জীবজগতে বেশকিছু পতঙ্গ রয়েছে যেগুলো আমাদের নিয়মিত বিরক্ত করে চলেছে। তাছাড়া নানাবিধ রোগব্যাধির বাহক হিসেবেও কাজ করছে পতঙ্গগুলো। মশা, মাছি, ছারপোকা এই বিরক্তিকর পতঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। সম্ভবত এরা আমাদের ঘুম ও আরাম-আয়েশের প্রধান শত্রু। অর্থাৎ কর্মক্লান্ত শরীর হোক, আর টানা বিশ্রামের মাঝে হোক, যেকোনো সময়েই এরা বিরক্ত করতে পারে। এদের তাড়াতে আমাদের আয়োজনেরও কমতি থাকে না। আমরা সাধারণত মশারী, কয়েল, ধূপ ইত্যাদি দ্বারা এদের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু এসব ছাড়াও প্রকৃতিতে এমন কিছু উদ্ভিদ রয়েছে, যেগুলো বাগান অথবা ঘরে থাকলে এই পতঙ্গগুলো বিরক্ত করতে আসবে না। আজ তেমন কিছু উদ্ভিদ, যারা বিরক্তিকর মশা, মাছির শত্রু, তাদের কথা জানানো হবে।
তুলসী
তুলসী আমাদের সকলের পরিচিত চিরহরিৎ গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশ ও ভারতের প্রায় সর্বত্রই এই উদ্ভিদের দেখা মেলে।
এই গাছ কীটপতঙ্গ নিবারক হিসেবে খুবই কার্যকরী। এর ঝাঁঝালো গন্ধের কারণে মশা ও মাছি কাছেই আসতে পারে না। তাই বিরক্তিকর মশা, মাছি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে টবে অথবা বাগানের মাটিতে লাগাতে পারেন গাছটি। বাসার ভিতর রাখলেও বাসা থেকে মশা, মাছি দূরে পালিয়ে যাবে। তাছাড়া অবসরে, নিরিবিলি পরিবেশে বা বাগানে বসে বই পড়ার সময় পাশে তুলসি গাছ থাকলে বই পড়ায় আনন্দ পাবেন। কারণ এ সময় কোনো পতঙ্গ আপনাকে বিরক্ত করবে না।
মশা, মাছি তাড়াতে তুলসি পাতার স্প্রে-ও ব্যবহার করা হয়। স্প্রে তৈরির জন্য প্রথমে একটি পাত্রে ৪ আউন্স পরিমাণ গরম পানি নিতে হবে। সেখানে ৪ থেকে ৬ আউন্স পরিমাণ পরিষ্কার, তাজা তুলসি পাতা দিয়ে কয়েক ঘন্টা রেখে দিতে হবে। তারপর তুলসি পাতা চিপে জলীয় অংশ বের করে নিতে হবে। সবশেষে ৪ আউন্স পরিমাণ ভদকা মিশিয়ে ফ্রীজে রাখলেই তৈরি হয়ে যায় মশা, মাছি তাড়ানোর প্রাকৃতিক স্প্রে।
এই স্প্রে ব্যবহারের সময় কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। চোখ, মুখ ও নাকে যেন স্প্রে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে স্প্রে করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
ল্যাভেন্ডার
ল্যাভেন্ডার এক প্রকার সুগন্ধিযুক্ত উদ্ভিদ। শত শত বছর ধরে গৃহস্থালীর কাপড় পরিষ্কারের পর ড্রয়ারে রাখার জন্য এই উদ্ভিদ ব্যবহার করা হচ্ছে। এই উদ্ভিদ মথ, মাছি এবং মশাদের তাড়াতে খুবই সহায়ক। ঘরে এই উদ্ভিদের ফুলের তোড়া রেখে দিলে মশা, মাছি আসতে পারে না। এই উদ্ভিদ মশার ঘ্রাণশক্তিকে বাধাগ্রস্ত করে।
মশা তাড়ানোর জন্য এই গাছের তেলও ব্যবহার করা হয়। শরীরের অনাবৃত অংশ, যেমন হাত, পা, মুখে এই তেল লাগালে মশা কামড়াবে না। তবে ঘরে খরগোশ পুষলে এই উদ্ভিদ ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ এই উদ্ভিদের সুগন্ধ খরগোশেরও অপছন্দনীয়।
লেমন গ্রাস
লেমন গ্রাস উদ্ভিদটির সাথে অনেকেই হয়তো পরিচিত নন। কিন্তু রেস্তোরাঁয় খাবারকে সুগন্ধময় করতে এটি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। রান্নায় ব্যবহার ছাড়াও এই গাছটি মশা তাড়াতে ব্যবহার করা যায়।
লেমন গাছ থেকে প্রাপ্ত সাইট্রোনেলা তেল মশাকে দূরে রাখে। তবে এই গাছ যেখানে প্রচুর মশার উপদ্রব আছে সেখানে তেমন কার্যকর নয়। তাই প্রচুর পরিমাণে লাগাতে হয়। এছাড়াও লেমন গ্রাস স্প্রে হিসেবে ব্যবহার করেও মশা তাড়ানো যাবে। এজন্য একটি পাত্রে কিছু পানি ও লেমন গ্রাস নিয়ে সিদ্ধ করতে হবে। যখন পানির বর্ণ হলুদ হবে, তখন তা নামিয়ে সারারাত ঢেকে রাখতে হবে। অতঃপর মিশ্রণটি স্প্রে হিসেবে ব্যবহার করে মশা তাড়ানো যাবে।
