বাদুড় হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা উড়তে সক্ষম। এদের পৃথিবীর প্রায় সব দেশের গুহা, বন-জঙ্গল ও গাছপালায় দেখা যায়। বাদুড় কাইরোপটেরা বর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী। অনেকে ঢালাওভাবে বাদুড়কে রক্তচোষা স্বভাবের ভেবে থাকেন। বাস্তবে প্রায় ১ হাজার প্রজাতির বাদুড়ের মাঝে মাত্র তিন প্রজাতির বাদুড় রক্তচোষা হয়ে থাকে। রক্তচোষা হলেও আবার তাতে মানুষের রক্ত খায় ভেবে ভয় পাবার কিছু নেই। এরা প্রধানত গরুর রক্ত পানের নেশায় থাকে।
আপাত দৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে হলেও বাদুড় খুবই উপকারী প্রাণী। এ প্রাণীটিকে আমরা রাতের আঁধারে উড়তে দেখি। পায়ের হাড় হালকা হওয়ায় দাঁড়াতে অক্ষম প্রাণীটিকে গাছের ডালে ঝুলে থাকতেও দেখি। বাদুড়গুলো সাধারণত বাদামী, ধূসর কিংবা কালো রংয়ের হয়ে থাকে। তবে খুব বিরল হলেও সাদা রংয়ের বাদুড়ও আছে। এদের বসবাস হন্ডুরাসে। এদের দেখলে মুগ্ধ হতেই হবে। এখানে হন্ডুরাসের সেই বাদুড় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
হন্ডুরাসের সাদা বাদুড়কে ইংরেজিতে ‘হন্ডুরান হোয়াইট ব্যাট’ বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ectophylla alba। গ্রিক শব্দ Ecktos অর্থ হচ্ছে বাইরে এবং Phyllon অর্থ হচ্ছে পাতা। সাধারণত এই বাদুড়ের পাতার সাথে সম্পর্ক আছে বলেই এমন নামকরণ করা হয়েছে। অপরদিকে ল্যাটিন নাম alba অর্থ হচ্ছে সাদা। বাদুড়টিকে দেখতে সাদা দেখায় বলেই বৈজ্ঞানিক নামে আলবা বা সাদা শব্দটি স্থান পেয়েছে।
এদেরকে সাধারণত হন্ডুরাসের পূর্বাঞ্চল, নিকারাগুয়ার উত্তরাঞ্চল, কোস্টারিকার পূর্বাঞ্চল এবং পানামার পশ্চিমাঞ্চলীয় রেইন ফরেস্টে পাওয়া যায়। ১৮৯২ সালে আমেরিকার প্রাণী ও পক্ষীবিদ ড. জোয়েল আসাফ অ্যালেন হন্ডুরাস এবং পানামায় প্রথম সাদা বাদুড়ের দেখা পেয়েছিলেন। এগুলো ছাড়াও উত্তরাঞ্চলীয় সাদা বাদুড়ের আরেকটি প্রজাতির নাম জানা যায়, যা দেখতে সাদা রংয়ের। উত্তরাঞ্চলীয় সাদা বাদুড়ের বৈজ্ঞানিক নাম Diclidurus albus। এ প্রজাতির বাদুড়কে সাধারণত মেক্সিকো থেকে পশ্চিম ব্রাজিল ও ত্রিনিদাদে পাওয়া যায়। উভয় প্রজাতির বাদুড়ের গঠনগত দিক থেকে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত নাক দেখে সহজেই বাদুড়কে আলাদা করা যায়।
হন্ডুরাসের সাদা বাদুড় সাধারণত দৈর্ঘ্যে ৩.৭ – ৪.৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ৫.৬৭ গ্রাম পর্যন্ত ওজন বিশিষ্ট হতে পারে। এদের প্রসারিত পাখার দৈর্ঘ্য ৪.০২ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা আকারে ক্ষুদ্র বাদুড় প্রজাতিদের মধ্যে একটি। পুরুষ বাদুড়ের তুলনায় স্ত্রী বাদুড় কিছুটা ছোট হয়। শরীর তুলতুলে সাদা লোমে আবৃত থাকে। হন্ডুরাসের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটার সময় পাতার ভিতর হঠাৎ এই বাদুড় দেখলে তুলার বল ভেবে ভুল হতে পারে। এদের কান, মুখ, নাক, পায়ের কিছু অংশ এবং পাখা উজ্জ্বল কমলা বর্ণের হয়। নাক দেখতে পাতার ন্যায় ত্রিকোণাকার হয়। এজন্য এরা Leaf nosed bat নামেও পরিচিত।
সাদা লোম থাকার কারণে এই বাদুড়গুলো শিকারী প্রাণীর শিকার চক্ষুকে সহজে ফাঁকি দিতে পারে। আত্মরক্ষার জন্য সাদা লোম কীভাবে এদেরকে সহায়তা করে? তা অনুধাবন করতে হলে এদের বাসস্থান সম্পর্কে সামান্য ধারণা নিতে হবে। ক্ষুদ্র আকারের এই বাদুড়ের রুস্ট (তাদের বাসাকে রুস্ট বলা হয়) তৈরির ঘটনাটি খুবই মজার ও ব্যতিক্রম। এই বাদুড়রা ভূমি থেকে কমপক্ষে ছয় ফুট উচ্চতায় হেলিকোনিয়া উদ্ভিদের পাতাকে মুড়িয়ে V আকৃতির তাঁবু তৈরি করে।
