আয়তনে আর ওজনে পৃথিবীর বৃহত্তম এক গাছ সেকুইয়া। ক্যালিফোর্নিয়ায় এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই গাছ তার অস্তিত্বকে জানান দিয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বকে। প্রকৃতির মাঝে বেঁচে থাকা গাছগুলোর কয়েকটি বিশ্বের প্রাচীনতম গাছের সাক্ষী বহন করছে, আবার বেশ কয়েকটি গাছ তার উচ্চতা দিয়ে আকাশকে স্পর্শ করতে উদগ্রীব হয়ে আছে।
সেকুইয়া বৃক্ষের জন্মস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার পশ্চিমাঞ্চলীয় ঢালে অবস্থিত সেকুইয়া ন্যাশনাল পার্ক এবং ইয়োসেমাইট ন্যাশনাল পার্ক। পার্বত্য এলাকায় এক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত পার্ক দুটি। এখানেই দেখা মেলে এই দৈত্যকার সেকুইয়া গাছের। আর এই কারণে পার্ক দুটি পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে থাকা একেকটা সেকুইয়া গাছের গড় বয়স আড়াই হাজার বছরেরও বেশি।
সময়ের পরিক্রময়ায় এই পৃথিবীর অনেক কিছু বিদায় নিলেও হাজার হাজার বছর আগের প্রকৃতির নীরব সাক্ষী হয়ে ঠাঁই দাাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন দৈত্যাকার সেকুইয়া গাছগুলো।
বৃক্ষের আকৃতি ও আয়তন
এই গাছের গড় উচ্চতা ২৫০ ফুট, ওজন প্রায় ১,৩০০ মেট্রিক টন। আর এর জীবনবৃত্তও বেশ দীর্ঘ। কোনো কোনো গাছ ২,৫০০ বছরের অধিক সময় ধরে বেঁচে আছে। যেন সত্যিকার এক জীবন্ত দৈত্যই বটে, নাম জায়ান্ট সেকুইয়া বা বিগ ট্রি।
আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম এই দৈত্যগাছ
পিনোপিডি গোত্রের সাইপোয়েসি পরিবারের গিগেটিয়াম প্রজাতির বৃক্ষ এই সেকুইয়া। আয়তনের দিক থেকে বিচার করলে সেকুইয়া পৃথিবীর বৃহত্তম গাছ। ‘রেড উড’ বৃক্ষজাতির মধ্যে বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে আছে পনেরোটি প্রজাতি। এর মধ্যে সেকুইয়া হল সর্ববৃহৎ মাপের।
সেকুইয়া গাছের গুঁড়ির পরিধি ১০০ ফুটেরও বেশি হয়ে থাকে। সেকুইয়া গাছের চেয়ে লম্বা গাছও আছে ক্যালিফোর্নিয়াতে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী রেডউড ফরেস্টে। পৃথিবীর উচ্চতম বৃক্ষ হল এরই জাতভাই কোস্টাল রেডউড। এই রেডউড গাছের উচ্চতা প্রায় ৩০০ ফুট। তবে আয়তন ও ওজনে এরা সেকুইয়ার কাছে নেহাতই শিশু।
সেকুইয়া বৃক্ষের জন্মকাহিনী ও বংশ বিস্তার
এই গাছের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রার জলবায়ুর প্রয়োজন হয়। প্রকৃতির এই আনুকূল্য পেলে তারা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠতে পারে। তবে সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার পশ্চিমা ঢালে ৫,০০০-৭০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের ঢালে এই গাছ সবচেয়ে বেশি জন্মাতে দেখা যায়। এই গাছের গড় আয়ু প্রায় ৩,০০০ বছর। এই গাছের ছালের পুরুত্বও প্রায় তিন ফুট।
এই দৈত্যকার গাছের জন্মকাহিনীও কম চমকপ্রদ নয়। অত্যন্ত ছোট একটি বীজ থেকে এর জন্ম। তবে বিশ বছর পর পর বীজ তৈরি হয় গাছগুলোতে। বীজটি থাকে শক্ত শঙ্কু-আকারের খোলের মধ্যে। এই শক্ত খোলের বর্ম ফেটে বীজ বাইরে এলেই জন্ম নেয় ‘এই দৈত্য শিশু’। জঙ্গলের কাঠবিড়ালি এই ব্যাপারে সেকুইয়ার বন্ধু। সেকুইয়ার খোল কাঠবিড়ালিদের প্রিয় খাবার। খোলের বাইরের শক্ত অংশটা এরা ভেঙে খায় আর ভিতরের বীজ এসে পড়ে বাইরের মাটিতে।
অবশ্য সেকুইয়ার বংশবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা আগুনের। জঙ্গলে আগুন লাগলে বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, আর সেই গরমে সেকুইয়ার খোল শুকিয়ে ফেটে একসঙ্গে প্রচুর বীজ ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গলের মাটিতে। আর প্রাকৃতিক সারের কাজটা করে দেয় সদ্য আগুনে পোড়া পাতার স্তূপ। অঙ্কুরোদগমের পরে এই সারেই বড় হয়ে ওঠে সেকুইয়া গাছ।
সেকুইয়া বৃক্ষের জীবনবৃত্ত দীর্ঘ হওয়ার পিছনে
সেকুইয়া গাছের দীর্ঘ আয়ুর রহস্যের অনেকটাই লুকিয়ে আছে এই গাছের বাকলে। লালচে বাদামী রঙের বাকলগুলো প্রায় ২০ ইঞ্চি পুরু। সেকুইয়া গাছগুলোর গাছের ছালে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক উপকরণ থাকার কারণে ছত্রাক ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে এরা রক্ষা পায়। গাছগুলোর এই বিপুল প্রাণশক্তির পেছনে এটাই একমাত্র গোপন সূত্র। ভাবতে অবাক লাগে, প্রায় ১০০ বছর আগে কাটা গাছের গুঁড়ি আজও জঙ্গলে অবিকৃত রয়েছে।
