চোরাশিকার, হাতুড়ে ঔষধ এবং অলংকার: পশুরাজ আজ বিলুপ্তির মুখে

উত্তর আফ্রিকার পাহাড় পর্বতে একসময় সদর্পে চরে বেড়াতো বিশালকায় বারবারি সিংহ। শিকারীদের তান্ডবে ১৯৬০ এর দিকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বারবারি সিংহরা। আজ কেবল গল্পগাঁথায় টিকে আছে দৈত্যাকার পশুগুলো। এভাবেই কালের গর্ভে মিশে গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ সিংহরা। কালচে কেশরের জন্য তাদেরকে অনেকেই কালো সিংহ বলে ডাকতো।

অতীতের মতো এখন আর সিংহ শিকারীদের রমরমা অবস্থা নেই। আগে সিংহ শিকারকে ধরা হতো চরম বীরত্বের নিদর্শন হিসেবে। তবে এখন আইন কানুনের দৌলতে সিংহ শিকারের হার কমেছে। সিংহের চামড়াও বিশেষ মূল্যবান নয়। তবে তাতে করে সিংহদের বিশেষ কোনো লাভ যে হচ্ছে না তা বলাই বাহুল্য। জনবসতি বৃদ্ধির কল্যাণে সিংহের সংখ্যা কমছে আশংকাজনক হারে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে চোরাশিকারীদের দৌরাত্ম্য। আসলে সিংহের সংখ্যা নিশ্চিহ্ন হওয়ার মূল কারণই আজ চোরাশিকার।

চোরাশিকারীদের নজর কেন সিংহের দিকে

সিংহ শিকার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে দুটি। একটি মোটামুটি সবারই জানা। আফ্রিকা আর ভারতে জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। কাজেই সিংহ-মানুষে সংঘর্ষ বাড়ছে। তবে এই ধারা বহু দশক ধরেই চলমান। সংরক্ষিত অঞ্চলগুলোতে কম-বেশি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে মানুষ আর সিংহের সংঘর্ষ এড়াবার জন্য। তবে চোরাই শিকারীদের সিংহের দিকে নজর পড়বার মূল কারণ কিন্তু খুবই অদ্ভুত, এক বিশেষ ধরনের ঔষধ।

পশুর দাঁত আর হাড় দিয়ে বানানো অলংকার; Image Source: TIMES

প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে চীনারা চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছে। আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি গোটা চীন আর পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসার খুবই কদর। আকুপাংচার পদ্ধতির কথা তো আমাদের দেশেই বহুল পরিচিত। এর বাইরেও চীনা এই ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাতে গাছগাছড়াসহ পশু-পাখি বা সরীসৃপের ব্যবহার প্রচলিত আছে। উপাদানের তালিকায় আছে তক্ষক, জোঁক, সাপ, ভাল্লুক, বাঘ, সিংহ আর গণ্ডারের শিং; চোখ কপালে ওঠার মতোই চিকিৎসাশাস্ত্র বটে! বিশেষ করে গন্ডারের শিংয়ের কথা না বললেই নয়। পূর্ব আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গন্ডারের শিং কেজিপ্রতি ১৮,০০০ ডলার দামে বিকোয়। এই শিং নাকি যৌবন পুনরুদ্ধারের অব্যর্থ ঔষধ, ক্যানসারও নাকি সেরে যায় গন্ডারের শিং থেকে বানানো চীনা মহৌষধ খেলে। হাজার হাজার এশীয় কালো ভাল্লুককে খাচাঁয় আটকে রেখে জ্যান্ত অস্ত্রোপচার করে পিত্তরস বের করে নেওয়া হয় এসব ঔষধ বানাবার উদ্দেশ্যে। যদিও প্রচলিত আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র গন্ডারের শিং বা পশুপাখির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপযোগিতাকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়, কিন্তু মানুষ শখ মেটাতে কী না করে! কাজেই চীনা ধনকুবেরদের কাছে এসব বিরল পশুপাখির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে বানানো ঔষধের খুবই কদর।

চীনা ঔষধ; Image Source: Youtube

সাহস, শক্তি আর হিংস্রতার জন্য বাঘ-সিংহ বিশেষ পরিচিত। মানুষ বিরাট এই জানোয়ারগুলোকে ভয় পায়, শ্রদ্ধাও করে। অনেকেই বিশ্বাস করে, এদের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাছে রাখলে বিপদ-আপদ হবে না, সাহস বাড়বে। হিমালয়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকা; সব জায়গাতেই এই লোকজ বিশ্বাস অল্পবিস্তর বর্তমান। কাজেই চোরাশিকারীদের হাতে মৃত সিংহের দাঁত আর নখ দিয়ে বানানো হচ্ছে সুস্বাদু মদ, ঔষধ আর অলংকার। সিংহের মতোই রাজকীয় শক্তি-সাহসের লোভে বা নেহাত জৌলুষ দেখানোর নেশায় মানুষ কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছে এসবের পেছনে। ঔষধের পাশাপাশি এই বিদঘুটে ফ্যাশনও সিংহের বিলুপ্তির পেছনে দায়ী।

