আমাদের চারপাশে কয়েক প্রজাতির সাপ দেখা যায়। ব্যাঙেরও বেশ কয়েকটি প্রজাতি আমাদের চোখে পড়ে। আচ্ছা, শুধু কি সাপ আর ব্যাঙেরই বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে? না, শুধু ব্যাঙ আর সাপেরই নয়। প্রাণীজগতের সকল প্রাণীরই রয়েছে আলাদা আলাদা প্রজাতি। আমরা মানুষরাও কিন্তু এক প্রজাতির নই। মানুষেরও বেশ কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে। তবে বিবর্তনের পথ হেঁটে অন্য সকল প্রজাতিকে টেক্কা দিয়ে আজকে আমরা (হোমো স্যাপিয়েন্স) আধুনিক মানুষ হিসেব নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছি। টিকে রয়েছি কয়েক হাজার বছর ধরে। কিন্তু আমাদের আগের প্রজাতির মানুষগুলো দেখতে কেমন ছিলো? কেমন ছিলো তাদের আচার-আচরণ, খাওয়া-দাওয়া, জীবন-যাপনের ধরণ? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব সহজ নয়। কারণ কয়েক হাজার বছর আগে তারা এ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তবে আধুনিক মানুষের গবেষণায় তাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা সম্ভব হচ্ছে। মানুষের প্রজাতিগুলোর মধ্যে বর্তমান মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের প্রজাতি হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল। তারা আজ থেকে প্রায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে এ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের অসংখ্য ফসিল (জীবাশ্ম) উদ্ধার করা গেছে বর্তমান সময়ে এসে। ফলে অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে নিয়ান্ডারথালদের সম্পর্কেই আমরা জানতে পেরেছি বেশি। আজকের লেখায় পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির মানুষদের সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা থাকবে।
এক নজরে নিয়ান্ডারথাল
প্রজাতি: Homo neanderthalensis
জীবনসীমা: ৪ লক্ষ থেকে ৪০ হাজার বছর
বাসস্থান: সমগ্র ইউরোপ, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং মধ্য এশিয়া
চেহারা: বড় নাক, ধনুকাকৃতির ভ্রু, অপেক্ষাকৃত ছোট এবং গাঁট্টগোট্টা শরীর
ব্রেইনের আকার: 1,200cm3 থেকে 1,750cm3
উচ্চতা: ১.৫০ থেকে ১.৭৫ মিটার
ওজন: প্রায় ৬৪ থেকে ৮২ কেজি
খাবার: মাংস, লতাপাতা, ছত্রাক, মাছ, শামুক, ঝিনুক
প্রজাতির নামকরণ: ১৮৬৪
নামের অর্থ: নিয়ান্ডার উপত্যকার মানুষ
কেন নিয়ান্ডারথাল নামকরণ?
ল্যাটিন শব্দ Homo এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Human/man; বাংলায় মানুষ। যদিও ১৮৫৬ সালের আগেই নিয়ান্ডারথালদের বেশ কয়েকটি ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছিলো, তবুও ১৮৫৬ সালে জার্মানির নিয়ান্ডারথাল উপত্যকা থেকে পাওয়া ফসিলটিই ছিলো নিয়ান্ডারথালদের আদর্শ নমুনা বা ফসিল।
এই নিয়ান্ডার উপত্যকার নামানুসারে মানুষের এই প্রজাতিটির নামকরণ করা হয়। উপত্যকার ইংরেজি Valley বোঝাতে জার্মান ভাষায় ব্যবহৃত হয় Tal। তবে ১৮ শতকে Tal কে জার্মানিরা উচ্চারণ করতো Thal। ফলে প্রজাতিটির নাম হয় নিয়ান্ডারথাল। তবে এখনো কিছু মানুষ নিয়ান্ডারথাল না বলে নিয়ান্ডারটাল বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রজাতিটির নাম করার ক্ষেত্রে গণ হিসেবে Homo এবং প্রজাতিক পদ হিসেবে neanderthalensis করা হয়েছে। ফলে মানুষের এই প্রজাতিটির বৈজ্ঞানিক নাম দাঁড়ায় Homo neanderthalensis. আর সাধারণভাবে বুঝতে প্রজাতিটির নাম হচ্ছে নিয়ান্ডারথাল।
নিয়ান্ডারথালদের ফসিল
