ষোড়শ শতাব্দীর দিকের কথা। একদল পর্তুগীজ অভিযাত্রী জাহাজে করে ভারত মহাসাগর পাড়ি দেয়ার সময় এক অচেনা দ্বীপে এসে হাজির হয়। কম্পাসের কাঁটার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জায়গাটি আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল ঘেঁষে অবস্থান করছে। দূর থেকে দূরবীনে ধরা পড়লো দ্বীপটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য। জাহাজের ক্যাপ্টেনের আদেশে জাহাজ দ্বীপে ভেড়ানো হলো। দ্বীপের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নারকেল গাছের সারি, সমুদ্র পাড়ের বালি, ফুরফুরে হাওয়া- সব মিলিয়ে যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। এই দ্বীপটিকেই বর্তমানে আমরা সৌন্দর্যের লীলাভূমি মরিশাস নামে চিনি।
কিন্তু এসব ছাড়িয়েও নাবিকদের নজর কাড়ে সমুদ্র পাড়ে ঘুরতে থাকা একদল পাখি। পাখিগুলো সমুদ্র সৈকতের চারপাশে নিজেদের মতোই ঘুরছিল। দ্বীপে নতুন মানুষের আগমনেও খুব একটা বিচলিত হতে দেখা যায় না তাদের। স্বচ্ছন্দে নাবিকদের চারপাশে ঘুরতে থাকে পাখিগুলো।
প্রথমবার দেখে পাখিগুলোকে খানিকটা ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা উচ্চতায় এরা প্রায় সাড়ে তিন ফুট পর্যন্ত লম্বা হতো। আর একেকটি পাখির ওজন প্রায় ২০ কেজির বেশি হতো। কিন্তু দেহের আকার বড় হলেও এদের পাখা ছিল এদের দেহের তুলনায় অনেক ছোট। পাখার ওজনও ছিল বেশ হালকা। তাই এই পাখি উড়তে বা দৌড়াতে পারতো না। হাঁটার ক্ষেত্রেও এদের খুব ধীরগতি লক্ষ্য করা যেত। পাখিগুলোর পাখার রং হতো ধূসর বা বাদামী রঙের। পাখিগুলোর ঠোঁটও ছিল বেশ বাহারি রঙের। সবুজ, কালো ও হলুদ রঙের মিশেলে তাদের ঠোঁটে ছিল ভিন্ন রঙের ছোঁয়া। আর এদের ঠোঁট প্রায় ৯ ইঞ্চির মতো লম্বা হতো। পায়ের দিকটা অনেকটাই মুরগীর মতো হলেও পাগুলো কিন্তু বেশ শক্ত-পোক্ত হতো। কেননা এত ভারি একটি শরীর ঐ ছোট্ট দুটি পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতো। এতক্ষণ যে পাখির কথা বলছিলাম, তার নাম ডোডো। আজ থেকে অনেকদিন আগে নির্দয় কিছু মানুষের জন্য এই পাখি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
পাখিগুলোর শরীরের সবচাইতে মজার অংশ ছিল এদের পেট। স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ বড়সড় ছিল এদের পেট। তাই অনেকেই এদেরকে আদর করে ‘পেটুক পাখি’ও বলতো। মরিশাসের এই দ্বীপে একধরনের ফল পাওয়া যেত, যা ছিল পাখিটির বেশ প্রিয়। বর্ষার শেষে যখন গাছে গাছে ফল পাকা শুরু করতো, ডোডো পাখিরা তখন সেসব ফল সাবাড় করা শুরু করতো। গাছের পাকা ফল খেয়ে খেয়ে ডোডো পাখির পেটের ঐ অবস্থা হতো।
জীববিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, ১৬৬২ সালে শেষ ডোডো পাখির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। ডোডো পাখির কঙ্কাল অত্যন্ত যত্ন সহকারে সংরক্ষিত আছে মরিশাসের জাদুঘরে। এছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘরে ডোডো পাখির বিভিন্ন হাড় সংরক্ষিত আছে। বিজ্ঞানীরা ডোডো পাখির উপর অনেক ধরনের গবেষণা চালিয়ে আসছে। এদের হাড় পর্যবেক্ষণ করে জানা যাচ্ছে অনেক অজানা কথা। বিজ্ঞানীরা এমনও আশা করছেন যে, ভবিষ্যতে হয়তো এই পাখির জিন থেকে আবার পৃথিবীর মুখ দেখবে ডোডো পাখি।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইউনিভার্সিটি অব কেপটাউনের এক গবেষণায় এই পাখির বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, আগস্ট মাসের দিকে এদের ডিম থেকে বাচ্চা বের হতো। বর্ষার সময়টিতে জন্মানোর পর থেকেই ফলমূল খেয়ে খুব দ্রুত বেড়ে উঠতো ডোডো পাখি। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত দ্বীপে নানান রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানতো। এমন প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্যেই মূলত এরা প্রাকৃতিকভাবে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে নিজেদের আকারে বড় করে তুলতো।
