বিশ্বস্ততা ও প্রভুভক্তির জন্য কুকুর ইতিহাসে বিখ্যাত। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে এক ধরনের নেকড়ে প্রজাতি থেকে আজকের কুকুরের আগমন। মানুষ তার দৈনন্দিন নানা কাজে কুকুরকে কাজে লাগায়। মনিবের জন্য প্রভুভক্ত কুকুর ‘হাসিমুখে’ তার জীবন পর্যন্ত দিয়েছে এমন গল্প আমরা বহু পড়েছি। মনিবের মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল হয়ে অশ্রুসজল চোখে নিজেও মারা গেছে, এরকম উদাহরণও তো আছে অসংখ্য। হারিয়ে গিয়েও ঘরে ফেরা কুকুরের গল্প আজও আমাদের অবাক করে, বিমোহিত করে তাদের অসামান্য প্রভুভক্তির কারণে।
এরকমই চার বিখ্যাত কুকুরের গল্প শোনাবো আজ। এদের সত্য কাহিনী কখনো করবে চোখের পানিতে শোকাহত, মানুষ হিসেবে কখনো করবে লজ্জিত ও রাগান্বিত, কখনো করবে আমোদিত, কখনো বা অবাক বিস্ময়ে বিমোহিত।
হাচিকো
সে ছিল আকিতা ইনু জাতের এক পুরুষ কুকুর। জাপানের পার্বত্যময় উত্তরাঞ্চলে পাওয়া যায় কুকুরের এই প্রজাতি। আকিতাদের সামন্ততান্ত্রিক সময় (Feudal Age) থেকেই জাপানে ব্যবহার করা হত রাজপরিবারের সদস্য ও অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকদের নিরাপত্তার কাজে। প্রভুভক্ত হিসেবে এদের সুনাম অকল্পনীয়। তারই প্রমাণ দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের হাচিকো। ১৯২৪ সালে তৎকালীন টোকিও ইমপেরিয়াল ইউনিভার্সিটির (বর্তমান ইউনিভার্সিটি অব টোকিও) কৃষি বিভাগের অধ্যাপক এইজাবুরো উয়েনো যখন তার এক ছাত্র থেকে উপহার হিসেবে হাচিকোকে পান, তখন সে ছিল সোনালি-বাদামি রঙের ছোট্ট এক আকিতা ছানা। উয়েনো তার নাম রাখেন হাচিকো।
দিন যায়, উয়েনোর আদরের হাচিকো বড় হতে থাকে। অধ্যাপকের সাথে ভালো খাতির হয়ে যায় হাচিকোর। প্রতিদিন সকালে সে তার মালিকের সাথে টোকিওর শিবুইয়া রেল স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে যেতো। উয়েনো যখন ট্রেনে করে তার কাজে চলে যেতেন, হাচিকো আবার ঘরে ফিরে আসতো। সন্ধ্যাবেলায় উয়েনো যখন আবার ট্রেনে করে ফিরে আসতেন, হাচিকো শিবুইয়া স্টেশনের টিকেট গেটের সামনে অপেক্ষা করতো তার মনিব উয়েনোর জন্য। তারপর দুজনে মিলে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসতেন। এই হয়ে গিয়েছিল উয়েনো আর তার প্রিয় কুকুর হাচিকোর নিয়মিত কাজ। এভাবেই চলল প্রায় দেড় বছর। হঠাৎ একদিন জীবনবীণার ঐকতানে ছেদ পড়লো। ১৯২৫ সালের ২১ মে ক্লাসে লেকচার দেওয়ার সময় অধ্যাপক এইজাবুরো উয়েনো মস্তিকের রক্তক্ষরণে মারা গেলেন। ঐদিকে মনিবের অপেক্ষায় টিকেট গেটের সামনে ঠায় বসে আছে বছর দেড়েকের ‘ছোট্ট’ হাচিকো। কিন্তু তার প্রিয় মনিব তো আর ফেরে না। একদিন না, এক সপ্তাহ না, এক মাসও না, এমনকি এক বছরও না; হাচিকো তার মনিবের জন্য পাক্কা নয় বছর নয় মাস পনেরো দিন অপেক্ষায় ছিল। তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় ১৯৩৫ সালের ৮ মার্চ, যখন সেদিনের সেই ছোট্ট হাচিকো ১১ বছর বয়সে মারা যায়। তাকে শিবুইয়ার রাস্তায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
হাচিকোর মৃত্যুতে পুরো জাপান শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। সারা জাপানে জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়। হাচিকোর শেষ ঠিকানা হয় টোকিওর আওইয়ামা সিমেট্রিতে; তার মনিব উয়েনোর পাশে। যার জন্য দীর্ঘ এক দশকের মতো অপেক্ষা, সেই প্রিয় মনিবসকাশেই তাকে পরম আদরে রেখে আসে অশ্রুসজল জাপানিরা।¹