১৮২৯ সালে বেলজিয়ামের এঞ্জিসের কাছাকাছি গুহা থেকে একটি নিয়ান্ডারথাল শিশুর মাথার খুলি আবিষ্কার করা হয়। নিয়ান্ডারথালদের পাওয়া ফসিলগুলোর মধ্যে এটিই ছিলো প্রথম ফসিল। তবে ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আরও ফসিল আবিষ্কার না হওয়া অবধি এটি সম্ভাব্য মানব পূর্বপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত ছিল না।
তারপর থেকে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার ফসিল পাওয়া গেছে যা কয়েকশো নিয়ান্ডারথাল ব্যক্তির অবশেষের প্রতিনিধিত্ব করে। এর মধ্যে বাচ্চা, শিশু এবং ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্করে ফসিল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যার ফলে অন্য যেকোনো মানব পূর্বপুরুষের চেয়ে নিয়ান্ডারথাল সম্পর্কে বেশি জানা যায়। ১৮৫৬ সালে জার্মানির নিয়ান্ডার উপত্যকা থেকে আবিষ্কার করা হয় নিয়ান্ডারথাল১ ফসিলটি।
এরপর ফ্রান্সের লে মুস্টিয়ে থেকে ৪৫ হাজার বছর আগের একটি মাথার খুলি আবিষ্কার করা হয়। এটি ছিলো কৈশোরে উপনীত এক নিয়ান্ডারথালের খুলি। নিয়ান্ডারথালদের যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা এ খুলিটির মধ্যেও ছিলো। এই বৈশিষ্ট্যগুলো জীবদ্দশায় অর্জিত হয়নি, বরং হয়েছিলো জীনগতভাবে। এরপর আবিষ্কার করা হয় শানিডার১ ফসিলটি। ১৯০৯ সালে ৫০ হাজার বছর আগের লা ফেরাসি ফসিল আবিষ্কার করা হয় ফ্রান্স থেকে। ১৯৮৩ সালে ইসরাইল থেকে ৬০ হাজার বছর আগের কেবারা২ ফসিল আবিষ্কৃত হয়। এই ফসিলগুলো নিয়ান্ডারথালদের সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানে সাহায্য করে গবেষকদের।
আমাদের নিকটতম প্রচীন মানব-আত্মীয়
নিয়ান্ডারথালরা আমাদের প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্সদের সমসাময়িক ও প্রায় একই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এশিয়ার ডেনিসোভানদের সাথে নিয়ান্ডারথালরাও আমাদের প্রাচীন মানব-আত্মীয় ছিলো।
নিয়ান্ডারথাল ও আধুনিক মানুষ উভয়েই একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে। জেনেটিক গবেষণাও প্রমাণ করে, আমাদের ডিএনএ’র কিছু অংশ আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে ভাগ করে পেয়েছি আমরা আধুনিক মানুষেরা। নিয়ান্ডারথালরা আমাদের তুলনায় কয়েক লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে আসলেও তাদের সাথে বসবাসের সুযোগ হয়েছে আমাদের। ইউরোপে হোমো স্যাপিয়েন্সদের আবির্ভাব ঘটতে থাকে প্রায় ৬০-৭০ হাজার বছর আগের দিকে। কিন্তু তার আগে থেকেই ইউরোপে বসবাস করতো নিয়ান্ডারথালরা। আর তারা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে। ফলে নিয়ান্ডারথালদের সাথে আমাদের কয়েক হাজার বছর ধরে বসবাস ছিলো।
কোথায় বাস করতো নিয়ান্ডারথালরা?
নিয়ান্ডাথালদের বিকাশ ঘটেছিলো ইউরোপ এবং এশিয়াতে। পক্ষান্তরে বর্তমান মানুষের প্রজাতির বিকাশ ঘটতে থাকে আফ্রিকাতে।
ফসিল গবেষণা করে বিজ্ঞানী ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা দেখেছেন যে, নিয়ান্ডারথালদের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৪ লক্ষ বছর আগে ইউরোপে। এই প্রজাতিটি ইউরেশিয়া, পশ্চিম পর্তুগাল এবং ওয়েলস থেকে সাইবেরিয়ার আলটাই পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। নিয়ান্ডারথালরা ছিলো অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন। ঠাণ্ডা জলবায়ু সত্ত্বেও কয়েক লাখ বছর ধরে সফলভাবে বসবাস করেছিলো তারা।
দেখতে কেমন ছিলো নিয়ান্ডারথালরা?
নিয়ান্ডারথালদের মাথার খুলি ছিলো লম্বা এবং নিচু। আধুনিক মানুষের মতো গোলাকৃতির ছিলো না। তাদের চোখের উপর আলাদা বিশেষ ধনুকাকৃতির ভ্রু ছিলো। তাদের মুখের কেন্দ্রীয় অংশটি সামনের দিকে একটু বেশিই প্রসারিত ছিলো। তাদের চেহারার মধ্যে যে বিষয়টি সহজে ধরা পড়তো সেটি হচ্ছে লম্বা এবং প্রশস্ত নাক। কিছু বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তাদের এ ধরনের চেহারা হওয়ার কারণ ছিলো ঠান্ডা এবং শুষ্ক পরিবেশে টিকে থাকা। তাদের নাক অপেক্ষাকৃত বড় হয়েছিলো, কারণ সেগুলো তারা যে নিশ্বাস নিতো তা আর্দ্র এবং উষ্ণ করতে কাজে লাগতো।
তাদের সামনের দাঁত অনেক বড় ছিলো এবং তাতে ছিলো নানা দাগের চিহ্ন। তারা যখন খাবার বা অন্যান্য উপকরণ তৈরি করতো তখন তাদের লম্বা দাঁতগুলো তৃতীয় হাতের কাজ করতো। নিয়ান্ডারথালদের শক্ত পেশীবহুল দেহ ছিলো। কোমর এবং ঘাড় ছিলো প্রশস্ত। পূর্ণবয়স্ক নিয়ান্ডারথালরা ১.৫০ থেকে ১.৭৫ মিটার লম্বা হতো এবং ওজন হতো ৬৪-৮২ কেজি।
প্রথমদিকের নিয়ান্ডারথালারা শেষের দিকে বিলুপ্ত হওয়া নিয়ান্ডারথালদের চেয়ে লম্বায় আরো বড় ছিলো, তবে ওজন একই ছিলো। নিয়ান্ডারথাল নারীদের স্তনের আকার অনেক বড় ছিলো। কারণ দ্রুত মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রচুর মাতৃদুগ্ধ প্রয়োজন হতো। ছোট হাত এবং পা নিয়ে তাদের শরীর ছিলো গাট্টাগোট্টা ধরনের। এ ধরনের শরীর ঠান্ডা পরিবেশে টিকে থাকার জন্য উপযুক্ত ছিলো।
নিয়ান্ডারথালদের বুদ্ধিমত্তা ও আচরণ
নিয়ান্ডারথালরা গুহায় বসবাস করলেও তাদের যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা ছিলো এবং তাদের আচরণ ছিলো অনেকটাই মার্জিত। তাদের ব্রেইনের আকার ছিলো ১,২০০-১,৭৫০ ঘন সেন্টিমিটার, যা বর্তমান মানুষদের তুলনায় বেশি। ত্রিশ হাজার বছর আগে আমাদের ব্রেইনের আকারও বড় ছিলো।
নিয়ান্ডারথালরা তাদের বুদ্ধি দিয়ে বিভিন্ন অস্ত্র, যেমন- বর্শা, কুড়াল বানাতে পারতো। তিন লক্ষ বছর আগে নিয়ান্ডরথালরা লিভালইস টেকনিক নামক পাথুরে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। তারা জীবজন্তুর হাড় দিয়ে প্রয়োজনীয় অস্ত্র বানাতো। এটা প্রমাণ করে যে, তারা প্রয়োজনের সময় নিজেদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র বানিয়ে নিতে পারতো। তারা ম্যামথ, বন্য ষাড় এবং হরিণ শিকার করতো। এসব শিকারে তাদের আঘাতের চিহ্ন দেখে বোঝা যায় যে তারা ছিলো দক্ষ শিকারি, বুদ্ধিমান এবং তারা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারতো। দুই লক্ষ বছর আগে নিয়ান্ডারথালা আগুন জ্বালাতে শিখে যায়।
বিরুপ আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য আগুন তাদের খুবই দরকার ছিলো। নিয়ান্ডারথালরা গুহায় বসবাস করতো। তারা যেহেতু ঠান্ডা আবহাওয়ায় বাস করতো তাই তাদের শরীর গরম রাখা দরকার ছিলো। এজন্য তারা বিভিন্ন পশুর চামড়া পরিধান করতো। তবে তাদের পোশাক সেলাই করা ছিলো কি না তার প্রমাণ পাননি গবেষকরা। নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি ছিলো। নিয়ান্ডারথালদের গুহা খনন করে দেখা গেছে যে তারা মৃত নিয়ান্ডারথালদের কবর দিতো। শুধু কবরই দিতো না, কবরের আলাদা মার্কার (চিহ্ন) দিয়ে রাখতো। কবরে ফুল ছিটিয়েও দিতো তারা।
নিয়ান্ডারথালরা যা খেতো
নিয়ান্ডারথালরা খুবই বিরুপ ঠান্ডা পরিবেশে থাকতো। তবু তারা শিকারে খুবই পারদর্শী ছিলো। বিভিন্ন প্রাণী শিকার করে খেতো তারা।
