মানুষের আশ্বর্য মনের বিচিত্র কারসাজির কি কোনো শেষ আছে? মনের বিচিত্রতার দারুণ সব উদাহরণ এর আগে আমরা দেখেছি স্টকহোম সিনড্রোম লেখাটিতে। দেখেছি কিভাবে সারাজীবনের জন্যে মানুষের মন আবদ্ধ হয়ে যেতে পারে তারই ওপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচারকারীর সাথে। দেখেছি সময়ের সাথে সাথে কিভাবে ঘুরে ফিরে এসে বাধা পরে মানুষের মন একই জায়গাতে। চলুন আজ এরকম আর কিছু মনের বিচিত্রতার গল্প শোনা যাক।
এর আগে স্টকহোম সিনড্রোমের কথা বলেছি, যখন ভিকটিম নিজেই তার অপরাধীর প্রতি সহানুভূতিশীল, আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। এখন এর সাথেই সম্পর্কিত আরেকটা মনের আজব পালাবদলের কথা দিয়ে শুরু করি। ভাবুন যদি উল্টোটা হয়! ধরুন, কেউ কাউকে মারতে গেলো, কিন্তু মারতে গিয়ে খুনি নিজেই হয়ে দাঁড়ালো শিকারের সামনে তাকে রক্ষার ঢাল। মনে করুন, শিকারী নিজেই নিজের শিকারের সাথে সহানুভূতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলো, তার শিকারকেই বিশ্বাস করতে শুরু করলো সবচেয়ে বেশি। কী বলা হবে তখন তার মনের এই অবস্থাকে? মনোবিজ্ঞানের ভাষায় অপরাধীর মনের এই পালাবদলের নাম লিমা সিনড্রোম (Lima Syndrome)।
অপরাধীর মনের এই অবস্থার নামকরণ Lima Syndrome করা হয় ১৯৯৬ সালের একটা ঘটনার পরে। পেরুর লিমাতে অবস্থিত জাপানিজ অ্যাম্বাসিতে ১৯৯৬ সালে একটা অপহরণের ঘটনা ঘটে। সেখানে সামরিক অভ্যুথানের সময় সেনা সদস্যরা প্রায় শ’খানেক মানুষকে বন্দি করে যারা সেখানে এসেছিলো একটা পার্টিতে যোগ দিতে। জিম্মি করার কয়েক ঘন্টা পরই সেনা সদস্যরা বন্দিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে তারা তাদের মুক্তি দিতে শুরু করে। এই সহানুভূতি থেকে এক পর্যায়ে তারা তাদের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বন্দীকে পর্যন্ত মুক্ত করে দেয়। শিকারের প্রতি শিকারীর এই আজব সহানভূতির ঘটনা তারপর থেকে Lima Syndrome নামে মনের ওপর পড়াশুনার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় শুরু করে ।
স্থান-কাল-পাত্রভেদে আজব আরো কিছু মনের আবেগ, ভয়, কষ্টের কথা বলছি এখন।
ট্রিসকাইডেকাফোবিয়া (Triskaidekafobia)
বলুন তো আপনার লাকি নাম্বার কোনটি? অনেকের অনেক রকম হতে পারে, শুধু ১৩ ছাড়া। ১৩ সংখ্যাটিকে ভয় পাওয়ার এই ডিসঅর্ডারকে বলা হয় ট্রিসকাইডেকাফোবিয়া। এই ভয়ের শিকড় পোতা থাকে সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে। যেমন- অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন বিদেশী সিনেমা বা বইগুলোতে দেখা যায় ১৩ সংখ্যাটিকে শয়তানের সংখ্যা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এভাবে সংখ্যার প্রতি এই ভয়টা মাথা তুলতে থাকে মানুষের মধ্যে। একইভাবে চীন, জাপান, কোরিয়াতে ৪ সংখ্যা নিয়ে এমন ভয় প্রচলিত আছে যাকে বলা হয় টেট্রাফোবিয়া।
এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম (Alien Hand Syndrome)
এই অবস্থায় ব্যক্তির হাত নিজে যা চায় তা- ই করতে শুরু করে। এটা একটা নিউরোলজিক্যাল সমস্যা যখন মনে হয় হাত আর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে নেই এবং হাত তার নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতে শুরু করেছে। তখন সেই এলিয়েন হাত কারোর কন্ট্রোল ছাড়াই বোতাম খোলা, কাপড় সরানো বা জিনিসপত্র ভাঙ্গার মতো কাজ করতে থাকে।
ক্লেপটোম্যানিয়া (Kleptomania)
প্রায়ই শোনা যায় এই ডিসঅর্ডারের কথা। এমনকি বিখ্যাত সব মানুষদের ক্ষেত্রেও। ক্লেপটোমানিয়া এমন একটা ডিসঅর্ডার যেখানে মানুষ নিজেই নিজের কাছে বাধ্য হয় যেকোনো কিছু চুরি করতে। চুরি করা জিনিসটা সামান্য পেপার ক্লিপ, টয়লেট রোল থেকে শুরু করে যেকোনো কিছুই হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা সময় পার হওয়ার আগে রোগী বুঝতেও পারে না যে সে চুরি করেছে।
কোটার্ড’স সিনড্রোম- জীবন্ত মৃত অবস্থা (Cotard or Cotard’s syndrome – the living dead)
কোনো মানুষ আর যে সিনড্রোমেই হোক অন্তত এটাতে ভুগতে চাইবে না কখনো। বোধহয় এটাই সবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কষ্টদায়ক মানসিক সিনড্রোম। এক্ষেত্রে রোগী ভাবতে থাকে সে মৃত, অস্বিস্তহীন। এমনকি সে ভাবতে পারে নিজেকে রক্তশূন্য বা অভ্যন্তরীন অঙ্গহীন। প্রথম এই রোগ শনাক্ত করা হয় ১৮৮০ সালে। জুলেস কোটার্ড নামের একজন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ এটি শনাক্ত করেন, যদিও ২০০৭ সাল পর্যন্ত এর কোনো বৈজ্ঞানিক সমর্থন ছিল না।
বাইজোরেক্সিয়া (Bigorexia)
ফাইভ প্যাক, সিক্স প্যাক, এইট প্যাক- মানুষের নিজের শরীর নিয়ে এখন কতো পরিকল্পনা ! পৃথিবীর বুকে এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষের যখন তিন বেলা অন্নের নিশ্চয়তা নেই, তখন অন্যদিকে কিছু মানুষ পানির মতো টাকা ঢেলে যাচ্ছে নিজের শরীরের কাঠামো পরিবর্তনের জন্য। বাইজোরেক্সিয়া এমন একটা মানসিক সমস্যা যখন ব্যক্তি মনে করতে থাকে সে যথেষ্ট সুঠামদেহী না এবং এটা নিয়ে বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা জিমে সময় কাটানো, বারবার আয়না দেখা, জিম একদিন মিস করলে হতাশ হয়ে পড়া, এমনকি তার জন্য কাজ বা সম্পর্ককে অবহেলা করা- এগুলো সবই রোগীকে আরও বেশি তার বদ্ধ সংস্কারের দিকে নিয়ে যায়।
এরগোফোবিয়া (Ergophobia)
কাজ করতে ভালো লাগে না? কিংবা ভয় লাগে কর্মস্থলে যেতে? বসের সামনে অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে পড়েন? এগুলোও এক ধরনের ফোবিয়ার মধ্যে পড়ে। সবচেয়ে সচরাচর দেখা যাওয়া এই ফোবিয়ার নাম এরগোফোবিয়া। এর মধ্যে পড়তে পারে বাচ্চাদের অতিরিক্ত স্কুলভীতিও। গবেষকদের মতে- এই ভয়টা আসলে আরো অনেক ভয়ের সমন্বয়ে মানুষের মনে তৈরী হয়, তার মধ্যে আছে কাজে ব্যর্থ হওয়ার ভয়, সমাজের আতংক আর মানুষের কথা শোনার ভয়।
ডিসাইডোফোবিয়া (Decidofobia)
চোখ মেলে তাকালেই চারপাশে দেখতে পাবেন এমন কিছু মানুষকে কোনো বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাদের জন্যে অনেক কঠিন। সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই তারা হয়ে ওঠে বিভ্রান্ত, অস্থির, এমনকি আতংকিতও। মনের এই অসহায় অবস্থাটার নাম ডিসাইডোফোবিয়া। এরগোফবিয়া এবং ডিসাইডোফোবিয়া সমাজে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই সচরাচর দেখা যায়। কিন্তু এটাও যে এক ধরনের মানসিক দুর্বলতা সেটাই বা আমরা কয়জন জানি!
কলরোফোবিয়া (Coulrofobia)
কখনো কোনো বাচ্চাকে হাসাতে যেয়ে কাঁদিয়ে ফেলেছেন? বিশেষত বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যাওয়া ক্লাউনদের প্রতি এই ভয়কে বলা হয় কলরোফোবিয়া। ভয়ংকর ক্লাউনের এই থিমটা প্রায়ই ব্যবহৃত হতে দেখা যায় জনপ্রিয় সংস্কৃতির অংশগুলোতে, যেমন ব্যাটম্যান সিনেমার ভিলেন জোকার। এমনকি বড় হবার পরেও এই ভয় অনেকের মধ্যে থেকে যায়। অনেক বিখ্যাত তারকার মধ্যেও এই ফোবিয়া বিদ্যমান। পাইরেটস অব দ্যা ক্যারিবিয়ানের জনি ডেপ আর হ্যারি পটারের ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফও আছেন এই তালিকায়।
ফোবিয়ার গল্প শেষ করি চলুন একটা মজার ফোবিয়ার কথা বলে। পাঠকরা অনেকেই নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছেন কম বয়সে কোনো নায়ক, নায়িকা বা তারকাকে নিয়ে? এই ইচ্ছা যদি আরো বেশি পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে তবে এটাও হয়ে যাবে একটা ফোবিয়া, যার নাম সেলেব্রিফিলিয়া। তাই কোনো তারকাকে নিয়ে বেশি রোমান্টিক চিন্তা করার আগে সাবধান।
আর হ্যাঁ, আপনি যদি পুরোটা পড়ে থাকেন আর ফোবিয়াগুলো নিয়ে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তবে আপনার জন্যেও আছে আরেকটা বিপদবার্তা। বিশ্বাস করতে কঠিন হলেও এটা সত্য যে, ফোবিয়া নিয়েও আছে আরেক ফোবিয়া যার নাম ফোবোফোবিয়া (Phobophobia)। মানুষের মনের বিস্ময়ের আসলেই শেষ নেই।