কী যাতনা বিষে,বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে
বিষ (Venom) মুলত প্রোট্রিনজাত রাসায়নিক পদার্থ যা মুলত প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করার জন্যেই নি:সৃত করে থাকে সাপ, শামুক, মাকড়সা সহ প্রায় ৩০০-৪০০ ধরনের প্রাণী। তবে বিষধর কোনো প্রাণীরই শিকারের প্রাণী নয় মানুষ। ফলে মানুষের উপরে সাপ বা অন্য বিষধর প্রাণী শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্যেই বিষ ব্যবহার করে থাকে। তাহলে শিকারের জন্য কেন সাপসহ অন্যান্য বিষধর প্রাণীরা শারীরিক কাঠামো পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না গিয়ে বিষ উৎপাদনের মত জটিল জৈবরাসায়নিক পরিবর্তন আনে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো আজ আমরা।
বিষের আধার যারা
প্রথম ছবিটি অস্ট্রেলিয়ান তাইপান (Taipan snake) সাপের। এর এক কামড় ২৫০,০০০ ইদুর মারার জন্যে যথেষ্ট। আর দ্বিতীয় ছবিতে ভারত মহাসাগরের ত্রাস মার্বেল কোণাকৃতি শামুক। বেচারার বিষের এক ফোটা ২০ জন জলজ্যান্ত মানুষকে ধরাশায়ী করার জন্যে যথেষ্ট! ৩ নাম্বার ছবির বক্স জেলিফিশটি দেখতে খুব মনোরম হলেও এর একটি হুল মিনিটের মধ্যেই মানব হৃদযন্ত্রকে অচল করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।*1
এই উদাহরণগুলো থেকে এই প্রশ্নটা মনে আসে, বেচারা সাপ-জেলিফিশ-শামুকদের এই বিষের দরকার পড়লো কেন? বিষ ছাড়াও হিংস্র শিকারিরা তাদের নখর,পাঞ্জা কিংবা ক্ষিপ্রতা দিয়ে শিকারকে প্রতিনিয়ত কুপোকাত করছে? বিবর্তনবাদ অনুসারে প্রয়োজন ছাড়া যেহেতু কোনোকিছুরই উদ্ভব ঘটেনি তাই বিবর্তনের ঠিক কোন ধাপে এই বিষ আর বিষধর প্রাণীর উৎপত্তি?
বিষ নিয়ে কিছু গবেষণা
বিবর্তনের ঠিক কোন ধাপে কিছু প্রাণী আত্ম্ররক্ষা আর শিকার ধরার এই বিষ নিসঃরণের কৌশল আয়ত্ত করে তা জানার লক্ষ্যে গবেষক ইয়েহু মোরান (Yehu Moran) ও তার সহকর্মী কার্তিক সোনাগর (Kartik Sunagar) হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেমে একটি অভিনব গবেষণা করেন। *1
পিট ভাইপার (Pit Viper) এর উপর করা এই গবেষণা থেকেই বেরিয়ে আসে বিষ তৈরি্তে ব্যবহৃত প্রোটিনগুলো তৈরি করতে আক্রমণকারী প্রাণীর মেটাবোলিক এক্টিভিটি ১১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায় এবং এই বিষ নিসঃরণ করতে উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণ শক্তি ব্যয় হয়। এই গবেষণা থেকে আরো একটি গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপার বেরিয়ে আসে, সেটি হলো মার্বেলেড সি স্নেক (Marbled Sea Snake) যেটি মুলত সুযোগসন্ধানী ডিমখাদক এবং এই প্রজাতির সাপের বেশিরভাগ ডিমখাদক হয়ে উঠায় এবং আক্রমণ করার মত প্রতিপক্ষ না পেয়ে ক্রমান্বয়ে তার বিষ উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়েছে। যদিও এই সাপের একই গণভুক্ত (genus) অন্য প্রজাতিগুলো এখনো বিষ উৎপন্ন করে থাকে।*1
সাপের বিষ রহস্য উৎঘাটনে গবেষকরা জিনোম সিকোয়েন্সিং এর সহায়তা নিয়ে তৈরি করেন একটি ফাইলোজেনেটিক ট্রি (Phylogenetic tree), যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বিষধর প্রজাতির গিরগিটি (Eastern Blue-tongued Lizard) আজকের এই বিষধর সাপের আদিপুরুষ, যার উদ্ভব হয়েছিল ১৭০ মিলিয়ন বছর আগে।*5
তবে আদিপুরুষ হিসাবে পরিচিত গিরগিটির বিষের প্রোটিন কম্পোজিশন অনেক বেশি সরল। কালক্রমে তা জটিল আকার ধারণ করে। ২০০৯ এর গবেষণা থেকে সাপের বিষ তৈরিতে সাপের খাদ্যভাসের ব্যাপারটি ঊঠে আসে। সেখানে মৎস্যভুক, পতঙ্গভুক, মেরুদন্ডী প্রাণীভুক সাপের বিষের (Echis গণের সাপের উপর গবেষণাটি করা হয়) তুলনামুলক পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায় পতঙ্গভুক সাপের বিষ সবচেয়ে শক্তিশালী। এরপরই আছে মেরুদন্ডীভুক সাপের বিষ সবার শেষে আছে মৎস্যভুক সাপের বিষ।*5