মৃত্যুর আগেই অবশ্য বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল হাচিকো। ১৯৩৪ সালের এপ্রিলে শিবুইয়া স্টেশনে হাচিকোর একটা ভাস্কর্য স্থাপন করে জাপানিরা। মনমরা হাচিকোও সেখানে উপস্থিত ছিল। যদিও এটি বেশিদিন টেকেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যটিকে গলিয়ে অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে হাচিকোর ভাস্কর্য পুনঃনির্মাণ করে জাপানীরা।
২০১৫ সালের ৮ মার্চ হাচিকোর মৃত্যুর ঠিক ৮০ বছর পূর্তিতে ইউনিভার্সিটি অব টোকিও হাচিকো ও তার মনিবের পুনর্মিলনের ভাস্কর্য স্থাপন করে।
হাচিকোকে একবার বহু মাইল দূরে তার মনিবের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু হাচিকো সেখান থেকে চলে আসে এবং যথারীতি তার মনিব উয়েনোর জন্য শিবুইয়া স্টেশনে অপেক্ষা করে। প্রভুভক্তির এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জাপানের স্কুলগুলোর পাঠ্যবইতে বেশ শ্রদ্ধার সাথে শেখানো হয় আজও। হাচিকোর প্রভুভক্তি পশ্চিমা বিশ্বেও যথেষ্ট আলোড়ন তোলে। ২০০৯ সালে ১৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করে নির্মিত হয় Hachi: A Dog’s Tale নামের ৯৩ মিনিটের এক চলচ্চিত্র।
লাইকা
মহাকাশে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করা প্রথম প্রাণী মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এক বোহেমিয়ান কুকুর- লাইকা। প্রায় ছয় কেজি ভরের লাইকা ছিল সংকর টাইপ (Mongrel) মেয়ে কুকুর; অর্থাৎ সে ছিল আধেক সাইবেরিয়ান হাস্কি ও আধেক টেরিয়ার।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, রাস্তার কুকুর হিসেবে ক্ষুধা ও ঠাণ্ডায় লাইকারা বেশ সহ্যশক্তিসম্পন্ন হবে। তারা লাইকাসহ তিনটি কুকুরকে মহাকাশে প্রেরণের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলো। লাইকা ছাড়া বাকি দুই কুকুরের নাম দেওয়া হয়েছিল- আলবিনা ও মুশকা। তাদের ছোট্ট খাঁচায় রেখে পুষ্টিকর জেল জাতীয় খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করাতে লাগলো সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ।
১৯৫৭ সালের অক্টোবরে স্পুটনিক-১ এর সফলতার পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্ব দানকারী নিকিতা ক্রুশ্চেভ রুশ বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ৭ নভেম্বর আরেকটি মহাকাশযান মহাশূন্যে পাঠানোর আদেশ দেন। এত অল্প সময়ের মাঝে (প্রায় এক মাসের সামান্য বেশি সময়) কীভাবে আরেকটি মহাকাশযান সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে মহাশূন্যে প্রেরণ করা সম্ভব! কিন্তু সোভিয়েত নেতার আদেশ অমান্য করার সুযোগ কোথায়? ফলে জোরেশোরে চললো স্পুটনিক-২ তৈরির কাজ। সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে শেষতক ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর লাইকাকে নিয়ে বাইকোনুর রকেট স্টেশন (বর্তমান দক্ষিণ কাজাখস্তান) থেকে মহাশূন্যে যাত্রা করে স্পুটনিক-২।
স্পুটনিকে অক্সিজেন জেনারেটর, কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের যন্ত্র থেকে শুরু করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক ও লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের সুবিধা থাকলেও ছিল না লাইকাকে ফিরিয়ে আনার কোনো ব্যবস্থা। ফলে মহাশূন্যে গিয়ে মারা যায় লাইকা। স্পুটনিক-২ উৎক্ষেপণের ঠিক কত পরে লাইকা মারা যায়, এটি নিয়ে ধোঁয়াশা আছে।