মূলত মাংশাসী হলেও তাদের দাঁতে লেগে থাকা বিভিন্ন লতাপাতার উপস্থিতি প্রমাণ করে যে তারা লতাপাতাও খেতো। হয়তো এ লতাপাতা তারা নিজেরাই সংগ্রহ করতো অথবা তারা যে তৃণভোজী প্রাণীদের মাংস খেতো তাদের পেটের মধ্যকার পাতা। এছাড়া তারা বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাকও খেতো। তারা ঝিনুক, সিল মাছ এবং ডলফিনও খেতো। এসব সিল বা ডলফিন সরাসরি শিকার করতে না পারলেও মৃত সিল বা ডলফিনের মাংস খেতো তারা। জিব্রাল্টারের ভ্যানগার্ড গুহা থেকে সিল মাছের চোয়াল উদ্ধার করা হয়। গবেষকরা সে চোয়াল গবেষণা করে দেখেছেন যে নিয়ান্ডারথালরা খাবারের জন্য সমুদ্রের প্রাণীদের উপরও নির্ভরশীল ছিলো। যদিও নিয়ান্ডারথালরা আগুন জ্বালাতে জানতো, তবুও তারা প্রতিদিন তাদের খাবার রান্না করে খেতো কি না সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হয়নি এখনো।
নিয়ান্ডারথালা কি কথা বলতে পারতো?
নিয়ান্ডারথালরা কথা বলতে পারতো কি না সেটি নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। কারন কথা বলার জন্য স্বরযন্ত্রে যে টিস্যু থাকে নিয়ান্ডারথালদের সে টিস্যু সংরক্ষণ করা যায়নি। তবে মুখের গঠন এবং কানের হাড় ধারণা দেয় যে আধুনিক মানুষের মতো তারা শ্রবণে সক্ষম ছিলো। বর্তমান সময়ে এসে গবেষকরা দেখেছেন যে, তাদের সামাজিক জীবন খুবই জটিল ছিলো এবং নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলতে পারতো। তবে তাদের ভাষা ছিলো একেবারেই সাদামাটা ধরনের।
নিয়ান্ডারথালদের শিল্পকর্ম
নিয়ান্ডারথালরা শুধু শিকারের নানা পদ্ধতিই আয়ত্ত্ব করেছিলো না। তারা দেয়ালে আঁকতেও শিখেছিলো। ২০১৮ সালে গবেষকরা স্পেনের তিনটি গুহাচিত্র গবেষণা করে দেখেন যে, সেগুলো আঁকা হয়েছিলো প্রায় ৬৪ হাজার বছর আগে। যে সময় ইউরোপে আধুনিক মানুষের আবির্ভাবই ঘটেনি। অর্থাৎ এটা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে আধুনিক মানুষের আগেই নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে শিল্পচেতনা বিকশিত হয়েছিলো।
এই গুহাচিত্র সম্পর্কে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটনের প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্রিস স্টান্ডিশ বলেন, এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে যতগুলো গুহাচিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন গুহাচিত্রের একটি হচ্ছে এই গুহাচিত্র। আধুনিক মানুষ ইউরোপে আসার দুই হাজার বছর আগেই এটি আঁকা হয়েছিলো।’ অর্থাৎ নিয়ান্ডারথালা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ চিত্র আঁকতো। এ ধরনের চিত্র তারা হুট করে আঁকেনি। এই গুহাচিত্র ছিলো তাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ।
তারা শুধু আঁকতেই জানতো না, তারা বিভিন্ন গয়নাও তৈরি করতে জানতো। তাদের বেশ কিছু গয়না তৈরি হতো ঈগলের নখ দিয়ে। এগুলো তারা নেকলেস বা ব্রেসলেট হিসেবে পড়তো। তাদের যে কয়টি গয়নার সন্ধান পাওয়া গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন গয়নাটি তৈরি হয়েছিলো ১ লক্ষ ১৩ হাজার বছর আগে। ফ্রান্সের গ্রোট ডু রেন গুহা থেকে বিভিন্ন প্রাণীর বিশেষ করে হাতির দাঁত পাওয়া গিয়েছে যেগুলো নিয়ান্ডারথালরা সুন্দর গয়নার মতো রুপ দিয়েছিলো। ছদ্মবেশ ধারণ কিংবা সাজানোর জন্য নিয়ান্ডারথালরা তাদের শরীরে বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থ মাখতো।
একসময় ক্যানিবাল হয়ে ওঠে নিয়ান্ডারথালরা
নিজ প্রজাতির মাংস খাওয়াকে ক্যানিবালিজম বলে। একসময় নিয়ান্ডারথালদের মধ্যেও ক্যানিবালিজমের চর্চা ছিলো। নিয়ান্ডারথালরা যে নিজ প্রজাতির মাংস খেতো তার প্রমাণ মিলেছে বেলজিয়ামের গোয়েত গুহা থেকে প্রাপ্ত মানুষের হাড়ে। গবেষকরা সেই গুহা থেকে ৪০ হাজার বছর আগের যে হাড় পেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে সদ্যোজাত বাচ্চা, শিশু, তরুণ এবং বয়স্ক মানুষের হাড়।