এই গবেষণার ফলাফলটিকে গবেষকরা সাপের খাদ্যাভাসের পরিবর্তনের ফলে সাপের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (Mitochondrial DNA) তে স্থায়ী পরিবর্তন আসে বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বর্তমানে এই বিষয়ে আরো গবেষণা চলছে। অচিরেই হয়তো এর কারণ আরো স্পষ্টরুপে জানা যাবে।*5
বিষের প্রয়োজনীয়তা
তাত্ত্বিকভাবে এটা প্রমাণিত যে বিষধর প্রাণীগুলো বিবর্তনে এমন একটি ধাপ পার করে এসেছে যার ফলে শারীরিক কাঠামো উন্নয়ণ এর বদলে অভ্যন্তরীন জটিল জৈবরাসায়নিক পরিবর্তন এনেছে। এই কারণেই অমেরুদন্ডী এবং ব্যাহিক দুর্বল কাঠামোর প্রাণীর বিবর্তনিক স্থিতিশীলতা আসে বিষধর হওয়ার মাধ্যমে। আমরা আগেই জেনেছি যে তাইপান সাপ (Taipan snake) এর এক কামড়ে প্রায় ২৫০,০০০ ইদুর মারার শক্তি রাখে। তাহলে তাত্ত্বিকভাবে একখান তাইপান সাপই তার জীবদ্দশায় ইদুর প্রজাতিকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। আর তাহলে তার প্রতিক্রিয়ায় খাদ্য সংকটে পড়ে বেচারা তাইপান এরও বিলুপ্ত হয়ে পড়ার কথা। তাহলে আজ আর এই তাইপান সাপ জীবিত পাবার কথা নয়।*1
পরবর্তীতে গবেষণায় বেরিয়ে আসে, ল্যাবে যে ইদুর ব্যবহার করা হয়ে থাকে তার এই বিষের প্রতি সহনক্ষমতা আসলে কম। তবে বিজ্ঞানীরা একটি মজার উপসংহার দিয়ে তাদের পেপারটি শেষ করেছেন –
“একটা সাপের কামড় ঠিক কয়টা ল্যাব ইদুর মারে ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম যে একটা চিতা দিনে কয়টা কচ্ছপ শিকার করলো, কারণ চিতার কচ্ছপ শিকার করার জন্যে আর কচ্ছপ চিতার হাত থেকে বাঁচার জন্যে বিবর্তিত হয়নি।”*1
বিষে বিষক্ষয়
মজার ব্যাপার হলো সাপের বিষের প্রতিবিষ (antivenom) সাপের বিষ থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। মুলত সাপের বিষ কৃত্রিম উপায়ে সংগ্রহ করে তার ঘনমাত্রা কমিয়ে তা ইঞ্জেক্ট করা হয়ে থাকে ঘোড়া, ভেড়া, খরগোশ কিংবা ছাগলের রক্তে। *7
ফলশ্রুতিতে সেই প্রাণী নিজ রক্তে প্রতিবিষ তৈরি করে। তা আবার সংগ্রাহকরা নিয়ে সাপের বিষের উপযুক্ত প্রতিবিষ তৈরিতে কাজে লাগান। তবে এই প্রক্রিয়ারও কিছু পার্শপ্রতিক্রিয়া থাকায় বর্তমানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে প্রতিবিষ তৈরি করা হয়ে থাকে।
একটু সহানুভুতি কি সাপ পেতে পারে না!
আগেই বলা হয়েছে বিষধর কোনো প্রাণীরই শিকারের প্রাণী নয় মানুষ কিন্তু তারপরে ও প্রতিবছর সাপের কামড়ে আক্রান্ত গড়ে ২৫ লক্ষ লোকের মধ্যে ১ লক্ষ মৃত্যুবরণ করেন। তাই সাপের দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়া জরুরী। যেটির অভাবে হাসুপাতাল নেবার রাস্তায় মৃত্যু হয় বেশীরভাগ রোগীরই। উপরের আলোচনা থেকে থেকে বুঝা যায় যে মানুষের উপরে সাপ বা অন্য বিষধর প্রাণী শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্যেই বিষ ব্যবহার করে। তাই সাপে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে কী করতে হয় জেনে নিন উঝার কাছে গিয়ে বেচে থাকার মুল্যবান সম্ভাবনাটুকূ নস্যাৎ করবেন না।
আর সাপটিকে না মেরে ফেলাই উত্তম। পৃথিবী থেকে প্রতিবছর গড়ে ৩০০-৪০০ প্রজাতির সাপ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি সাপের হারিয়ে যাবার সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তার সাথে যুক্ত থাকা প্রাকৃতিক খাদ্যশৃংখল। তাই সাপ ধরা পড়ার পর সেটি নিকটস্থ বনে কিংবা প্রাণী সংরক্ষণাগারে পৌছে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। কারণ সাপ প্রকৃতির খাদ্যশৃখংলের একটি অংশ,বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আমি আপনি সবাই সেই খাদ্যশৃংখলের অংশ। তাই নিজের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে আপনি আমি আগামীর বাসযোগ্য পৃথিবীটি কিভাবে গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারি!