প্রাণীজগতের অনেক প্রাণী মাঝে মাঝে তাদের দেহের স্বাভাবিক বর্ণের না হয়ে ভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। এই বর্ণ যদিও ক্ষতিকর নয়, তবুও বিরল হওয়ায় তা আমাদের মনে বিস্ময়ের জন্ম দেয়। প্রাণীগুলোর এমন বর্ণের জন্য সাধারণত জেনেটিক মিউটেশনকে দায়ী করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় জন্মানো প্রাণীগুলো প্রকৃতপক্ষে সাদা রঙের হয়ে থাকে। প্রাণীদের ধবল হওয়ার প্রক্রিয়াটি অনেকটা ধবলরোগে আক্রান্ত মানুষের মতোই। আজকের লেখায় জানাবো বিরল কিছু সাদা প্রাণীদের কথা, যারা বর্ণে তাদের স্বজাতি থেকে আলাদা।
বিরল সাদা জিরাফ
জিরাফ আফ্রিকার সমতল ভূমিতে বিচরণ করে বেড়ানো একটি প্রাণী। লম্বা গলা, সমভাবে লম্বা সরু পা এবং ডোরাকাটা বর্ণযুক্ত প্রাণীটি বর্তমান জীবজগতে বেঁচে থাকা সবচেয়ে উঁচু ও বৃহত্তম রোমন্থক প্রাণী। অধিকাংশ জিরাফ তামাটে, সাদা ও হলদে লোম দ্বারা আবৃত থাকে। এদের শরীরে বাদামী বর্ণের বর্গাকার ছোপ ছোপ দাগ থাকে। এই ছোপগুলো আবার প্রতিটি জিরাফের ক্ষেত্রে আলাদা। জিরাফের ক্ষেত্রে আরেকটি অদ্ভুত তথ্য হচ্ছে এদের জিহ্বার বর্ণ কিন্তু নীল।
স্বাভাবিকভাবে ছোপযুক্ত জিরাফের দেখা মিললেও কেনিয়ায় প্রাণী সংরক্ষণবিদরা প্রথম এক জোড়া সম্পূর্ণ সাদা বর্ণের জিরাফের দেখা পান। জিরাফগুলো জেনেটিক বা বংশগত কিছু সমস্যার কারণে সাদা বর্ণের হয়। সাদা বর্ণযুক্ত হওয়াকে লিউসিজম (Leucism) বলে। লিউসিজম প্রক্রিয়ার ফলে ত্বকের স্বাভাবিক বর্ণ তৈরিকরণ প্রক্রিয়া আংশিক ব্যাহত হয়।অ্যালবিনিজমের বিপরীতে লিউসিজম প্রক্রিয়ায় কোমল টিস্যু বা কলাগুলোতে কালো বর্ণ তৈরি হয়। এ কারণে সাদা জিরাফগুলোর চোখের বর্ণ ছিল কালো। এছাড়াও অ্যালবিনিজম প্রক্রিয়ায় অ্যালবিনো বা সাদা বর্ণ হওয়ার বিষয়টি মূলত মেলানিনের উপস্থিতি থাকা না থাকার উপর নির্ভরশীল।
সাদা সিংহ
সিংহ বৃহত্তম ও অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বিড়াল জাতীয় প্রাণী। আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় বিড়াল হচ্ছে এরাই। সাধারণত পুরুষ সিংহের মুখের চারপাশে কেশর থাকে। স্ত্রী সিংহের কোনো কেশর নেই। বিড়াল জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে এরাই একমাত্র প্রাণী, যাদের পুরুষ ও স্ত্রী দেখতে ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
সিংহ সাধারণত স্বর্ণকেশী কেশর ও তামাটে বা সোনালী বর্ণের লোম দ্বারা আবৃত থাকে। এছাড়াও এরা লালচে, বাদামী, কালচে লোমযুক্ত হতে পারে। কিন্তু সাদা বর্ণের সিংহের অস্তিত্ব কি আদৌ আছে?