পুদিনা
পুদিনা মধ্যযুগীয় সময়কাল থেকেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ হিসাবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। মানুষ এটিকে ঘরের আবহাওয়া তাজা ও সুগন্ধময় করতে ব্যবহার করতো। অষ্টাদশ শতক থেকে এটি ঔষধি গাছ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তাছাড়া এটি মশা, মাছি এবং পিঁপড়াকে তাড়াতে সক্ষম। এই উদ্ভিদকে অবিষাক্ত পতঙ্গ প্রতিরোধক বলা হয়।
কুকুর, বিড়ালকে বাসার বাইরে মশা, মাছির উপদ্রব থেকে বাঁচাতে পুদিনা পাতা চূর্ণ করে তেল সংগ্রহ করে প্রাণীর শরীরে লাগিয়ে দিলেই মশা, মাছি থেকে মুক্ত থাকবে। তবে পুদিনা গাছ বাগানে না লাগিয়ে টবে লাগানো উচিত। কারণ এই গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও বাগানের সর্বত্রই ছড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে বাগান থেকে সরানো কঠিন হয়ে যেতে পারে।
গাঁদা ফুল
গাঁদা ফুলের গাছ ও ফুল সকলের নিকট অতি পরিচিত। বিভিন্ন উৎসব ও বিশেষ বিশেষ দিবসে এই ফুলের ব্যবহার লক্ষণীয়।
তবে এই ফুলকে আরেকটি কাজে ব্যবহার করা যায়। যদি কোথাও মশার উপদ্রব বেড়ে যায় তবে এই ফুল গাছের টব সেখানে রাখলে মশা পালিয়ে যাবেই। সুতরাং ঘরের বিভিন্ন খোলা স্থান, যেমন দরজা, জানালা ইত্যাদির পাশে টব রেখে দিতে পারেন। যারা ঘরে খরগোশ পোষেন তাদের জন্য গাঁদা ফুল না রাখাই ভালো হবে। কারণ গাঁদা ফুলের গন্ধ খরগোশের বেশ অপছন্দের। মশা তাড়ানো ছাড়াও টমেটো গাছে আক্রমণকারী বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ, জাবপোকা ইত্যাদিও তাড়ায় এই ফুল। সুতরাং টমেটো চাষ করলে তার আশপাশেও এই ফুল গাছ লাগানো যায়। তাহলে টমেটোর ফলন বৃদ্ধি পাবে।
রোজমেরি
রোজমেরি এক ধরনের সুগন্ধিযুক্ত গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। মূলত খাবারের সুগন্ধ বৃদ্ধির জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। খাবারের সুগন্ধ বৃদ্ধি করা ছাড়াও এর বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার রয়েছে। রোজমেরির সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যবহার মশা তাড়ানোর ক্ষেত্রে। অন্যান্য প্রাকৃতিক মশা প্রতিরোধক উদ্ভিদের চেয়ে এটি একটু বেশিই কার্যকর। জীবন্ত গাছ অথবা ডালপালা, পাতা ইত্যাদি কেটে ঘরে রাখলেই মশা কাছে ভীড়বে না। তবে এর জন্য রোদের প্রয়োজন।
রোজমেরির দ্বারা স্প্রেও তৈরি করা যায়। এজন্য রোজমেরির পাতা নিয়ে তাতে পানি যোগ করে সিদ্ধ করতে হয়। ভালভাবে সিদ্ধ হলে এগুলো পানিসহ নামিয়ে শীতল করে বোতলে ভরে, বোতলের মুখ বন্ধ করে ফ্রীজে রেখে দিলেই তৈরি হয় স্প্রে। পরবর্তীতে ঘরে স্প্রে করলেই মশারা আর জ্বালাতন করবে না।
ক্যাটনিপ
N,N-Diethyl-meta-tolumide (DEET) কে মশা তাড়ানোর রাজা বলা হতো। কিন্তু ‘আমেরিকান ক্যামিকেল সোসাইটি’র বরাত থেকে জানা যায়, ক্যাটনিপ হচ্ছে এই DEET এর চেয়েও ১০ গুণ শক্তিশালী কার্যকর মশা প্রতিরোধক।
ক্যাটনিপে থাকা নিপিটাল্যাকটন নামক রাসায়নিক পদার্থ মশা তাড়াতে ভূমিকা রাখে। মশা তাড়ালেও এই পদার্থটির কারণেই আবার বিড়াল খুবই পছন্দ করে গাছটিকে। বিড়াল এর গন্ধ শোঁকে, চিবায় ও অনেক সময় খায়। এছাড়াও এই উদ্ভিদের ঝোপে বিড়াল শুয়ে থাকে ও গড়াগড়ি করতে পছন্দ করে। সাধারণত নিপিটাল্যাকটনের গন্ধ অনেকটা স্ত্রী বিড়ালের ফেরোমনের মতো। তাই পুরুষ বিড়াল এর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
ফিচার ইমেজ – thelifesquare.com