তবে দ্রুত প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠলেও বংশ বিস্তার করার জন্যে এদেরকে বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হতো। একেকটি বাচ্চার জন্যে অপেক্ষা করতে হতো কয়েক বছর। দ্বীপে কোনো হিংস্র জন্তু না থাকার কারণে তাদের বংশ বিস্তারে তেমন কোনো বাধা আসতো না। ডিম পাড়ার পর ডোডো পাখির হাড়ে মিনারেলের পরিমাণ অনেকটা কমে যায়। এর ফলে পুরনো পালক ঝরে ফেলে নতুন পালক জন্মায়। তাই অনেকের বক্তব্যে এই পাখির পালক নিয়ে ভিন্নতা চোখে পড়ে।
এবার আসা যাক ডোডো পাখি কীভাবে হারিয়ে গেল, সেই গল্পে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কিছু ওলন্দাজ (নেদারল্যান্ডের অধিবাসী) অভিবাসী স্থায়ীভাবে মরিশাসে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু মরিশাসে বাস করার প্রধান সমস্যা ছিল পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব। দ্বীপে খাদ্যের বৈচিত্র্য তেমন ছিল না বললেই চলে। যে ফল পাওয়া যেত তার বেশিরভাগ সাবাড় করে দিত ডোডো পাখির দল। তখন ওলন্দাজদের চোখ পড়ে নাদুস-নুদুস দুর্বল স্বভাবের ডোডো পাখির উপর। আর আকার বড় হওয়াতে একেকটি পাখি হতে বেশ ভালোরকম মাংস পাওয়া যেত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এ পাখির মাংস মোটেও সুস্বাদু ছিল না। এক ওলন্দাজ অভিযাত্রী এই মাংস খেয়ে এর নাম দেন ‘ওয়াগ্লভোগেন’ অর্থাৎ অভক্তিকর পাখি। বিচ্ছিরি খেতে মাংসের জন্যেই এমন নাম দেয়া হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
তাই প্রশ্ন জাগে, ওলন্দাজরা তাহলে কেনই বা এই পাখির মাংস খেত? আগেই বলেছি দ্বীপটিতে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব ছিল। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা ডোডো পাখির মাংস খেত। আর এদের ধরা ছিল খুব সহজসাধ্য একটি ব্যাপার। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে ‘ডেড অ্যাজ ডোডো’ অর্থাৎ ‘ডোডোর মতো মৃত্যু’ বা ‘বোকার মতো মৃত্যু’। মানুষদের একেবারেই ভয় পেত না এই পাখি। তাই খুব সহজেই তাদের শিকারে পরিণত হয়ে যেত এই পাখি। দ্বীপের নতুন অধিবাসীরাও তখন পুরোপুরি ডোডো পাখির মাংসের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
মাংস খাওয়ার পাশাপাশি এদের ডিমও খাওয়া শুরু করলো দ্বীপের অধিবাসীরা। এরা উড়তে পারতো না বলে মাটিতে বাসা বাঁধতো আর সেখানেই ডিম পারতো। দ্বীপের মানুষেরা সেই ডিম গোপনে চুরি করে নিয়ে আসতো। আবার অনেকে খেলার ছলেও এদের হত্যা করা শুরু করে। ফলে কমতে থাকে এদের সংখ্যা।
অন্যদিকে ওলন্দাজরা এই দ্বীপে আসার সময় সাথে করে কুকুর, বেড়াল, বানর, শুকরসহ অনেক ধরনের পশু-পাখি নিয়ে আসে। ফলে ধীরে ধীরে দ্বীপের পরিবেশ ডোডো পাখির বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। আর এভাবেই একসময় পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় অদ্ভুত এই পাখি।
অনেক ডোডো পাখি মরিশাস হতে নেদারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, পর্তুগালসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু মরিশাস ছাড়া এদের টিকে থাকাটা ছিল একেবারেই অসম্ভব। তাই অন্য কোথাও তাদের আর বংশবিস্তার ঘটেনি। বিভিন্ন বই, প্রবন্ধ, দিনলিপি আর চিত্রকরের তুলির আঁচড়ে রয়ে গেছে এদের অস্তিত্ব।
ডোডো পাখি হারিয়ে গেলেও মরিশাস দেশটি কিন্তু এই পাখিকে ভোলেনি। বিলুপ্ত ডোডোকে তারা জাতীয় পাখির স্থান দিয়েছে। এ পাখির উপর বিভিন্ন গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা করছে মরিশাস সরকার। সরকারি ডাকটিকেট থেকে শুরু করে, টাকা-পয়সা, ক্যালেন্ডারসহ বিভিন্ন দ্রব্যে ডোডো পাখির উপস্থিতি সর্বদাই চোখে পড়ে।
ফিচার ইমেজ- pl.wiktionary.org