আর এ কারণেই বাড়ছে চোরাশিকার। পশুপাখি পাচার করা অনেক পুরনো পেশা। ইউরোপ, আমেরিকা আর জাপানে পশুর চামড়া আর পশম দিয়ে বানানো পোশাকের নেশার বলি হয়ে অনেক বিরল প্রজাতি লোপ পেয়েছে। সত্তর আর আশির দশকের দিকে এই সংক্রান্ত আইন কানুনের প্রভাবে কতকটা, আর কতকটা মূল্যবোধগত পরিবর্তনের কারণে পশ্চিমা বিশ্বের বাজার সংকুচিত হয়ে আসে। কিন্তু নয়া চীন তার জাঁকালো অর্থনীতি নিয়ে জেগে ওঠার সাথে সাথে সেখানকার এসব ঔষধের ক্রেতারা হাত বাড়াতে থাকে আফ্রিকা আর এশিয়ার দুর্লভ এই প্রাণীগুলোর দিকে। বাড়তে থাকে চোরাশিকার।

চোরাশিকারের হালচাল

কী ভয়াবহ আকারে এই শিকার বাড়ছে তা কয়েকটি উপাত্ত দিলেই পরিষ্কার হবে। গত চল্লিশ বছরে গণ্ডারের সংখ্যা কমেছে ৯০ ভাগ। বাঘের চোখ আর পুরুষাঙ্গের চাহিদা মেটাতে গিয়ে মায়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার বাঘ উজাড় হয়ে গিয়েছে। ভারতে বাঘেরা টিকে গিয়েছে কড়া কড়া সব ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে, কিন্তু তাতে করে চোরাশিকার কমেনি। বাঘের চাহিদা মেটানো হচ্ছে চিতাবাঘ, এশীয় সোনালি বেড়াল আর আমচিতা শিকার করে। আর শেষমেষ এর বলি হচ্ছে আফ্রিকার সিংহরা।

চোরাশিকারী ও বনরক্ষী; Image Source: African Independent

আফ্রিকার সিংহদের দিকে চোরাশিকারীদের নজর পড়ার কিছু কারণ আছে। এশিয়ার তুলনায় আফ্রিকার বনাঞ্চল অনেক বেশি বিস্তৃত, সমৃদ্ধ। কাজেই সিংহের সংখ্যাও বেশি। আফ্রিকার দেশগুলোর সিংহ সংরক্ষণের ব্যবস্থাও তুলনামূলকভাবে দুর্বল। ফলে বাঘের প্রাপ্যতা কমার সাথে সাথে বাজারে কদর বাড়ছে সিংহের। তাছাড়া বাঘ বাস করে ঘন জঙ্গলে, একাকীই কাটে তার জীবনের অনেকটা সময়। বাঘ শিকারও করে মূলত রাত্রে। সেই তুলনায় সাভানার ফাঁকা প্রান্তরে যুথবদ্ধ সিংহ খুঁজে পাওয়া সহজ। শিকারীরা সিংহের চার পায়ের থাবা আর মুখ কেটে নিয়ে যায়। একটি সিংহ মারলে লাভ হয় প্রায় দুই হাজার ডলার। নৃশংস এই কাজ করার জন্য ব্যবহার করা হয় বিষ। সিংহেরা দলবদ্ধ হয়ে ঘোরে, আর এলাকাও তাদের নির্দিষ্ট। বিষ মাখানো টোপ দিয়ে তাই সিংহ শিকার করা অনেক সহজ। সিংহের দাঁত দিয়ে বানানো হচ্ছে অলংকার আর ঔষধ।

বিষ মাখানো মাংস খেয়ে মৃত শকুন; Image Source: WWF

আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্বের দেশগুলো; জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক আর দক্ষিণ আফ্রিকাতে তাই সিংহ চোরাশিকারীদের রমরমা অবস্থা। গত ১০০ বছরে আফ্রিকার সিংহের সংখ্যা দুই লক্ষ থেকে কমে হাজার বিশেকে এসে ঠেকেছে। মোজাম্বিকের অবস্থা বোধহয় সবথেকে করুণ। দেশটির এগারো লক্ষ হেক্টরের সুবিপুল লিম্পোপো ন্যাশনাল পার্কে গত ৫ বছরে সিংহের সংখ্যা ৬৬ থেকে ২১ এ এসে নেমেছে। গবেষকদের আশংকা, এই গতিতে চললে ২০৫০ এর মধ্যেই আফ্রিকার বনভূমিতে আর সিংহের দেখা মিলবে না।

