শকুন, মৃত প্রাণীদের মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে। হাজার হাজার বছর ধরে এই পাখি প্রকৃতি থেকে এভাবেই মৃতদেহ সরানোর কাজ করে আসছে। ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার পাখি’ হিসেবে পরিচিত শকুনের কারণে নিজের অজান্তেই মানুষ রেহাই পেয়ে যায় নানান রোগ-ব্যাধি থেকে। কিন্তু প্রকৃতিকে পরিষ্কার রাখার কাজে নিয়োজিত থাকলেও ‘শকুন’ শব্দটির সাথেই জড়িয়ে আছে যেন নেতিবাচকতা। “বিশ্বজুড়ে আশঙ্কাজনকহারে শকুন কমছে” এই বাক্যটি হয়তো কাউকে ততক্ষণ নাড়া দেবে না যতক্ষণ না তিনি এই পরিবেশে এই পাখিটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন।
রোগে আক্রান্ত হয়ে কোনো গবাদি পশু মারা গেলে তা সাধারণত খোলা প্রান্তরে রেখে দিলেই শকুন সেটি খেয়ে নেয়। তীক্ষ্ণদৃষ্টির অধিকারী এই প্রাণী আকাশের বেশ উঁচু থেকেই মৃত প্রাণী শনাক্ত করতে সক্ষম। তবে রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণী মারা গেলেও রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু সেই প্রাণীর মৃতদেহ অবলম্বন বেঁচে থাকে। তবে শকুনের পরিপাকতন্ত্র এই রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত। তাদের পরিপাকতন্ত্রে থাকে শক্তিশালী এসিড, যার প্রভাবে জীবাণুরা শকুনের দেহে তেমন সুবিধা করতে পারে না। পাশাপাশি শকুনের পরিপাকতন্ত্রে ‘Clostridia’, ‘Fusobacteria’র মতো বেশ কয়েক ধরনের ব্যাকটেরিয়া স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যেগুলো তাদের পরিপাক কাজে সহায়তা করে। তাই গবাদি পশুর মৃতদেহ থেকে শকুনের পরিপাকতন্ত্রে অ্যানথ্রাক্স, কলেরা, যক্ষ্মা কিংবা ক্ষুরা রোগের জীবাণু চলে এলেও তা তেমন ক্ষতি করতে পারে না। বরং তা বিনষ্ট হয়ে যায়, ফলে মৃতদেহ থেকে সেই জীবাণু ছড়িয়ে নতুন মহামারী সৃষ্টির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
কিন্তু যদি কোনো কারণে শকুনের সংখ্যা প্রকৃতিতে কমে যায়, তাহলে কুকুর শেয়াল, কাক, ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রাণী সেই মৃতদেহের সংস্পর্শে আসে। তবে শকুনের মতো বেশিরভাগ প্রাণীর এমন বিশেষায়িত পাকস্থলী থাকে না। ফলে সেই প্রাণীগুলোর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ জীবাণুর বাহক হিসেবেও কাজ করতে পারে এবং যেহেতু এই প্রাণীদের একটি বড় অংশ সরাসরি মানুষের সংস্পর্শে থাকে, তাই মহামারী আরো বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
কিন্তু শেষ কবে শকুন চোখে পড়েছিলো আপনার?
