বনের ভেতর দিয়ে কিংবা গভীর জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে পথিক। হঠাৎ নাকে ভেসে আসছে পোলাওয়ের চালের গন্ধ। আশেপাশে তাকালো পথিক। কোথাও কালিজিরা, চিনিগুঁড়া ধান আছে বোধহয়। কিন্তু আশেপাশে পোলাওয়ের চাল নেই কিংবা পোলাও রান্না হচ্ছে না। ভৌতিক চিন্তা-ভাবনা কল্পনায় আসতেই গাছের পাতা নড়ে উঠল। পথিক লক্ষ্য করল কাঠবিড়ালীর মতো একটি মাঝারি আকারের প্রাণী লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল। বাস্তবে এটা কোনো ভৌতিক গল্প নয়। পোলাওয়ের চালের মতো গন্ধ ছড়ানো একটি প্রাণীর নাম হচ্ছে গন্ধগোকুল। এরকম গন্ধ ছড়ায় বলেই এদের এমন নামকরণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে এটি খাটাশ নামেও পরিচিত।
গন্ধগোকুল মূলত Viverridae গোত্রের নিশাচর ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদেরকে সিভেট ক্যাট বলা হলেও এরা কিন্তু বিড়াল নয়। শরীরটা বিড়ালের ন্যায়, লেজ লম্বা ও মুখ দেখতে বেজি অথবা ভোঁদরের মতো। পশম ধূসর বা বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। শরীরে বিভিন্ন ধরনের রংয়ের সারি ও কালো ছোপ ছোপ দাগ থাকতে পারে। আফ্রিকায় আরেক ধরনের গন্ধগোকুল পাওয়া যায়। এদের লেজে আংটির মতো গোলাকার বর্ণ থাকে। সাধারণত এশিয়ায় প্রাপ্ত গন্ধগোকুলের ইংরেজি নাম হচ্ছে Asian Palm Civet। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Paradoxurus hermaphroditus।
গন্ধগোকুল লম্বায় ১৬-৩৪ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। লেজের দৈর্ঘ্য ৫-২৬ ইঞ্চি হয়। এরা ১৫ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতা বিশিষ্ট হয়। সাধারণত ১.৫-১১ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের হতে পারে এরা। প্রাণীটিকে বাংলাদেশের সিলেটের গভীর বনাঞ্চল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, চীনের দক্ষিণাঞ্চলসহ অনেক দেশেই পাওয়া যায়। সারা বিশ্বে এদের ৬৬টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশে পাওয়া যায় ৫টি প্রজাতি, যার মধ্যে ৩টি বিলুপ্তির পথে।
গন্ধগোকুল একাকী নির্জন পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। দিনের বেলায় গাছের গর্তে ঘুমায়। সাধারণত গভীর রাতে শিকার এবং খাবার সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বের হয়ে আসে। নিশাচর এ প্রাণীটি ভূমিতেই বেশি বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। মাটিতে চলাফেরা করার সময় অ্যানাল গ্রন্থি বা পায়ু গ্রন্থি দ্বারা মাটিতে ঘষে তাদের এলাকা চিহ্নিত করে। মাটিতে চলাফেরা করলেও শিকার ধরা ও শিকারীর হাত থেকে বাঁচতে গাছে উঠে লুকিয়ে থাকে।
গন্ধগোকুল সর্বভুক, কিন্তু প্রাথমিকভাবে মাংসাশী প্রাণী। এরা সাধারণত রাতের বেলা ইঁদুর শিকার করে। এছাড়াও গাছে উঠে আম, কফি বীজ, আনারস, তরমুজ, কলা ইত্যাদি খায়। তাই প্রচুর ফলমূল আছে এমন পার্ক ও বাগানেও এদের পাওয়া যায়। এছাড়াও ছোট পাখি, টিকটিকি, ছোট সাপ, ব্যাঙ, শামুক জাতীয় প্রাণীও শিকার করতে দেখা যায়। এরা তালের রস পান করতে পছন্দ করে বলে তাড়ি বা টডি বিড়ালও বলা হয়।
সারাবছরই বংশবৃদ্ধির জন্য মিলিত হয় এরা। একই গাছে টানা পনেরো দিন পর্যন্ত মিলন করে। একে অপরের কাছে আসার সংকেত প্রদানে এবং নিজস্ব এলাকা চিহ্নিত করতে পায়ু গ্রন্থি থেকে বিশেষ গন্ধ ছড়ায়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে এরা বাচ্চা প্রসব করে। প্রতিবার ২-৫টি বাচ্চা জন্ম দেয়। সদ্য জন্মানো বাচ্চা ৮০ গ্রাম ওজনের হয়, যেগুলোর এগারো দিন বয়সে চোখ ফোটে। বাচ্চাগুলোকে বাবা-মা একইসাথে পাহারা দেয়। স্ত্রী গন্ধগোকুল লম্বা লেজ দ্বারা ছোট বাচ্চাগুলোকে ঘিরে রাখে। তখন সেগুলোর লেজের দেয়াল টপকিয়ে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। বাচ্চাগুলো প্রায় এক বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয়। বন্দীদশায় এরা ২২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