এই অদ্ভুত প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্যই এরা আজ প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী। কয়েকটি প্রজাতির পাইন গাছ আছে যারা সেকুইয়ার চেয়েও দীর্ঘজীবী। তবে শতাব্দী প্রাচীন সেকুইয়ার বৃদ্ধির হার বেশি বলেই এদের এরকম দৈত্যাকার চেহারা।
বিশালত্ব চেহারাই এই বৃক্ষের মৃত্যুর কারণ
তবে এই বিশাল চেহারাই এদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উল্টে পড়ে যাওয়া সেকুইয়ার মৃত্যুর প্রধান কারণ। প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ গাছগুলো শুধুমাত্র প্রবল বেগের ঘূর্ণিবায়ুর কারণে নিজেদের বিশালত্বের কাছেই নিজেরাই হার স্বীকার করে। বিশাল শরীরের ওজনের তুলনায় এদের শিকড় তেমন শক্তপোক্ত নয়। তাই প্রবল ঘুর্ণিবায়ুতে নিজের ভার ধরে রাখতে অনেকেক্ষেত্রেই সক্ষম হয় না। ফলে শিকড়সহ গাছগুলো উল্টে পড়ে।
এই বিশাল গাছ উপড়ে যখন মাটিতে পড়ে তখন তা সরানোও অনেক সময় বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এরকমই এক ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭০ সালে। কোনো এক প্রাকৃতিক ঘুর্ণিবায়ুর কারণে এক বিশালাকৃতির সেকুইয়া গাছ মাটিতে আছড়ে পড়ে। গাছটি এমনভাবে মাটিতে পড়ে যে, রাস্তা চলাচলেই বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় একুশ ফুট ব্যাসের এই প্রকাণ্ড গাছটিকে সরানো ছিল এককথায় অসম্ভব।
তখন উদ্যানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। রেল রাস্তা তৈরির সময় মাঝখানে যদি কোনো পাহাড় থাকলে তার মধ্যে দিয়ে সুরঙ্গ করে যেমন রেল রাস্তা নির্মাণ করা হয়, ঠিক তেমনি এই বিশালাকার গাছটিকে না সরিয়ে কাণ্ডের বেশ খানিকটা অংশ কেটে সড়কের দু’ধারকে জোড়া দেবার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেলো। গাছের কান্ড কেটে সুরঙ্গের মতো তৈরি করার ফলে রাস্তায় চলাচল নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হয়।
জেনারেল শেরম্যান
সেকুইয়া জাতীয় অভয়ারণ্যের এই অমর, অজড় বিশাল বৃক্ষরাজির মধ্যে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ গাছটি, তা দর্শন করতে প্রতি বছর দেশ বিদেশের অসংখ্য ভ্রমণার্থীরা ভিড় করে এই পার্কে। বনের ভেতরে প্রায় মাইলখানেক পথ পাড়ি দিয়ে তবেই দেখা মেলে সেই বিশালত্বের। প্রায় ২,৭০০ বছরের পুরনো এই বিশাল প্রাচীন সেকুইয়া গাছটির নাম জেনারেল শেরম্যান।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় এক বীর সেনানী জেনারেল শেরম্যানের নামানুসারে এই গাছটির নামকরণ করা হয়। বর্তমান পৃথিবীতে বৃহৎ গাছ পরিমাপের ক্ষেত্রে গাছের ঘনত্বকে বিবেচনায় নেয়া হয়। সেই হিসেবে ২৭৫ ফুট উচ্চতার জেনারেল শেরম্যানের ৫২,০০০ ঘনফুট কাঠ আর তেরশ টন ওজনের আয়তনের জন্য এই বিশাল গাছটির পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গাছ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বহুতল ভবনের উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে ঘাড়ের দিকে যেমন অস্বস্তি হয়, ঠিক তেমনি এই বৃক্ষের শীর্ষদেশ দেখতে গেলে পর্যটকদের তেমনই এক অনুভূতি জাগে। আর মনে হবে প্রকৃতির এই বিশালত্বের মাঝে নিজেদের ক্ষুদ্রতা।
উনবিংশ শতকের শেষ দিকে আমেরিকার কয়েকজন পরিবেশবাদী সংগঠকের একান্ত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে ক্যালিফোর্নিয়ার বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চলকে সরকারি আওতায় এনে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে জন্ম নেয় সেকুইয়া জাতীয় অভয়ারণ্য। তার ফলেই আজ পুরো অভয়ারণ্য ঢেকে গেছে আকাশছোঁয়া সেকুইয়া বৃক্ষরাজিতে। তা না হলে অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের নিষ্ঠুর থাবা থেকে রক্ষা করা যেত না এই বিশালাকৃতির প্রাচীন সব বৃক্ষকে। আমরাও কি এভাবে আমাদের প্রাচীন সব বৃক্ষ আর ঐতিহ্যময় স্থানগুলোকে রক্ষা করার প্রয়াস নিতে পারি না? তা হলে ইতিহাসের অনেক ঐতিহ্যকে আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দেওয়া সম্ভব হতো।
ফিচার ইমেজ: yosemiteconservancy.org