কিছু পোকা বা পতঙ্গ রয়েছে, যেগুলো দেখলে মানুষ আতঙ্কিত হয়, আবার অনেক পতঙ্গের সৌন্দর্যে বিমোহিত হওয়ার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। অন্যদিকে, পতঙ্গের বেশ কিছু প্রজাতি রয়েছে, যাদের মানুষ খালি চোখে দেখতেই পায় না। এগুলো এতটাই ছোট যে, গবেষণার উদ্দেশ্যে এদের পর্যবেক্ষণ করাও অনেক সময় বেশ কষ্টসাধ্য। সূচের অগ্রভাগের মতো ক্ষুদ্র মাকড়শা কিংবা ক্ষুদ্রতম পাখাহীন ভিমরুল থেকে শুরু করে এই তালিকায় রয়েছে রঙিন প্রজাপতিও। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম পতঙ্গদের নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের আয়োজন।
ওয়েস্টার্ন পিগমি নীল প্রজাপতি
পৃথিবীতে প্রজাপতির বিচরণ সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে, সেই হিসেবে সূক্ষ্ম ও নিপুণ সৌন্দর্যের এই পোকাগুলো আমাদের পরিবেশের শোভা বর্ধন করে চলেছে একটা দীর্ঘ সময় ধরে। প্রজাপতির ফসিল থেকে ধারণা করা হয়, প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছরের বেশি সময় পূর্বেও তাদের অস্তিত্ব ছিল। সুদীর্ঘ সময়ে তারা বরফ যুগের মতো ভয়ংকর সময় পার করেও টিকে রয়েছে পরিবেশে।
প্রায় ১,৮০,০০০ প্রজাতির মধ্যে সাধারণত মাত্র ২-৪ সপ্তাহ বাঁচে প্রজাপতি, এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট নীল প্রজাপতিগুলোর জীবনকাল মাত্র কয়েক দিনের! প্রজাপতি গোত্রের সবচেয়ে ছোট সদস্যের নাম নীল পিগমি প্রজাপতি, যাদের সাধারণত পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকা, হাওয়াই এবং মধ্যপ্রাচ্যে। এগুলোর তামাটে বাদামী রঙের মাঝে হালকা নীল রঙের পাখাগুলো মাত্র ১২ মিলিমিটারের মতো হয়ে থাকে, যা খুবই ছোট।
পাতু দিগুয়া মাকড়শা
সাধারণত পুরুষ মাকড়শা নারী মাকড়শার চেয়ে আকারে ছোট হয়ে থাকে, ব্যাপারটি সবচেয়ে ছোট মাকড়শা পাতু দিগুয়ার জন্যেও ব্যতিক্রম নয়। কলম্বিয়ার উত্তরাঞ্চলের ভায়া দেল কাওকা’র রিও দিগুয়া নদীর নিকটবর্তী এল কুয়ারেমালে পাওয়া যায় পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট মাকড়শা, পাতু দিগুয়া। এগুলোর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের আকার আকার সাধারণত ০.৩৭ মিলিমিটার হয়ে থাকে।
পাতু দিগুয়ার চেয়ে সামান্য বড় স্যামন মস মাকড়শাও অত্যন্ত ছোট, মাত্র ০.৪ মিলিমিটার লম্বা এগুলো। এত ছোট এরা, যা প্রায় একটি সূচের অগ্রভাগের মতো এবং খালি চোখে প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে।
স্কারলেট বামন ফড়িং