এখন এদের দুটি অদ্ভুত ব্যবহার সম্পর্কে আলোকপাত করা উচিত। অন্যান্য প্রাণীর মতো এরা মানুষের কাছে অবহেলার পাত্র নয়। কারণ এদের দ্বারা মূল্যবান সুগন্ধী ও কফি তৈরি করা হয়। পুরুষ ও স্ত্রী গন্ধগোকুলের লেজের নিচে অণ্ডকোষের ন্যায় দেখতে অ্যানাল গ্লান্ড বা পায়ু গ্রন্থি থাকে। এ গ্রন্থি থেকে পিচ্ছিল কস্তুরিমৃগের ন্যায় পদার্থ নিঃসৃত হয়, যাকে সিভেট বা সিভেট অয়েল বা গন্ধগোকুলের তেল বলা হয়। এর দ্বারা অনেক মূল্যবান সুগন্ধি তৈরি করা হয়। সুগন্ধি তৈরির জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাপ্ত Viverra zibetha প্রজাতির গন্ধগোকুল ও এশীয় গন্ধগোকুল।
সুগন্ধি তৈরির জন্য একসময় গন্ধগোকুলকে হত্যা করে কস্তুরিমৃগের ন্যায় পদার্থ সংগ্রহ করা হতো। পরবর্তীতে জীবিত প্রাণীর গ্রন্থি ঘষে সুগন্ধি তৈরির উপাদান আলাদা করার পদ্ধতি চালু হয়। এই পদ্ধতি বহুল ব্যবহৃত হলেও প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে ও পরে কৃত্রিমভাবে সুগন্ধি তৈরির উপাদান আবিষ্কার হওয়ায়, বর্তমানে গন্ধগোকুলকে আর ব্যবহার করা হয় না।
এদের আরেকটি বিস্ময়কর ব্যবহার হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দামী কফি তৈরিতে! ইন্দোনেশিয়ার কপি লুয়াক (Kopi Luwak) নামক দামী কফি তৈরি করা হয় গন্ধগোকুলের মল থেকে কফি বীজ সংগ্রহ করে। ইংল্যান্ডে প্রতি কাপ কপি লুয়াক কফির মূল্য ৫০ ব্রিটিশ পাউন্ড বা ৫,৮৬২ টাকা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাউন্ড কপি লুয়াকের মূল্য ৬০০ ডলার বা ৪৯,৯৫৮ টাকা। এছাড়াও সেখানে প্রতি কাপ কফির মূল্য ৩০ ডলার বা ২,৪৯৭ টাকা। ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় ভাষায় লুয়াক অর্থ হচ্ছে গন্ধগোকুল।
আসল কপি লুয়াক কফি তৈরির জন্য একসময় সুমাত্রার গ্রাম্য অধিবাসীরা এদের মল থেকে কফি বীজ সংগ্রহ করত। এরা কফির বীজ খুব পছন্দ করে। রাতের বেলায় চুপিসারে কফি বীজ খাওয়ার জন্য ক্ষেতে যায়। কফি বীজ খেয়ে মলত্যাগ করলে হজম না হওয়া বীজগুলো সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত বীজ থেকে তৈরিকৃত কফি অধিক স্বাদযুক্ত হয়। ধারণা করা হয়, এরা কফির পাকা ও ভালো মানের বীজ খেয়ে থাকে। বীজ ভালো হলে কফির মানও ভালো হবে।
বাণিজ্যিকভাবে এই প্রাণীর মল থেকে কফি তৈরির জন্য একে খাঁচায় পালন করা হয়। তখন এদের কফি বীজ খেতে দেয়া হয়। পেটে থাকা বিশেষ ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক দ্বারা কফি বীজের উপরের আবরণ হজম হয়ে যায়। পরে আবরণ ছাড়া কফি বীজ মলের মাধ্যমে ত্যাগ করে। তখন মলমূত্র পরিষ্কার করার সময় বীজগুলো সংগ্রহ করে কফি তৈরি করা হয়।
যদিও এদেরকে এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণ দেখা যায়, তবুও বন ও বন্য পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ফলে এদের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলাহারী হওয়ায় ফলমূল চাষীদের কাছে এরা আপদ বলে বিবেচিত হয়। তাই তারাও একে হত্যা করে। অনেক সময় মাংস খাওয়া ও বিক্রির জন্যও ফাঁদ পেতে ধরা হয় প্রাণীটিকে। অনেকে ইঁদুর ধরার জন্য গৃহেও পালন করে। ফলে স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রাণীটি। কফি উৎপাদনের জন্য খাঁচায় আটকে রাখার ফলেও বন্য পরিবেশ থেকে কমে যাচ্ছে গন্ধগোকুল। কাঠের ব্যবসার কারণে ইন্দোনেশিয়ার মিন্টাওয়াই দ্বীপের কিছু প্রজাতি ও উপপ্রজাতির গন্ধগোকুল সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে কবিরাজরা চিকিৎসার জন্য গন্ধগোকুলের তেল বিক্রি করে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে চুলকানির চিকিৎসায়ও এই প্রাণীর তেল ব্যবহার করা হত। কিন্তু চুলকানির চিকিৎসায় উপকার না পাওয়ায় এখন আর ব্যবহার হচ্ছে না। অন্যদিকে চিকিৎসাক্ষেত্রেও এই প্রাণীটি ব্যবহারের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ফলে নিছক ভ্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করেও অনেক গন্ধগোকুলের জীবন বিপন্ন হয়েছে।
ফিচার ইমেজ – iamsafari.com