দিমিত্রি মালাশেনকভ ছিলেন স্পুটনিক-২ মিশনের একজন বিজ্ঞানী। তার কাছ থেকে জানা যায় এক অমানবিক, নিষ্ঠুর মহাকাশযাত্রার গল্প। লাইকাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটা ছোট্ট খাঁচায় রাখার কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছিলাম না? জানেন কি, কতক্ষণ বা কত ঘন্টা লাইকাকে এভাবে রাখা হয়েছিল? ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে ছোট খাঁচায় ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত রাখা হয়েছিল! স্পুটনিক-২ এর টেলিমেট্রি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, অত্যাধিক তাপ, চাপ ও আর্দ্রতা ছিল লাইকার মৃত্যুর কারণ। আগে ধারণা করা হতো, মহাশূন্যে লাইকা কমপক্ষে চারদিন টিকে ছিল। কিন্তু ২০০২ সালে দিমিত্রি বিবিসির কাছে ফাঁস করে দেন লাইকার মহাশূন্যে টিকে থাকার সঠিক সময়। লাইকা মহাশূন্যে পৌঁছানোর কয়েক ঘন্টার ভিতর মারা গিয়েছিল। এমনকি লাইকাকে স্পুটনিকের ভেতরে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল বলেও দাবি করেন দিমিত্রি যাতে সে নড়াচড়া করতে না পারে! অবশেষে লাইকার ‘কফিন’ স্পুটনিক-২ দুই হাজার পাঁচশ’ সত্তর বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ শেষে ১৯৫৮ সালের ৪ এপ্রিল মহাশূন্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বিজ্ঞানের ‘স্বার্থে’ লাইকার এই আত্মত্যাগ চিরভাস্বর হয়ে আছে এবং থাকবে।
রিন টিন টিন
চিন্তা করতে পারেন, অস্কারের প্রথম আসরে সেরা অভিনেতার বিভাগে এক কুকুর মনোনয়ন পেয়েছিল! কিন্তু মানুষ নয় বলে তাকে সেই পুরস্কার দেওয়া হয়নি। আজকের বিশ্ব কাঁপানো বিনোদন জায়ান্ট ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া থেকে টেনে তোলে এই একই কুকুর! ২৩টি ছবিতে অভিনয় করা এই কুকুরের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তো সবাই! তাকে নিয়ে সুজান অরলিয়েন Rin Tin Tin: The Life and the Legend নামে একটা বইও লিখেছিলেন; যাকে শিকাগো ট্রিবিউন মাস্টারপিস বলে আখ্যায়িত করে। তার মৃত্যুতে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয় ১৯৩২ সালে। আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় এই কুকুরের নাম রিন টিন টিন; ডাকনাম- রিনটি।
সমগ্র ইউরোপ তখন মহাযুদ্ধের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত। ধ্বংসলীলার জনপদে তখন শান্তির জন্য হাহাকার। চার বছর ধরে চলা প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ দেখার অপেক্ষায় ক্লান্ত মানুষ। এমনি সময়ে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর ফ্রান্সের যুদ্ধক্ষেত্রে জন্ম নেয় এক জার্মান শেফার্ড। হয়তো যুদ্ধের নগ্ন থাবায় মারাই যেত সে; কিন্তু ভাগ্যের লিখন যে অন্য সমাধান এঁকে রেখেছিল তার জীবনের স্কেচবুকে। আর সেকারণেই হয়তো তাকে খুঁজে পায় এক আমেরিকান সৈন্য- কর্পোরাল লি ডানকান। ডানকানকে তার ইউনিট ১৩৫ এরো স্কোয়াড্রন থেকে পাঠানো হয়েছিল তার ইউনিটের জন্য একটা যুতসই জায়গা খুঁজে বের করার কাজে। আর খুঁজতে খুঁজতেই তিনি পেয়ে যান এক কুকুরশালা, যেখানে ইমপেরিয়াল জার্মান সেনাদের জন্য কুকুর সরবরাহ করা হতো।