সমাধান নিয়ে বিতর্ক

চোরাশিকার কমাবার জন্য যে বাড়তি লোকবল, প্রযুক্তি আর অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন সে কথা জানে সবাই। আফ্রিকার দেশগুলো সীমিত আকারে সিংহ শিকারের লাইসেন্স দেয়। তাছাড়া সিংহ পর্যটনশিল্পের জন্যও খুব লাভজনক। ফলে সিংহ চোরাশিকার কমাবার জন্য অনেক দেশই বেশ নড়েচড়ে বসেছে। তবে অন্তত এখন পর্যন্ত এইমসব নয়া প্রয়াস বিশেষ কোন সুফল বয়ে আনেনি। বন্য সিংহের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। বেশিরভাগ চোরাশিকারীই বাস করে ন্যাশনাল পার্কগুলোর আশেপাশের গ্রামে। তারা অঞ্চলটা চেনে। আফ্রিকার দরিদ্র এসব মানুষের কাছে চোরাশিকার বেশ লাভজনক পেশা। এদের বিপরীতে যারা বনরক্ষীর ভূমিকায় নিয়োজিত, তাদের অনেকের কাছে একটি আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত থাকে না। বিকল্প কর্মসংস্থানসহ বড় ধরনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন ছাড়া সিংহ বাঁচাবার আসলে কোনো উপায় নেই। 

বনরক্ষীদেরকে দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ আর অস্ত্রশস্ত্র; Image Source: WWF

অনেকে মনে করেন, পূর্ব এশিয়ার মানুষকে এই সর্বনাশা অভ্যাস থেকে বের করে আনা সম্ভব হবে না। এর থেকে সিংহের খামার বানিয়ে বরং রফতানি করাটা ভাল। এই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই বছরে প্রায় আটশত সিংহ রফতানি হয়। তবে ইসব খামার দিয়ে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। এছাড়া বন্যপশু অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলির কাছে নৈতিকভাবে এই সিংহ খামার দেওয়াটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এই পরিস্থিতিতে যখন প্রকৃত সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে গোলমাল চলছে, তখন আফ্রিকার চোরাশিকারীরা বিষ আর বন্দুক ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে পশুরাজদেরকে লোপাট করে দিচ্ছে।

পরিশেষে

সিংহ হাজার হলেও বনের পশু। তাকে মারতে গেলে কিছু দুর্ঘটনা তো ঘটবেই। এই কিছুদিন আগেও দক্ষিণ আফ্রিকায় বনরক্ষীরা দুটি গলিত শবদেহ পায়। পাশেই ছিল শক্তিশালী রাইফেল, কুঠার এবং অন্যান্য জিনিসপত্র। ঘটনা আর কিছুই না, চোরাশিকারীদের একটি দলের ওপরে কোনো একদল সাহসী সিংহ হামলা চালিয়ে তাদেরকে মেরে ফেলেছে। তবে এমন ঘটনা নিত্য ঘটে না।

হুমকির মুখে সিংহদের ভবিষ্যত; Image Source: WWF

আফ্রিকার সিংহদের সামনে এখন নানা বিপদ। যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে উত্তর আর পশ্চিম আফ্রিকার সিংহরা একরকম লোপাট হয়ে গিয়েছে। পূর্ব আর দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের ঘাঁটিগুলিতে চোরাশিকারীদের উপদ্রব দ্রুত বাড়ছে। এদিকে এর সাথে সাথে সরকার থেকে প্রদত্ত লাইসেন্স কিনে পশ্চিমা ধনকুবেরদের শখের সিংহ শিকার তো চলছেই। এভাবে চললে পশুরাজকে তার নিরাপত্তার জন্যেই খাচাঁয় আটকে রাখতে হবে যেটা কি না কারো কাম্য নয়। মানুষের ট্যাঁকের জোরের বিরুদ্ধে প্রকৃতিতে টিকে থাকবার এই সংগ্রাম কতদিন চলবে তা নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য অনুমান ও করা যাচ্ছে না।

This is an article in Bengali which explores the practise of poaching and it's adversarial effect on African lion population.

Feature Image: TIMES

Related Articles

Exit mobile version