এসব হাড় বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন, নিয়ান্ডারথালরা নিজ প্রজাতির মাংস খেতো। এই হাড়গুলো ঠিক সেই সময়ের যে সময় নিয়ান্ডারথালরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে এবং হোমো স্যাপিয়েন্সরা (বর্তমান মানুষ) তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, নিয়ান্ডারথালরা বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলো। ধ্বংসের পথে এসেও তারা তাদের মৃতদেহের দেখভাল করতো এবং দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতো। কিন্তু মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকলে তারা মৃতদেহে খেয়ে ফেলতে শুরু করে।
সম্প্রতি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানী হেলেন রুশিয়ের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক টিম গোয়েত গুহা থেকে প্রাপ্ত নিয়ান্ডারথালদের হাড় নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন। তাদের গবেষণায়ও নরভক্ষণের প্রমাণ মিলেছে।
এ বিষয়ে ক্রিস্টিয়ান ক্যাসিয়াস বলেন, হাড়গুলোতে কেটে ফেলার চিহ্ন রয়েছে। সে হাড় থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। নিয়ান্ডারথালরা হাড়গুলো এমনভাবে ভেঙেছে যেভাবে তারা ঘোড়া এবং হরিণের হাড় ভাঙতো। এমনভাবে মাংস বিচ্ছিন্ন করেছে যেভাবে ঘোড়া এবং হরিণের মাংসা বিচ্ছিন্ন করতো হাড় থেকে। কিন্তু তারা ঠিক কী কারণে নিজেদের মাংস খেতো সেটা এখনো রহস্যের বিষয়।
নিয়ান্ডারথালরা যেভাবে বিলুপ্ত হলো
নিয়ান্ডারথালদের ফসিল এবং প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন গবেষণা করে দেখা যায় যে, নিয়ান্ডারথালরা আজ থেকে প্রায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যদিও আধুনিক অনেক মানুষের মধ্যেও তাদের ডিএনএ রয়ে গেছে। নিয়ান্ডারথালরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এটি একটি জানা ঘটনা, কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বছর বেঁচে থাকার পরও তারা কেন এবং কীভাবে বিলুপ্ত হলো সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের বিলুপ্তির সঠিক কারণ এখনো অজানা। তবে তাদের বিলুপ্তি নিয়ে বেশ কিছু মত প্রচলিত রয়েছে।
কেউ কেউ মনে করেন, তাদের বিলুপ্তির পেছনে আমরা আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষরাই দায়ী। শুরুর দিকের আধুনিক মানুষরা ৪০ বা ৬০ হাজার বছর আগে ইউরোপে আবির্ভূত হতে থাকে। সে সময় হোমো স্যাপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথালরা সহাবস্থানই করতো। কিন্তু হোমো স্যাপিয়েন্সরা তাদের বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে প্রতীকী শিল্পকর্মে উন্নত হতে থাকে। এর ফলে নিয়ান্ডারথাল এবং হোমো স্যাপিয়েন্সদের মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে নিয়ান্ডারথালরা প্রজননের দিকে দিয়ে হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে পিছিয়ে ছিলো। ফলে নিয়ান্ডারথালদের তুলনায় হোমো স্যাপিয়েন্সদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ফলে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় নিয়ান্ডারথালরা হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে পিছিয়ে পড়ে। তাছাড়া হোমো স্যাপিয়েন্সরা তাদের আবাসস্থল দখল করতে শুরু করে। এর ফলে নিয়ান্ডারথালরা বাস্তুচ্যূত হতে থাকে। তবে অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন জেনেটিক্যালি নিয়ান্ডারথালরা হোমো স্যাপিয়েন্সদের থেকে দুর্বল ছিলো। এর ফলে হোমো স্যাপিয়েন্সদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি নিয়ান্ডারথালরা।