শকুনকে মৃতদেহের কাছেপিঠে দেখা তো দূরে থাকুক, শেষ কবে উড়তে দেখেছেন সেটাও অনেকের জন্য মনে করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। কারণ শকুনের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। বাংলাদেশে আগে যেখানে প্রায় ৬ প্রজাতির শকুন আকাশ দাপিয়ে বেড়াতো, সেখানে এখন দূরবীনে চোখ রেখেও শকুন খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
ছয় প্রজাতির শকুনের মধ্যে ‘বাংলা শকুন’, ‘কালা শকুন’, ‘হিমালয়ী গৃধিনী’, ‘সরুঠুঁটি শকুন’ উল্লেখযোগ্য হারে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যেত। পশুপাখি মারা যাওয়ার সাথে সাথেই দল বেঁধে শকুনের দল ভিড় জমায় শবদেহের চারিদিকে।
নব্বইয়ের দশকেও এই পাখিকে দেখা যেতো বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে। মূলত দল বেঁধে থাকতেই এরা ভালোবাসে। একটি শকুনের দল ২০ মিনিটের মধ্যেই একটি মৃত গবাদি পশুর মাংস তো বটেই ছোটখাট হাড়ও খেয়ে প্রকৃতিকে পরিষ্কার রাখে।
নতুন বনাম পুরাতন
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পরিবেশে ছড়িয়ে থাকা অনেক ধরনের শকুনকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি হলো ‘নতুন’, আরেকটি ‘পুরাতন’ পৃথিবীর শকুন। পরিবেশগত পার্থক্যের কারণেই এদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য।
নতুন পৃথিবীর শকুন বলতে মূলত উত্তর আমেরিকা, কানাডা, মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকায় দেখা যায় এমন শকুনদেরকে বোঝানো হয়ে থাকে। আর পুরাতন পৃথিবীর শকুনদের পাওয়া যায় ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশে মূলত পুরাতন পৃথিবীর শকুনই দেখা যায়।
এই দু’ধরনের শকুনই মৃত প্রাণীর উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকলেও এদের আকার, আকৃতি, গঠন, বংশবৃদ্ধি থেকে শুরু করে বেশিরভাগ জিনিসই আলাদা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, নতুন পৃথিবীর শকুনদের মস্তিষ্কে থাকে সুগঠিত ‘অলফ্যাক্টরি লোব’। এর কারণেই এরা গন্ধ শুঁকেই তাদের লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করতে পারদর্শী। আর পুরাতন পৃথিবীর শকুনেরা গন্ধ শোঁকায় নতুনদের থেকে পিছিয়ে থাকলেও এদের আছে সুগঠিত ‘অপটিক লোব’। উড়ন্ত অবস্থায় অনেকদূর থেকেই লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করতে সক্ষম এরা।
শকুনের টাক মাথার পেছনের রহস্য কি?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শকুনের মাথা কোনো পালকে আচ্ছাদিত থাকে না, তবে কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে যৎসামান্য পালক দেখা যায়। এতে শকুনকে সামনাসামনি বেশ ভয়ংকর দেখা যায়। আর এই নিয়ে রহস্যেরও শেষ নেই। এই বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে ব্যাখ্যাটি প্রচলিত ছিলো তা হলো, শকুন যেহেতু মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে সেহেতু বেশিরভাগ সময়ই এর মাথার পালক পশুর রক্তের সাথে আঠার মতো আটকে যায়। ফলে বার বার ঠোকর দেওয়ার সময় অল্প অল্প করে মাথার পালক উঠে যায়।
কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, শকুনের মাথার তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য মূলত এর পালক নেই। টাক হওয়ার ফলে এদের দেহের তাপমাত্রা খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
বাসস্থান আর প্রজনন
পুরাতন পৃথিবীর শকুনেরা পাহাড়ের খাঁজে কিংবা গাছের মগডালে বাসা বাঁধে। অনেক প্রজাতির নেই কোনো বাসার বালাই। আর নতুন পৃথিবীর শকুনেরা বাসার ধারেকাছেই যায় না। যাযাবর জীবনেই অভ্যস্ত এই পাখিরা। তবে দু’ধরনের শকুনেরাই দল বেঁধে থাকতে পছন্দ করে। এমনকি দল বেঁধে খাদ্য খেতে বের হয় এরা। খাবার খাওয়ার সময় বয়স্ক শকুনদের অগ্রাধিকার থাকে। দলের সাথে থাকা ছোটরা খাবার খায় সবার পরে। শকুনেরা জীবনে একটিমাত্র সঙ্গী বাছাই করে। অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে শকুন বছরে মাত্র একটি ডিম পাড়ে। কোনোভাবে ঐ একটি ডিম নষ্ট হয়ে গেলে এদের বিলুপ্তির সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়।
শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ কী?