নর্দার্ন পিগমি ফ্লাই বা ক্ষুদ্র ফড়িং নামেও পরিচিত স্কারলেট বামন ফড়িং, যেগুলোর সাধারণ বাসস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে চীন ও জাপানে। তাছাড়া, অনেক সময় অস্ট্রেলিয়াতেও এদের দেখতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে ছোট এই ফড়িংগুলো Libellulidae গোত্রের অন্তর্গত। অতিক্ষুদ্র এই পতঙ্গগুলোর উইংস্প্যান বা পাখার প্রসার খুব বেশি হলে ২০ মিলিমিটার হয়ে থাকে। বর্তমানে পৃথিবীতে টিকে থাকা এই পোকাগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র হলেও, একসময় এরা আকারে বেশ বড় ও শিকারি প্রজাতির ছিল, যারা অন্য পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করত।
প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছর পূর্বের ফড়িঙের ফসিলের গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে অভূতপূর্ব কিছু তথ্য। ফড়িঙের পূর্বপুরুষ Meganeura সবচেয়ে বড় পতঙ্গ ছিল, যারা উড়তে পারত। এদের পাখার প্রসার ছিল প্রায় ৭০ সেন্টিমিটারেরও বেশি। তবে এখন সবচেয়ে বড় যে ফড়িঙের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তারা এতটা বড় না হলেও ক্ষুদ্রতম ফড়িঙের তুলনায় বেশ দীর্ঘকায়। Odanata ফড়িংগুলো লম্বায় ১২ সেন্টিমিটার ও পাখার প্রসার সাধারণত ২০ সেন্টিমিটারের মতো।
বামন মথ
মথ ও ফড়িঙের মধ্যে পার্থক্য করা বেশ কঠিন। সাধারণত ফড়িং দিনের বেলা উড়লেও, সন্ধ্যার দিকে উড়তে বের হয় মথ। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। তাছাড়া, আকারেও ফড়িঙের তুলনায় মথ যথেষ্ট ছোট। তবে, মথ ও ফড়িঙের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় তাদের শুঙ্গ। যেখানে ফড়িঙের শুঙ্গের মাথায় ক্ষুদ্রাকৃতির বলের ন্যায় অংশ থাকলেও, মথের শুঙ্গে এমন কিছু দেখা যায় না সাধারণত।
একটি মথের গড় উইংস্প্যান বা পাখার প্রসার ২৫ মিলিমিটার হলেও, Nepticulidae গোত্রের বেশ কিছু অতিক্ষুদ্র মথ রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো বামন মথ বা পিগমি মথ। সবচেয়ে ক্ষুদ্র পিগমি সরেল মথের পাখার প্রসার অত্যন্ত ক্ষুদ্র, মাত্র ৩ মিলিমিটার।
Microtityus Minimus কাঁকড়াবিছা
কীটপতঙ্গের মধ্যে কাঁকড়াবিছা অন্যতম মারাত্মক ও প্রাণঘাতী একটি পতঙ্গ। এই পতঙ্গ অত্যন্ত বিষাক্ত হলেও, মাত্র ২৫টি প্রজাতি রয়েছে যাদের বিষ মানুষের মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম। প্রায় ৪৩০ মিলিয়ন বছর ধরে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবেশে টিকে থাকা কাঁকড়াবিছাদের বিষ, শক্তিশালী চোয়াল ও পুরু বহিঃআবরণ, সবই টিকে থাকার তাগিদে।
যা-ই হোক, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট কাঁকড়াবিছা Microtityus Minimus খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ২০১৪ সালে, ডমিনিকান রিপাবলিকের গ্রেটার আন্টিলিয়ান দ্বীপে। সবচেয়ে ছোট এই কাঁকড়াবিছার আকার মাত্র ১১ মিলিমিটার।
Euryplatea Nanaknihali মাছি
মাছিদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র হলো Euryplatea Nanaknihali মাছি, যারা দৈর্ঘ্যে মাত্র এক মিলিমিটারেরও অর্ধেক! অত্যন্ত ক্ষুদ্র এই মাছিরা তাদের ডিম দেয় পিঁপড়ার মাথার ভিতরে এবং সেখানেই তারা বেড়ে ওঠে।
এমনকি ধীরে ধীরে তারা পুরো পিঁপড়াকে ভেতর থেকে গ্রাস করে নেয় এবং একসময় মেরেও ফেলে! খুব কম প্রজাতির মাছি রয়েছে, বেঁচে থাকার জন্য যারা এই কৌশল বেঁছে নেয়। Phoridae গোত্রের কিছু মাছিও অবশ্য পিঁপড়াদের শরীর ব্যবহার করে তাদের ডিম জমা রাখার জন্য।
Bolbe pygmaea ম্যান্টিস
নর্দার্ন প্রেয়িং ম্যান্টিস ও সাওদার্ন প্রেয়িং ম্যান্টিস নামের জনপ্রিয় মার্শাল আর্ট অনুপ্রাণিত হয়েছে প্রেয়িং ম্যান্টিসের আত্মরক্ষার কৌশল থেকে। তাছাড়া, গৃহপালিত হিসেবে ম্যান্টিসদের মানুষ পুষে থাকে, পতঙ্গের বেলায় যা তেমন একটা দেখা যায় না বললেই চলে।
এই ধরনের পতঙ্গের প্রায় ২,৪০০ প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড়গুলো ৩.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে, ম্যান্টিসের সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রজাতির নাম হলো Bolbe pygmaea, যারা মাত্র ১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হয় এবং এদের অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়।
Uranotaenia lowii মশা
রক্ত শুষে নিয়ে মশাদের ওজন দ্বিগুণ হয়ে গেলেও, বিশেষ কৌশল ব্যবহার করে নিমেষে ফাঁকি দিয়ে উড়ে যাওয়ার বিশেষ সক্ষমতা রয়েছে এদের। মানুষের রোগের বিস্তারে বিশ্বে মশাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট মশারা মানুষের রক্ত পানের ব্যাপারে অতটা আগ্রহী নয়।
Uranotaenia lowii নামের ক্ষুদ্র এই মশাদের দৈর্ঘ্য মাত্র ২.৫ মিলিমিটার, যারা পেল-ফুটেড Uranotaenia নামেও পরিচিত। খাদ্যের জন্য এরা ব্যাং ও অন্যান্য উভচরদের উপর নির্ভরশীল। শব্দের প্রতি দারুণ সংবেদনশীল এই মশাদের দেখা যায় ফ্লোরিডা থেকে টেক্সাস পর্যন্ত এবং নর্থ ক্যারোলিনার উত্তরপ্রান্তে।
ফেইরিফ্লাই ভিমরুল
গড়ে মাত্র ০.৫ থেকে ১ মিলিমিটারের এই ভিমরুলরা ফেইরিফ্লাই বা ফেইরি ভিমরুল গোত্রের, যারা পৃথিবীর অন্যতম ক্ষুদ্র প্রজাতির পতঙ্গ। ১৮৩৩ সালে আইরিশ এন্টোমলজিস্ট অ্যালেক্সান্ডার হেনরি এদের আবিষ্কার করেন। আর্দ্র রেইনফরেস্ট কিংবা শুষ্ক মরুভূমি, প্রায় সবখানেই এদের খুঁজে পাওয়া যায়।
এই গোত্রের সবচেয়ে ছোট পতঙ্গ হচ্ছে Dicopomorpha echmepterygis, যারা লম্বায় মাত্র ০.১৩৯ মিলিমিটার এবং বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র পতঙ্গ এগুলো। অর্থাৎ এত ক্ষুদ্র যে, খালি চোখে দেখা প্রায় অসম্ভব। কোনো চোখ বা পাখা নেই এগুলোর, মুখে সামান্য ছিদ্র ও দুটি অতিক্ষুদ্র শুঙ্গ রয়েছে শুধু। হাওয়াই, কোস্টারিকা ও থাইল্যান্ডে দেখা যায় কিকিকি হুনা নামের ফেইরিফ্লাই, যারা উড়তে পারা পতঙ্গদের মধ্যে ক্ষুদ্রতম এবং এরা দৈর্ঘ্যে মাত্র ০.১৫ মিলিমিটার।