অনেকেই আবার নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির পেছনে বিরুপ আবহাওয়াকে দায়ী করেন। নিয়ান্ডারালদের প্রায়শই বিরুপ আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হতো। তারা যে সময়ে যে স্থানে বাস করতো তা ছিলো খুবই ঠান্ডা। তবে ধীরে ধীরে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্রমশ আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটতে থাকার কারণে তারা অভিযোজন করতে অক্ষম হতে শুরু করে। বিরুপ আবহাওয়ার ফলে ১ লক্ষ বছর আগের সময়ে নিয়ান্ডারথালরা খন্ড খন্ড দল উপদলে ভাগ হয়ে যায়। ফলে নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে বংশবৃদ্ধির মাত্রাও অনেকটা কমে যায়। এ কারণেই তাদের সংখ্যাও কমতে থাকে। তবে তাদের সবার বিলুপ্তি একই সাথে ঘটেনি। ধীরে ধীরে তাদের বিলুপ্তি ঘটেছে। এজন্য অনেক গবেষকই মনে করেন দ্রুত পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারার কারণে এবং বিরুপ আবহাওয়ায় নিয়ান্ডারথালদের খাবারের ঘাটতির কারণে তাদের বিলুপ্তি ঘটেছে।
আমরা কি নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি?
২০১০ সালে প্রকাশিত নিয়ান্ডারথাল জিনোমের (পারমাণবিক ডিএনএ এবং জিন) গবেষণায় দেখা গেছে যে, আধুনিক মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালরা যৌন মিলনে লিপ্ত হয়েছিলো, যদিও তা আকারে ছিলো সীমিত। গবেষকরা আধুনিক মানুষের জিনোমকে নিয়ানডারথালের সাথে তুলনা করে আবিষ্কার করেছেন যে আধুনিক মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে ডিএনএ’র বিনিময় ঘটেছিলো।
এ থেকে বোঝা যায় যে, আধুনিক মানুষ আফ্রিকা ছেড়ে যাওয়ার পরে কিন্তু এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে যাওয়ার আগে নিয়ান্ডারথালদের সাথে প্রজনন করেছিল। ৫০ থেকে ৯০ হাজার বছর আগে লেভান্ট নামক স্থানে হোমো স্যাপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথালরা কয়েক হাজার বছর সহাবস্থান করেছিলো। তবে তাদের মধ্যে প্রজননের মাত্রা ছিলো কম। কেন তাদের মধ্যে প্রজননের মাত্রা কম ছিলা তা এখনো গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণেই তাদের মধ্যে প্রজনন কম ঘটতে পারে। ৫০ বছরের মতো সময়কাল আগে যখন হোমো স্যাপিয়েন্সরা নিয়ান্ডারথালদের সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হয় তখন তাদের মধ্যে ডিএনএ’র বিনিময় ঘটতে থাকে।
এভাবে বিনিময় ঘটতে ঘটতে হেমো স্যাপিয়েন্সদের ডিএনএ’র প্রভাব বাড়তে থাকে। কারণ নিয়ান্ডারথালরা তখন মানুষের সাথ টিকে থাকার দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে এবং তারা পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এর ফলে আস্তে আস্তে হোমো স্যাপিয়েন্সদের ডিএনএ একক আধিপত্য বিস্তার করে। তবে নিয়ান্ডারথাল এবং মানুষের মধ্যে প্রজনন হয়েছিলো আফ্রিকার বাইরের এলাকা জুড়ে। এজন্য আফ্রিকার মানুষদের মধ্যে নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএ নেই। আফ্রিকার বাইরের মানুষদের মধ্যে এখনো ৩ শতাংশের মতো ডিএনএ রয়ে গেছে। তবে অনেক গবেষকই মনে করেন, মানুষের মধ্যে নিয়ান্ডালথালদের ডিএনএ’র ১৫-২০ শতাংশ রয়ে গেছে। এজন্য এখনো অনেক মানুষের চেহারার মধ্যেই নিয়ান্ডারথালদের চেহারার ছাপ পাওয়া যায়।