পোকার কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আট দশটি পা যুক্ত, শুঁড়ওয়ালা কিলবিলে জীবের কথা। পোকা দেখে আবার রীতিমতো আঁতকে উঠেন অনেকেই। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক পোকা রয়েছে যারা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মনোমুগ্ধকর। চলুন আজকে জেনে নিই এমনই ১০টি সুন্দর পোকা সম্পর্কে।
১০. এটলাস মথ
সুন্দর পোকাদের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে এটলাস মথের নাম। সৌন্দর্যের পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মথ এটি। বিশাল আকারের এই মথগুলো ডানা মেলা অবস্থায় প্রায় ১২ ইঞ্চি ও গোটা পৃষ্ঠতল হিসাব করলে প্রায় ৬২ বর্গ ফুট হয়ে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই মথ বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর মথগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই মথের সামনের ডানাগুলো আকর্ষণীয় খয়েরী-বাদামী রঙের হয়ে থাকে আর নিচের ডানাগুলো হয় বেগুনী, লাল, হলুদ রঙের আর সেই সাথে ডানের চারপাশে থাকে কালো রঙের রূপরেখা।
মজার ব্যাপার হলো, এটলাস মথের ডানার উপরিভাগের বাঁকা অংশটির অনন্য রঙ ও নকশার ফলে দূর থেকে এটিকে দেখতে সাপের ফনার মতো দেখায়। এরা ডানা মেলে শত্রুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মথ হওয়ার সত্ত্বেও এটলাস মথ ডিম থেকে বের হওয়ার পর কিন্তু কোনো খাদ্যই গ্রহণ করে না। কারণ এদের আসলে কোনো মুখই নেই!
৯. স্বচ্ছ ডানার প্রজাপতি
প্রজাপতি বরাবরই সুন্দর একটি পতঙ্গ। তবে এদের মধ্যে অন্যতম সুন্দর প্রজাপতি হলো স্বচ্ছ ডানার প্রজাপতি বা গ্লাস উইংড বাটারফ্লাই। সুন্দর আর স্বচ্ছ ডানার জন্যই এদের এমন নামকরণ করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এদের ডানায় সূর্যের কিরণ প্রতিফলিত হয় না, বরং সূর্যরশ্মি এদের ডানা ভেদ করে যায়। অদ্ভুত সুন্দর এই প্রজাপতিদের দেখা মেলে সাধারণত মধ্য আমেরিকার উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলের বাগানে কিংবা বনে।
ডানা মেলা অবস্থায় এই প্রজাপতিগুলো আকারে ৫.৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্বচ্ছ ডানার কারণে এদের খুঁজে বের করা একটু কঠিন হয়ে যায়। আর এই বৈশিষ্টের মাধ্যমেই এরা বিভিন্ন শিকারি পাখির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে। তবে এই প্রজাপতির ডানার কিনারাগুলো গাঢ় বাদামী রঙের হয়। যার ফলে আমরা এই অদ্ভুত সুন্দর প্রজাপতিগুলোকে দেখতে পাই।
৮. হামিংবার্ড মথ
সুন্দর পাখির তালিকায় হামিংবার্ডের নাম বরাবরই রয়েছে। আর যে পোকা দেখতে হামিংবার্ডের মতো তার নাম সুন্দর পোকার তালিকায় না থাকলে কি চলে?