গোলায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন ডজনখানেক কুকুরের মৃতদেহের মাঝে লি ডানকান এক ক্ষুধার্ত মা কুকুরকে দেখতে পান; সাথে তার পাঁচটি ছানা যাদের এখনো চোখ ফোটেনি। ডানকান মা-সহ কুকুরছানা পাঁচটিকে নিয়ে আসলেন এবং কোর্ট মার্শালের খড়গ উপেক্ষা করে তাদের দেখাশোনা করতে লাগলেন। মায়ের বুকের দুধ ছাড়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই তিনি ইউনিটের বিমানে করে প্রায় প্রতিদিন ছানাগুলোকে দেখে আসতেন। বাচ্চাগুলো যখন মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়লো ডানকান মাকে এক অফিসারের কাছে আর তিনটি ছানাকে অন্য সৈন্যদের দিয়ে দিলেন। তিনি নিজে রাখলেন একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কুকুর। নাম দিলেন তাদের রিন টিন টিন আর নানেত। মহাযুদ্ধ শেষে তাদের নিয়ে জন্মভূমি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরলেন ডানকান। ²
রিনটির প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ছিল The Man from Hell’s River (১৯২২); ১৯২৩ সালে Where the North Begins সিনেমাটির মাধ্যমে রিনটি দেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে; সেই সাথে ধ্বংসের মুখে থাকা ওয়ার্নার ব্রাদার্সকেও টেনে তোলে। রিনটি সর্বশেষ The Lightning Warrior নামে ১২ পর্বের একটি সিরিয়ালে ‘অভিনয়’ করে।
১৯৩২ সালের ১০ আগস্ট প্রায় ১৪ বছর বয়সে রিনটি মারা যায়। প্রিয় কুকুরের মৃত্যুতে ডানকান শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি রিনটিকে নিয়ে একটি কবিতাও রচনা করেন।
রিনটি অবশ্য শায়িত আছে তার জন্মভূমি ফ্রান্সের মাটিতেই। ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন পোষা প্রাণীদের বিখ্যাত সিমেট্রি Cimetière des Chiens et Autres Animaux Domestiques-তে গেলে দেখা মিলবে হলিউড ইতিহাসের অন্যতম সফল কুকুর রিন টিন টিনের চির বিশ্রামের স্থান।
বব্বি
একটু চিন্তা করুন তো এভাবে, আপনার প্রিয় কুকুরটি হারিয়ে গেছে। দিন যায়, রাত আসে; মাস পেরোয়, মাসে মাসে। কিন্তু দেখার নাম নেই প্রিয় পোষা প্রাণীটির। আশাহত হয়ে মন খারাপের দিনযাপন যখন করছেন ঠিক তখনই দরজার কড়িকাঠে এসে হাজির আপনারই প্রিয় সেই কুকুরটি, যাকে আপনি অনেক আগে হারিয়ে ফেলেছিলেন। কুকুরের প্রভুভক্তির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এটি হয়তো ঠিক আছে; কিন্তু যখন জানবেন, কোনো কুকুর তার মনিবের কাছে ফেরার জন্য টানা ছয় মাস ধরে চার হাজার কিলোমিটারেরও অধিক পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে, তখন চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। এরকমই এক বিস্ময়কর কুকুর হল বব্বি।
বছর দুয়েকের স্কচ কোলি জাতের বব্বি ছিল ব্রেইজার পরিবারের পোষা কুকুর। ১৯২৩ সালের গ্রীষ্মকালীন অবকাশে ব্রেইজার পরিবারের সাথে সে-ও আসে ইন্ডিয়ানা স্টেটের ওয়ালকোট শহরে। ব্রেইজার পরিবারেরা থাকতো অরিগন স্টেটের সিলভার্টন শহরে; ওয়ালকোট শহর থেকে প্রায় আড়াই হাজার মাইল দূরে। বেশ ভালোই কাটছিল ব্রেইজারদের সময়। কিন্তু হঠাৎই কীভাবে যেন হারিয়ে গেলো তাদের প্রিয় পোষা কুকুর বব্বি। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নিরাশ হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে সিলভার্টনের পথে রওয়ানা হলেন বব্বির মনিব ফ্র্যাঙ্ক ব্রেজিয়ার। হারিয়ে গেলো বব্বি।
ফ্র্যাঙ্ক ও এলিজাবেথ ব্রেজিয়ার তাদের খামারবাড়ির জন্য একটা কুকুর পোষার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রেজিয়ার পরিবারে আসলো এক ছোট্ট কুকুরছানা। আদর করে একটা নামও দেওয়া হল তার- বব্বি। ব্রেজিয়ার দম্পতির দুই মেয়ে লিওনা আর নোভার ভালোই সময় কেটে যেত বব্বিকে নিয়ে। আর দুষ্টু বব্বিও সারাদিন ছুটোছুটি করতো এদিক ওদিক। ³ দেখতে দেখতে বব্বি বড় হয়ে গেলো। তার যখন দু’বছর বয়স, ব্রেইজার পরিবার বব্বিসহ ঘুরতে গেলো হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের অরিগন স্টেটে। কোনো এক গ্যাস স্টেশনে গাড়িতে জ্বালানি নেবার সময় সেখানকার স্থানীয় কিছু কুকুরের তাড়া খেয়ে বব্বি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তার মনিবের থেকে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় অরিগনের বব্বি বিখ্যাত হয়ে আছে তার ফিরে আসার মহাকাব্যিক গল্পে।