গবাদি পশু বিশেষ করে গরুর ব্যথানাশক ওষুধ হিসেবে নব্বইয়ের দশকে ‘ডাইক্লোফেনাক’ এবং ‘কিটোপ্রোফেন’ রাসায়নিক বেশ জনপ্রিয়তা পায়। বাংলাদেশ, ভারত সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পশুদের সুস্থ করে তোলার জন্যে এই ওষুধের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। এই ওষুধ গ্রহণের পর যদি কোনো পশু মারা যায় আর তা যদি শকুনের দল খায়, তবে আর রক্ষা নেই!
মারা যাওয়া পশুর দেহের কঠিন সব রোগ-জীবাণুর সাথে শকুন লড়াই করে বেঁচে থাকতে পারেলেও ‘ডাইক্লোফেনাক’ এবং ‘কিটোপ্রোফেন’ জাতীয় রাসায়নিক থেকে রক্ষা নেই এদের। মৃত পশুর মাংসের মাধ্যমে এই জাতীয় বিষাক্ত রাসায়নিক শকুনের কিডনিতে পৌঁছালে কিডনি বিকল হয়ে যায়। ২-৩ দিনের বেশি বেঁচে থাকা এদের জন্য অসম্ভব হয়ে যায়। এই ওষুধের ক্ষতিকারক প্রভাবের ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখলেই। আশির দশকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো প্রায় চার কোটি শকুনের আবাসস্থল ছিলো, সেখানে এখন চল্লিশ হাজার শকুন কায়ক্লেশে বিলুপ্তির অপেক্ষায় দিন গুনছে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার আগে যেখানে পঞ্চাশ হাজারের বেশি শকুন ছিলো, সেখানে এখন ৩০০ শকুন খুঁজে পাওয়া দায়।
২০০৩ সালে যখন আমেরিকার কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসে ওক শকুনের বিলুপ্তির পিছনে ‘ডাইক্লোফেনাক’ ও ‘কিটোপ্রোফেন’ জাতীয় ওষুধকে খুঁজে বের করেছেন তখন এই ব্যাপারটি তেমন একটা আমলে নেয়নি বিভিন্ন দেশের সরকার। তবে দেরিতে হলেও ২০০৬ সালে ভারত এবং পাকিস্তান এই জাতীয় ওষুধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এর পরিবর্তে ‘মেলোক্সিক্যাম’ নামের বিকল্প ওষুধ ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকারও একই ধরনের আইন করে।
তবে আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছিলো না কিটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের ব্যবহার। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে কিটোপ্রোফেনের উৎপাদন এবং বিপণন নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। সম্প্রতি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক প্রস্তাব অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশে ‘কিটোপ্রোফেন’ এর উৎপাদন নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে এবং বিকল্প হিসেবে বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত ‘মেলোক্সিক্যাম’ নামক ওষুধ প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে আশা করা যায় পরিবেশের এই বন্ধুর একটু হলেও সুদিন ফিরে আসবে।
বাসস্থানেও টান পড়েছে শকুনের
বড় গাছের মগডালে একসময় দল বেঁধে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পেতো শকুন। তবে শিমুল, ছাতিম কিংবা দেবদারুর মতো গাছগুলো ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে আসছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে এই গাছের পরিধি। তাই শকুনও ধীরে ধীরে তাদের ডিম পাড়বার এবং পরিচর্যার স্থান হারাচ্ছে।
বিষাক্ত রাসায়নিকের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শকুনদের বাঁচিয়ে রাখার দাবিতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম শনিবারকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস’ হিসেবে। ভারতে শকুনের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুরু হয়েছে ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিং’ প্রক্রিয়া। নেপাল সরকার চালু করেছে ‘ভালচার রেস্টুরেন্ট’ নামের এক অভিনব ব্যবস্থা।
সেখানে একটি নির্দিষ্ট স্থানে মৃতপ্রায় কিংবা অসুস্থ গরু (রাসায়নিক বিষমুক্ত) রেখে দেওয়া হয়। এতে করে সহজেই বন্য শকুনেরা সেখান থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয় যখন আমাদের দেশেও শকুন সংরক্ষণের জন্য এই পদক্ষেপগুলো নেয়া হবে।