শত শত বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার টিম্বাভাটি অঞ্চলে সাদা বর্ণের সিংহের অস্তিত্বের কথা জানা যেত সেখানকার লোককথা বা উপকথায়। প্রচলিত লোককথা ছিল সাদা সিংহ হচ্ছে সূর্য দেবতার সন্তান। সেগুলোকে ঐশ্বরিক উপহার হিসেবে মনে করা হতো। প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে রানী নাম্বির শাসনামলে আকাশ থেকে পতিত হওয়া তারা থেকে জন্ম হয়েছিল সাদা সিংহের।
লোককথায় প্রচলিত, এই সাদা সিংহ প্রথম বাস্তবে দেখা মেলে ১৯৩৮ সালে সেই টিম্বাভাটিতেই। ১৯৭৫ সালে দুটি সাদা বর্ণের সিংহ বন্য পরিবেশ থেকে প্রিটোরিয়া জাতীয় চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়েছিল। তবে এই সাদা হওয়ার পিছনে কোনো তারার অবদান নেই। সিংহটির সাদা হওয়ার প্রক্রিয়াটিও হচ্ছে লিউসিজম। জীন প্রচ্ছন্নতার জন্য সাদা বর্ণের সিংহের জন্ম হয়েছে। বর্তমানে আনুমানিক আবদ্ধাবস্থায় ৩০০ সাদা সিংহ জন্মানো হয়েছে, যেগুলো আবার বন্য পরিবেশে বসবাসের উপযোগীও হয়েছে।
উত্তর আমেরিকার সাদা মহিষ
সাধারণত উত্তর আমেরিকার বন্য মহিষ বা বাইসন দেখতে হালকা থেকে গাঢ় বাদামী বর্ণের হয়। কিন্তু সেখানকার অাদিম অধিবাসী কর্তৃক পবিত্রতা ও একতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে এক প্রকার মহিষকে বিবেচনা করা হয়, যেগুলো সাদা বর্ণের।
সাদা মহিষকে নিয়ে কথিত আছে, খাদ্যাভাবে ল্যাকোটা সিউক্স এর দুজন লোক দক্ষিণ ডাকোটার কালো পাহাড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে বের হন। সেখানে সাদা কাপড় পরিহিতা এক সুন্দরী নারী তাদের সামনে আসেন। সেই নারী তাদেরকে ধর্মীয় রীতিনীতি শিক্ষা দেন। অতঃপর তিনি মাটিতে চারবার গড়িয়ে যান। গড়িয়ে যাওয়ার পর সেখানে একটা সাদা মহিষের বাচ্চার জন্ম হয়। নারীটি চলে যায়, কিন্তু সাদা মহিষ পৃথিবীতে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে।
আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের মতে, প্রথম সাদা মহিষের দেখা মিলেছিল ১৮৩৩ সালে। এর কয়েক যুগ পরে এই সাদা মহিষের সংখ্যা আরো কিছু বৃদ্ধি পায়। সাধারণত প্রতি এক কোটি মহিষের মাঝে একটি সাদা মহিষের জন্ম হয়। এই সাদা মহিষের জন্মের প্রক্রিয়াটি অ্যালবিনিজমের কারণ নাকি লিউসিজম তা নিয়ে এখনও মতভেদ রয়েছে।
সাদা হাতি
হাতি এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে প্রাপ্ত অতি পরিচিত একটি প্রাণী। প্রাণীটি দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। হাতি দেখতে ধূসর কালো বর্ণের হয়ে থাকে। তবে এদের শরীরের বর্ণ হাতির বিচরণ এলাকার মাটির বর্ণের উপরও নির্ভর করে। কারণ এরা সমগ্র শরীরে মাটি ছিটিয়ে রাখে।
