয়, যেখানে উজ্জ্বল, ফিল্টার করা আলো আছে। এরা আর্দ্রতা পছন্দ করে, তাই ভাল ফলনের জন্য এদের হালকা, আর্দ্র রান্নাঘর বা বাথরুমের কাছাকাছি বেড়ে তোলা হয়।
ডেনড্রোবিয়াম (Dendrobium)
ডেনড্রোবিয়ামের জন্য মথ অর্কিডের তুলনায় শীতল এবং কম আর্দ্র পরিবেশের প্রয়োজন। শরত্কালে পানি কমিয়ে দিয়ে গাছগুলোকে একটি উজ্জ্বল জানালা বা বারান্দায় নিয়ে রাখতে হয়, যেখানে তারা বসন্ত পর্যন্ত শীতল ও শুষ্ক থাকতে পারে। তারপর যখন তাপমাত্রা আবার বাড়তে শুরু করে, তখন পানি দেওয়া বাড়াতে হয়, এবং বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসা উচিত।
সিম্বিডিয়াম (Cymbidiums)
সিম্বিডিয়াম অর্কিড সহজে বেড়ে ওঠে। শীতের শেষ থেকে বসন্তের শুরু পর্যন্ত বিভিন্ন রঙে তাদের সুন্দর ফুল ফোটে।
ক্যাটলিয়া (Cattleya)
ক্যাটলিয়া এর উজ্জ্বল ফুলের জন্য পরিচিত, যা ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে, এবং শরত বা বসন্তে মূলত এদের আগমন ঘটে। এরা একটি বা দুটি ফ্লেশি পাতা দিয়ে সিউডোবাল্ব তৈরি করে। গাছগুলো প্রায় ১৮-২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা পছন্দ করে, এবং রাতে তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে নামলে তা গাছের বৃদ্ধি ব্যহত করতে পারে।
অ্যাসকোসেন্ডা (Ascocenda)
অ্যাসকোসেন্ডা মূলত ভান্ডা অর্কিড এবং অ্যাসকোসেন্ট্রামের মধ্যে ক্রসের ফলাফল। এদের উজ্জ্বল রঙের ফুল বছরে তিনবার দেখা যায়। তারা শীতকালে উষ্ণতা, এবং প্রচুর আর্দ্রতা পছন্দ করে।
ভান্ডা (Vanda)
সাধারণত বসন্ত এবং শরতের মধ্যে ভান্ডা বড় ও সুন্দর ফুল উৎপন্ন করে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু থেকে আসায় এরা উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতা পছন্দ করে। এগুলো প্রায়শই স্ল্যাটেড ঝুড়িতে বা কাচের ফুলদানিতে জন্মানো হয়, যার মধ্যে সামান্য বা কোনো পটিং মিডিয়াম থাকে না। অন্যান্য অর্কিডের মতো না হয়ে ভান্ডা রৌদ্রোজ্জ্বল জায়গা পছন্দ করে।
সাইপ্রিপেডিয়াম (Cypripedium)
এরা লেডিস স্লিপার নামেও পরিচিত। সাইপ্রিপেডিয়ামে একটি বিশাল ফুলের থলি (আসলে মিশ্রিত ফুলের পাপড়ি) এবং প্রায়শই মোচড়ানো সেপাল থাকে। এগুলো কম্পোস্টে জন্মানো সম্ভব। ফুলের মৌসুমে তাদের প্রচুর পরিমাণে পানি দিতে হয়। অনেক প্রজাতি শক্ত প্রকৃতির, এবং বাড়ির বাইরেও জন্মানো যায়।
অডোন্টোগ্লোসাম (Odontoglossum)
