নীলগাই: বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক প্রাণী

দীর্ঘ ৮০ বছর পর অবশেষে সে ফিরে এসেছে। সেই ১৯৪০ সালে তাকে শেষবারের মতো বাংলাদেশের বুকে দেখা গিয়েছিল। এরপর আর তার কোনো চিহ্ন ছিল না বাংলার বুকে। বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষার পর বাংলাদেশ থেকে তাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মহল। দীর্ঘ বিরতি শেষে বাংলাদেশের মাটিতে পুনরায় দেখা গেছে একে। ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার কুলিক নদীর ধারে বাংলাদেশে পুনরায় দেখা গেছে বিলুপ্ত প্রাণী নীলগাইকে।

নীলগাইয়ের আকস্মিক আবির্ভাব যেন মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের বুকে বিলুপ্ত হয়ে পড়া আরও কয়েক ডজন প্রাণীর কথা। গত শতাব্দীতে মানুষের লোভী প্রবৃত্তির শিকার হয়ে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। গণ্ডার, গাউর, বুনো মোষ, ময়ূর, হাড়গিলা, নীলগাই, ঘড়িয়াল, জলার কুমির, বারশিঙ্গা, হায়েনা, চিতা, ধূসর নেকড়ে, কৃষ্ণষাঁড়, মন্থর ভালুকসহ প্রায় ৩১ প্রজাতির প্রাণী বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মহাবিপন্ন, বিপন্ন এবং সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আরও কয়েকশত প্রজাতির প্রাণী।

বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে বনরুই; Image Source: Monirul H Khan/IUCN

এককালের জীববৈচিত্র্যের সম্ভার এই বাংলাদেশ আমাদের আগ্রাসনে আজ পশুদের জন্য অনিরাপদ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ৮০ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া এক প্রাণী হচ্ছে ‘নীলগাই’। কিন্তু ২০১৮ সালে ভারত থেকে দলছুট হয়ে বাংলাদেশে চলে আসার মাধ্যমে সেই প্রাণীটি নতুন শতাব্দীতে দেশের প্রথম নীলগাই হিসেবে আত্মপ্রকাশিত হয়েছে। এরপর আরও একটি নীলগাই আবিষ্কারের পর বাংলাদেশের বুকে নতুন করে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে নীলগাইকে ঘিরে।

নীলগাই কিন্তু ‘গাই’ নয়

নীলগাই শুনলেই মাথায় আসে নীল চামড়ার এক গরুর ছবি। অন্তত নাম শুনে অন্যকিছু মাথায় আসার প্রশ্ন উঠে না। কিন্তু নীলগাইয়ের নামে গাই যুক্ত থাকলেও এরা বাস্তবে কোনো গরু বা গরুজাতীয় প্রাণী নয়। এরা হরিণ জাতীয় প্রাণী। এশিয়ার বুকে বিচরণ করা হরিণ জাতের প্রাণীগুলোর মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় এরা। এর বৈজ্ঞানিক নাম Boselaphus tragocamelus। খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে তৃণভোজী প্রাণী। এদের খাবারের তালিকায় ঘাস, লতাপাতা, গুল্ম, ঝোপ ইত্যাদি তৃণজাতীয় খাদ্য রয়েছে। তাই এসব খাবারের প্রাচুর্য রয়েছে এমন জঙ্গলে বা জলাভূমির দিকে নীলগাইদের বেশি দেখা যায়।

ভারতীয় নীলগাই; Image Source: Wikimedia Commons

এদের গড় আয়ু ২১ বছরের মতো হয়। একে অনেকেই শান্ত এবং বোবা প্রাণী হিসেবে মনে করে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে নীলগাইয়ের ডাক রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছে। এরা দিবাচর প্রাণী। প্রচণ্ড গরমেও এদের দিনের বেলায় দিব্যি খাবারের সন্ধানে চলাফেরা করতে দেখা যায়। এরা তখন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে। তবে গ্রীষ্মকাল ব্যতীত অন্যান্য সময় এরা পানি না খেয়ে ২/৩ দিন কাটিয়ে দিতে পারে।

নীলগাই দিনের বেলা বিচরণ করে; Image Source: The Quint

বর্ণনা

নীলগাই নামের মধ্যে ‘নীল’ এবং ‘গাই’ দুটি শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু বাহ্যিক দিক থেকে দেখতে এরা অনেকটাই ঘোড়ার মতো। ঘোড়ার যেমন লম্বা ঘাড় এবং এর মধ্যে হালকা কেশর থাকে। এদের মাথা খানিকটা সরু এবং ঘোড়ার ন্যায় এদের শক্ত পা থাকে। আবার পিঠের শেষে এদের গরুর মতো লেজও রয়েছে। আকারে ভারতীয় গরুর চেয়ে বড় হয়। লম্বায় প্রায় ৫ ফুট হয়ে থাকে। গড় ওজন ৩০০ কেজির মতো হয়। এরা সাধারণত পেছনের পায়ের উপর ভর করে ঘাড় উঁচু করে পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে। তখন এদের অনেকটা কুঁজো মনে হয়।

পুরুষ নীলগাই; Image Source: sarangib
মাদি নীলগাই; Photograph: Brett Cole

মাদি এবং পুরুষ নীলগাইয়ের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রথম দেখাতেই যদি নীলগাইয়ের মাথায় শিং নজরে আসে, তাহলে চোখ বন্ধ করে সেটি পুরুষ নীলগাই বলে চিহ্নিত করা যায়। এছাড়া পুরুষ নীলগাইদের গায়ের চামড়ার রঙ ধূসর থেকে নীলচে-ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে। এদের গাল এবং ঠোঁটের চারদিকের রঙ কিছুটা সাদাটে হয়ে থাকে। এদের কান এবং লেজের শীর্ষ কালচে রঙের। পুরুষদের শিংজোড়া ১৫ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। মাদি নীলগাইদের গায়ের রঙ হয় বাদামী। এদের দেহেও পুরুষদের ন্যায় সাদা ফোঁটা দেখা যায়। কিন্তু এদের কোনো শিং নেই। এদের ঘাড়েও কেশর রয়েছে।

নিবাস

ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং যুক্তরাষ্ট্রে নীলগাই পাওয়া যায়। তবে এদেরকে ভারতের স্থানীয় পশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে দক্ষিণে ভারতের কর্ণাটক পর্যন্ত নীলগাইদের বসতি। তবে আসাম এবং মালাবারে এদের দেখা পাওয়া যায় না। পূর্বে বাংলাদেশে নীলগাই পাওয়া গেলেও এখন তা বিলুপ্ত ঘোষিত হয়েছে। ভারতের রাজস্থান এবং গুজরাটের গির অরণ্যে প্রচুর নীলগাই দেখা যায়। এছাড়া পুরাতন নথিপত্রে দাক্ষিণাত্যে নীলগাই থাকার কথা দেখা যায়। ধারণা করা হয়, সেগুলো বুনো নীলগাই ছিল। অতীতে বেঙ্গালুরুর উত্তর দিকে কিছু নীলগাই ছিল এবং এখনও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভারতে নীলগাই; Photograph: Sushila Singh
টেক্সাসের নীলগাই; Image Source: Texas Parks and Wildlife

নেপালে দক্ষিণাঞ্চলের নিচু ভূমিতে নীলগাই পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে নীলগাই পাওয়া যায় মার্কিন মুলুকে। ১৯২০ সালে দর্শণার্থীদের বিনোদনের জন্য টেক্সাসে বেশকিছু নীলগাই ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বেশকিছু নীলগাই দলছুট হয়ে টেক্সাসের দক্ষিণাঞ্চলে বংশবিস্তার করেছে। এরা সাধারণত ঘন অরণ্য এড়িয়ে চলে। এদের মাঝে মাঝে কৃষি জমিতে ফসল খেতে দেখা যায়। ফসল নষ্ট করে বলে ভারতের কিছু অঞ্চলে লাইসেন্স নিয়ে নীলগাই নিধন করার অনুমতি আছে। ভারতে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ নীলগাই রয়েছে। আমেরিকা মহাদেশে নীলগাইদের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ হাজারের মতো।

জীবনচক্র

হেমন্ত থেকে শীতকালের শুরুর দিক পর্যন্ত সময়ে নীলগাই প্রজননক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। প্রাণীজগতে বহু প্রজাতির প্রাণীদের পুরুষরা নারীসঙ্গের জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে থাকে। নীলগাইও এদের ব্যতিক্রম নয়। পুরুষ নীলগাই মাদিদের মন জয় করার জন্য ঘাড় সোজা করে নিজেদের সুদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু ঝামেলা শুরু হয় যখন একাধিক নীলগাইয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। তখন সাধারণ রূপ প্রদর্শনী পরিণত হয় শিং-যুদ্ধে। নীলগাইয়ের চামড়া মোটা হলেও মাঝেমাঝে সংঘাতে অনেকে গুরুতর আহত হয়। তবে এই প্রতিযোগিতা মাদিদের মধ্যেও দেখা যায়। এদের শিং না থাকায় এরা ঘাড় দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। প্রয়োজন পড়লে কটিদেশের মাধ্যমে আঘাত করে অন্য নীলগাইকে দূরে সরিয়ে দেয়।

নীলগাইয়ের মধ্যে লড়াই; Photograph: Saurabh Desai

প্রতিযোগিতা শেষে একটি পুরুষ নীলগাই একাধিক মাদির সাথে মিলিত হয়। তবে মাদি নীলগাইয়ের অনুমতিসূচক লেজ নাড়াচাড়া ছাড়া এরা মিলিত হয় না। এরা সামাজিকভাবে নির্দিষ্ট সঙ্গী নিয়ে ঘোরাফেরা করে না। একটি নীলগাই গড়ে ২৪৩ দিন গর্ভবতী থাকে। প্রায় ৫০% ক্ষেত্রে এরা যমজ শাবকের জন্ম দেয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ১ থেকে ৩টি শাবকের জন্ম হয়। নীলগাই শাবকের গড় ওজন ১৪-১৬ কেজি। শাবক জন্ম নেওয়ার পর মা নীলগাই কিছুদিন একাকী সন্তানের সাথে বসবাস করে। শাবকগুলো খুব ডানপিটে স্বভাবের হয়। জন্মের ৪০ মিনিটের মাথায় এরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। ১ মাসের মধ্যে এরা নিজের খাবার খুঁজতে পারে। পুরুষ শাবক ৩ বছর এবং মাদি শাবক ২ বছরের মাথায় প্রজননক্ষম হয়ে উঠে। তবে প্রজননক্রিয়ার জন্য এরা ৪ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

বাংলাদেশে নীলগাইয়ের প্রত্যাবর্তন

দিনাজপুরের রামসাগরে নীলগাই যুগল; Image Source: Prothom-Alo

কোনো প্রাণী বিপন্ন, বিলুপ্ত বা সংকটাপন্ন হলে তাকে চিহ্নিত করে তালিকা প্রণয়ন করে IUCN (International Union for Conservation of Nature) নামক এক সংস্থা। IUCN-এর তালিকায় নীলগাই নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সহজ কথায়, নীলগাই বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকা বা বিপন্ন প্রাণী নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন ঝুঁকিতে না থাকা একটি প্রাণী বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভারত বিভাজনেরও আগে শেষবারের মতো এই অঞ্চলে নীলগাই দেখা গিয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও আশেপাশের জেলাগুলোতে নীলগাইয়ের বিচরণ ছিল। তবে বন উজাড় এবং অবাধ শিকারের কারণে এদের সংখ্যা দিনে দিনে কমতে থাকে। বাংলাদেশের সর্বশেষ স্থানীয় নীলগাইয়ের নিবাস ছিল পঞ্চগড়ে।  ১৯৪০ সালের পর নীলগাই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত ঘোষিত হয়। তবে সুসংবাদ হচ্ছে, স্থানীয় নীলগাই না থাকলেও বাংলাদেশে এখন দুটি নীলগাই রয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে উদ্ধার হওয়া নীলগাই; Image Source: Bangla Tribune

২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে কুলিক নদীর ধারে ধরা পড়া নীলগাইটি মূলত ভারত থেকে এদেশে এসেছে। সেটি ছিল মাদি নীলগাই। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের নওগাঁ থেকে আরেকটি নীলগাই ধরা পড়ে। নওগাঁর নীলগাইটি ছিল পুরুষ। পরে বংশবৃদ্ধির জন্য স্ত্রী ও পুরুষ নীলগাইকে রামসাগর জাতীয় উদ্যানে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ মাদি নীলগাইটি দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ায় একা হয়ে পড়ে পুরুষ নীলগাই। এর মাধ্যমে নীলগাই বংশবিস্তারের পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। তবে ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে কাঁদায় আটকে পড়া একটি নীলগাই উদ্ধার করা হয়। এখন এই দুটি নীলগাইয়ের মধ্যে মিলনের মাধ্যমে দেশে পুনরায় নীলগাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা চলছে।

This is a Bangla article about Nilgai. This is one of the largest antelope in Asia. Native to India, this animal was once abundant in Bangladesh. Unfortunately, it was declared extinct from Bangladesh in 1940.

Reference: All the references are hyperlinked.

Feature Image: Sachin Rai

Related Articles

Exit mobile version