আমরা সাধারণত ধূসর কালো বর্ণের হাতি দেখে অভ্যস্ত হলেও সাদা বর্ণের হাতিরও দেখা পাওয়া যায়। অবশ্য এই হাতি দেখতে চাইলে যেতে হবে সাদা হাতির দেশখ্যাত থাইল্যান্ডে। হাতিগুলো মূলত অ্যালবিনিজমের ফল।
বুদ্ধের জন্মের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় সাদা হাতিকে থাইল্যান্ডে পবিত্র মনে করা হয় এবং সরকারী আইনানুযায়ী, শুধুমাত্র রাজার অধীনে এই হাতি পালিত হতে পারে। সাদা হাতি সম্পর্কে থাইল্যান্ডে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, যে রাজার শাসনামলে বেশি সাদা হাতি দেখা যাবে তার রাজত্ব তত বেশি গৌরবময় ও সমৃদ্ধশালী হবে। সাদা বলা হলেও এটি কিছুটা ফ্যাকাশে সাদা বর্ণের হয়।
প্রচলিত প্রবাদে আছে, কোনো বস্তু যদি অনেক দামী কিন্তু ঝামেলাপূর্ণ হয় তবে তাকে ‘White Elephant’ বলা হয়। কথিত আছে, প্রাচীন থাই রাজতন্ত্রে যদি রাজা কারও প্রতি সন্তুষ্ট হতেন তবে তাকে হাতি ও কিছু জমি উপহার দিতেন। অপরদিকে যদি অসন্তুষ্ট হতেন তবে তাকে সাদা হাতি উপহার দিতেন। রাজকীয় সম্মানের হাতিটিকে দিয়ে কোনো প্রকার কাজ করানো ও বিক্রি করা ছিল অপরাধ। তাই এই হাতিকে পালন করতে গিয়ে উপহার প্রাপ্ত ব্যক্তি দেউলিয়া হতো। তাই উপহারটি দামী হলেও তা ছিল মানুষের কাছে ঝামেলাপূর্ণ ও অনাকাঙ্খিত বস্তু।
সাদা কাঠবিড়ালী
সাদা কাঠবিড়ালী সচরাচর দেখা যায় না। এশিয়া মহাদেশে দুটি সাদা কাঠবিড়ালীর প্রজাতির কথা জানা যায়।
ইলিনয়ের ছোট্ট শহর অলনি সাদা কাঠবিড়ালীর জন্য বিখ্যাত। সাদা কাঠবিড়ালীর উৎপত্তি সম্পর্কে ঠিকভাবে জানা না গেলেও প্রথম দেখা যায় ১৯৪৩ সালে। অলনিতে কাঠবিড়ালীর নিরাপত্তাকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়। কেউ কোনো সাদা কাঠবিড়ালী হত্যা করলে ৭৫০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। তাছাড়াও সেখানে কুকুর প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। সাধারণত অ্যালবিনিজমের কারণে ধূসর সাদা ও লিউসিজমের কারণে পুরোপুরি সাদা বর্ণের কাঠবিড়ালীর জন্ম হয়।
হন্ডুরাসের সাদা বাদুড়
বাদুড় হচ্ছে একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা উড়তে সক্ষম। এরা সাধারণত বাদামী অথবা কালো বর্ণের হয়ে থাকে। কিন্তু এদের ধূসর লাল কিংবা সাদা লোম থাকতে পারে।
বাদুড় বাদামী অথবা কালো বর্ণের হলেও সবচেয়ে সুন্দর বাদুড়টি হচ্ছে হন্ডুরাসের সাদা বাদুড়। সাদা বর্ণের এই বাদুড় আকারে খুবই ছোট। নাকটি পাতার ন্যায় হওয়ায় এর অন্য নাম হচ্ছে Leaf nosed bat। অন্যান্য বাদুড়ের মতো গুহায় থাকে না। বড় বড় পাতার নিচে তাঁবুর ন্যায় বাসা তৈরি করে বাস করে। জেনে রাখা ভাল যে, Ectophylla alba বৈজ্ঞানিক নামের বাদুড়টি কিন্তু অ্যালবিনিজম অথবা লিউসিজম কোনোটার প্রভাবেই সাদা হয়নি। এরা সাধারণত স্বাভাবিকভাবেই সাদা বর্ণের হয়ে থাকে।
ফিচার ইমেজ – thesouthafrican.com