ধাওয়া খেয়ে সেই যে হারিয়ে গেলো, আর ফিরে আসার নামগন্ধ নেই। ব্রেজিয়ার পরিবার সেখানকার এক স্থানীয় টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমে আশেপাশের বাড়িঘরগুলোতে ফোন করে করে খোঁজ করলেন। এক সাপ্তাহিক পত্রিকাতেও গেলো বব্বির নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলো না বব্বিকে। হতাশ হয়ে সপ্তাহখানেক পরে বাড়ির পথে রওয়ানা হল ব্রেজিয়ার পরিবার। আর ওদিকে একাকী বব্বি শুরু করলো তার নিঃসঙ্গ যাত্রা- বাড়ি ফেরার বিশাল অভিযাত্রা। শরতের নির্মেঘ ধরাতল আর শীতের ভয়ানক ‘করাল থাবার’ ভিতর দিয়ে বব্বিকে যেতে হয়েছে মাসের পর মাস। পাথুরে পর্বত ডিঙিয়ে, সুবিস্তৃত প্রেইরী পেরিয়ে, আইডাহোর জনবিরল প্রান্তর ধরে বব্বি ছুটেছিল নিরন্তর। তাকে যে ফিরতেই হবে সিলভার্টনে, যেখানে আছে তার প্রাণপ্রিয় মনিব, তার আবাস, তার সবকিছু। পথে পথে সে পেয়েছে বহু মানুষের দেখা, খামারবাড়ির দয়ালু গৃহিণী থেকে পেয়েছে খাবার। এরা ছিল বব্বির যাত্রাপথের সাক্ষী। নিরন্তর ছুটে চলায় বব্বিকে খাঁচাবন্দীও হতে হয়েছিল। কিন্তু এত বিপত্তি সত্ত্বেও সে তার গৃহে ফেরার প্রত্যয়ে ছিল অটুট। অবশেষে ছয় মাসের ২, ৫৫১ মাইলের সুদীর্ঘ নিঃসঙ্গ যাত্রা শেষে ১৯২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বব্বি পৌঁছে যায় তার গৃহসকাশে- উইলিয়ামেট উপত্যকার পূর্বকোণের ছোট্ট শহর সিলভার্টনে। ফ্র্যাঙ্ক ব্রেজিয়ারের ছোট মেয়ে নোভা (এতদিন পরে) বব্বিকে দেখে চিৎকার করে ডেকে ওঠে। বব্বিও নোভাকে চিনতে পেরে তার কোলে এসে ঝাঁপ দেয়। বব্বি ফিরে আসে তার আপন ঠিকানায়। 4
বব্বিকে নিয়ে চারিদিকে আলোড়ন পড়ে যায়। Ripley’s Believe it or Not-এ বব্বির মহাকাব্যিক যাত্রাপথ স্থান পায়। মহাআড়ম্বরে বব্বিকে সম্মাননা দেওয়া হয়; ৪০ হাজার মানুষ আসে এই বিস্ময় কুকুর বব্বিকে দেখতে। The Call of the West নামের এক নির্বাক ছবিতে বব্বি অভিনয়ও করে।
বব্বিকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। বাড়ি ফেরা বব্বি ছিল ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত; তার পা দুটি ছিল ক্ষতবিক্ষত, আহত। অনেক সেবাযত্নের পর সুস্থ হয়ে ওঠে বব্বি। ফিরে আসার পর আরো বছর তিনেক বেঁচে ছিল এই বিস্ময় কুকুর। ১৯২৭ সালে বব্বি মারা যায়। Oregon Humane Society-এর পোষা প্রাণীদের জন্য নির্মিত সিমেট্রিতে তাকে কবর দেওয়া হয়। প্রভুভক্তির এক অসামান্য নিদর্শন নাকি অদম্য হৃদয়ের অক্লান্ত মন- কোনটি বেশি মানানসই হয় বব্বির বিশেষণে?
ফিচার ইমেজ- Edited by writer
ফুটনোটঃ
1. Bouyet, B. (2002). Akita, treasure of Japan (Vol. 2). Magnum Publishing. p. 5 & 6.
2. Orlean, S. (2011). Rin Tin Tin: The Life and the Legend. Simon and Schuster. p. 21-32.
3. Brown, T. (2016). Bobbie the Wonder Dog: A True Story. Graphic Arts Books. p. 4 & 7.
4. Kent, J. (2004). Silverton’s Bobbie: His Amazing Journey-the True Story. Beautiful America Publishing Co. p. 20-27.