হেলিকোনিয়া উদ্ভিদ ছাড়াও Calathea এবং Ischnosiphon উদ্ভিদের পাতায়ও তাঁবু তৈরি করতে পারে। এই তাঁবুতে একটি থেকে বারোটি পর্যন্ত বাদুড় একত্রে কলনী বা দলবদ্ধভাবে বাস করে। দিনের বেলায় পাতার মধ্যশিরা বরাবর পাশাপাশি একত্রে ঝুলে থাকে। সূর্যের আলো পাতা ভেদ করে সাদা লোমের বাদুড়ের শরীরে পড়লে তাকে সবুজ দেখায়। ফলে নিচ থেকে কোনো শিকারী প্রাণী সহজে এই বাদুড়ের অস্তিত্ব সনাক্ত করতে পারে না। ফলে শিকারি প্রাণী থেকে সুরক্ষা পায়।
হন্ডুরাসের সাদা বাদুড় নিশাচর প্রাণী। এরা রাতের বেলা খাবার সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। এরা সাধারণত ডুমুর ফল খায়। ডুমুর ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলমূলও খায়। প্রজননের জন্য একটি পুরুষ বাদুড় সাধারণত ৫-৬টি স্ত্রী বাদুড়ের সাথে রুস্টে থাকে। এরা সাধারণত মে এবং আগস্ট মাসে মিলিত হয়। একটি পুরুষ বাদুড় রুস্টের বাকি স্ত্রী বাদুড়ের সাথে মিলিত হয়। স্ত্রী বাদুড়ের গর্ভধারণকাল হয় প্রায় ২১ দিন। এ সময় প্রতিটি স্ত্রী বাদুড় একটি করে বাচ্চা প্রসব করে।
বাচ্চা প্রসব করার পর পুরুষ বাদুড় আবার একা জীবনযাপন শুরু করে। সে সময় পুরুষ বাদুড় অন্যান্য পুরুষ বাদুড়ের সাথে ভিন্ন রুস্টে বসবাস করতে থাকে। সাদা বাদুড় বছরে একবার বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চাগুলো ২১ দিন পর্যন্ত মায়ের স্তন পান করে। ৩৫ দিন বয়স থেকে বাচ্চাগুলো স্বাধীনভাবে বসবাস করতে শুরু করে।
যোগাযোগের জন্য এই বাদুড় ডাকাডাকি ও একে অপরকে স্পর্শ করে। খাবার সন্ধানের জন্য ইকোলোকেশনের ব্যবহার করে। অপরদিকে প্রজননের সংকেত প্রেরণের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ বাদুড় ফেরোমন নামক এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে। এই পদার্থের দ্বারা স্ত্রী বাদুড় মিলনের জন্য প্রস্তুত আছে কিনা পুরুষ বাদুড় তা বুঝতে পারে।
দেখতে সুন্দর হন্ডুরাসের সাদা বাদুড় আমাদের মুগ্ধ করলেও ২০০৮ সালে International Union for Conservation of Nature (IUCN) তাদের রেড লিস্টে ক্ষুদ্র এই বাদুড়টিকে বিলুপ্ত-প্রায় প্রাণীর তালিকাভূক্ত করেছে। রেইন ফরেস্ট উজাড়, বিশেষত হেলিকোনিয়া উদ্ভিদ কমে যাওয়া, আলোক দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্যের অভাব, চোরাকারবারী ও বাণিজ্য ইত্যাদি নানাবিধ কারণে প্রাণীটি আজ বিলুপ্তির পথে।
বাদুড়কে অনেকেই ক্ষতিকর প্রাণী মনে করে থাকেন। কিন্তু বাদুড়ও মানুষের জন্য অনেক উপকার সাধন করে থাকে। শতকরা ৭০ ভাগ বাদুড় মশা-মাছি, গুবরে পোকা, তেলাপোকা ইত্যাদি পোকামাকড় খায়। বাদুড় হামিং বার্ডের মতো ফুলের মধু খেতে পারে। মধু খাওয়ার সময় তাদের শরীরে থাকা লোমে পরাগরেণু আটকে যায়। পরবর্তীতে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় পরাগরেণু অন্যান্য ফুলে লেগে যায়। এভাবে বাদুড় ফুলের পরাগায়নে সহায়তা করে। অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি আছে যেগুলো বাদুড়ের দ্বারা পরাগায়ন না হলে বংশবিস্তার করতে পারবে না। ফলাহারী বাদুড় ফলের বীজ ছড়িয়ে রেইন ফরেস্টের উদ্ভিদের পুনর্জন্ম নিশ্চিত করে।
বাদুড়ের উপকারীতা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার কথা বিবেচনা করে মধ্য আমেরিকার অনেক স্থানে হন্ডুরাসের সাদা বাদুড়টিকে সংরক্ষণের জন্য যথাযথ প্রকল্প ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ সকল পরিকল্পনার মধ্যে দ্রুত বনাঞ্চল হ্রাস কমিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাণী সংরক্ষণবিদ ও পরিবেশেবিদদের কার্যক্রমের ফলে এখনও সংরক্ষিত এলাকায় এই বাদুড়কে প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায়।
ফিচার ইমেজ – animalia-life.club