ফুলের জটিল শিরা এবং দাগ থাকার কারণে অডোন্টোগ্লোসামকে প্রায়শই ‘প্রজাপতি’ অর্কিড বলা হয়। বেশিরভাগ অর্কিডের বিপরীতে তারা কম আলো পছন্দ করে, যেমন- একটি উত্তরমুখী উইন্ডোসিল। আন্দিজ থেকে আগত এই ফুলগুলো শীতল, তাজা, বাতাসযুক্ত অবস্থা পছন্দ করে।
ক্যাম্ব্রিয়া (Cambria)
ক্যাম্ব্রিয়া অর্কিডগুলোকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয় Vuylstekeara, Odontoglossum, Miltonia এবং Cochlioda অর্কিডের একটি সংকর। এগুলো সুপারমার্কেটগুলোতে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। তারা অডোন্টোগ্লোসামের অনুরূপ অবস্থা পছন্দ করে, তবে বিস্তৃত তাপমাত্রার পরিসর সহ্য করতে পারে না।
অনসিডিয়াম (Oncidium)
অনসিডিয়াম অর্কিড কখনও কখনও ‘নৃত্যরত নারী’ হিসেবে পরিচিত, এবং এরা সাধারণত শরত্কালে ফোটে। দোকানে যে হাইব্রিডগুলো পাওয়া যায় সেগুলো বড় করা সবচেয়ে সহজ। এরা শীতল তাপমাত্রা পছন্দ করে, এবং গ্রীষ্ম ছাড়া অন্য সময়ে ভাল ফলন দিয়ে থাকে।
মিল্টোনিয়া (Miltonia)
মিল্টোনিয়া বা প্যানসি অর্কিডগুলো প্রায়শই বিক্রির জন্য পাওয়া যায়, এবং এরা আসলে মিল্টোনিওপিসিস হাইব্রিড। এই কমপ্যাক্ট গাছগুলোতে প্যানসির মতো একটি স্বতন্ত্র ‘মাস্ক’ বা ‘মুখ’সহ বড় ফুল থাকে। এরা শীতল তাপমাত্রা পছন্দ করে। তবে তাপমাত্রার ওঠা-নামা সহ্য করতে পারে।
প্যাফিওপেডিলাম (Paphiopedilum)
প্যাফিওপেডিলাম স্লিপার অর্কিড নামে পরিচিত। এদের ফুলের থলি-আকৃতির ঠোঁট থাকে যা বন্য পরাগায়নকারীদের আকর্ষণ করতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফুল ফোটে। এরা আর্দ্রতা এবং মাঝারি তাপমাত্রা পছন্দ করে, যা সাধারণত ১০-২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। শীতকালে শীতল, উজ্জ্বল জায়গায় এরা ভাল জন্মায়।
অন্যান্য গাছপালা এবং প্রাণীদের থেকে ভিন্ন, অর্কিড প্রজাতির মধ্যে এবং সম্পর্কিত প্রজাতির মধ্যেও হাইব্রিড তৈরি করতে পারে। এটি বিস্ময়কর সংখ্যক হাইব্রিড তৈরি করার জন্য সহায়ক, এবং এটি বেশিরভাগ অর্কিডকে দেওয়া অত্যন্ত জটিল নামগুলোর কারণ। বেশিরভাগ অর্কিডে বছরে একবার ফুল ফোটে। তবে তারা যদি উপযুক্ত পরিবেশ পায়, তাহলে আরও বেশি ফুল ফুটতে পারে। একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে ফুল ফোটে, এমন একটি অর্কিড পেতে হলে সেই সময়ে প্রস্ফুটিত একটি উদ্ভিদ কেনা উচিত। যখন একটি অর্কিডে ফুল ফোটে, তখন এটি সাধারণত ছয়-দশ সপ্তাহ পর্যন্ত ফুলে থাকে। অর্কিড রিপটিং অপছন্দ করে, এবং সাধারণত তারা বাধাগ্রস্ত হলে পরে কমপক্ষে এক বছর ফুল ফোটে না। যদি সম্ভব হয়, খালি শিকড়ের পরিবর্তে পাত্রে অর্কিড কেনা উচিত।