নানা রঙে রঙিন সুন্দর ডানার এই মথগুলো দেখতে অনেকটা আসল হামিংবার্ডের মতোই। মুখের কাছে এদের রয়েছে একটি লম্বা চোষক অঙ্গ, যা দেখতে ঠিক হামিংবার্ডের ঠোঁটের মতোই। আকারেও এরা একটি হামিংবার্ডের সমান। সুন্দর এই মথগুলোকে দেখতে পাওয়া যায় পর্তুগাল থেকে জাপান হয়ে বিশ্বের উত্তরের দেশগুলোতে। তবে এরা সাধারণত উষ্ণ আবহাওয়াযুক্ত অঞ্চলেই স্থায়ীভাবে বাস করে।
৭. প্রার্থনারত ম্যান্টিস
প্রার্থনারত ম্যান্টিস বা প্রেইং ম্যান্টিস নামে পরিচিত এই সুন্দর পোকাগুলোর সামনের পা পেছনের পায়ের থেকে লম্বা। এগুলো এমনভাবে ভাঁজ করা থাকে যে দেখে মনে হয়, পোকাগুলো যেন প্রার্থনা করছে। আর এজন্যই এদের এই নাম। বিশ্বে এখনও পর্যন্ত ম্যান্টিসের প্রায় ১,৮০০টি প্রজাতি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। পৃথিবীর গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে এদের দেখতে পাওয়া যায়।
অদ্ভুত সুন্দর এই পোকাগুলোর রয়েছে একটি লম্বা ঘাড়, তিনকোণা একটি মাথা আর সুন্দর বড় বড় দুটি চোখ। এদের মাথার নমনীয় জোড়গুলোর জন্য এরা এদের মাথা ১৮০ ডিগ্রী কোণে ঘুরাতে পারে। এদের সুন্দর সবুজ গায়ের রঙ এদেরকে গাছপালার সাথে মিশে থাকতে সাহায্য করে, যার ফলে এরা নানা বিপদের হাত থেকে রক্ষা পায়।
৬. ফিলবার্ট উইভিল
ফিলবার্ট উইভিল হলো ছোটখাট ও দেখতে আকর্ষণীয় এক নিরীহ গোছের পোকা। উত্তর আমেরিকার পশ্চিমের অঞ্চলগুলোতে এদের দেখতে পাওয়া যায়। এই পোকা দেখে আপনার মনে হতে পারে এটি বুঝি কোনো কার্টুন কিংবা অ্যানিমেশন মুভির জগত থেকে উঠে এসেছে। তবে ওক গাছের কিছুটা ক্ষতি করে বলে এদেরকে আসলে ক্ষতিকর কীট হিসেবে ধরা হয়।
ছোট্ট এই পোকার রয়েছে চমৎকার একটি শুঁড়। তবে এদেরকে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। কারণ এদের বাদামী গায়ের রঙের ফলে এরা খুব সহজেই ওক গাছের সাথে লুকিয়ে থাকতে পারে।
৫. লেডিবাগ
লেডিবাগকে হয়তো আমরা প্রায় সবাই চিনি। চমৎকার গায়ের রঙ আর ডিম্বাকার আকৃতির জন্য এরা বিখ্যাত। পৃথিবীতে প্রায় ৫,০০০ প্রজাতির লেডিবাগ দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে অনেকের গায়ের রঙ অনেক রকম হলেও কমলা বা লাল রঙের লেডিবাগই সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
চমৎকার সুন্দর এই পোকার গায়ের লাল রঙ আসলে এদের শিকারিদের জন্য বিপদসংকেত হিসেবে কাজ করে। ভয় পেলে এরা এদের পা থেকে এক ধরনের তরল পদার্থ নিঃসরণ করে যার ফলে শিকারির কাছে এরা বিস্বাদ খাবারে পরিণত হয়। সুন্দর লেডিবাগ কিন্তু কৃষকের জন্য বন্ধু পোকা হিসেবে কাজ করে। কারণ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতিকর পোকা খেয়েই মূলত এরা বেঁচে থাকে।
৪. ক্রিসমাস বিটল
ক্রিসমাস বিটল হলো অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী চমৎকার আকর্ষণীয় রঙ বিশিষ্ট সুন্দর একটি পোকা। শুধুমাত্র ক্রিসমাসের সময়ই দেখতে পাওয়া যায় বলে এদের এই নাম দেওয়া হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় এই পোকার প্রায় ৩৫টির মতো প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। এরা সর্বোচ্চ ২০ মিলিমিটার পর্যন্ত বড় হয়ে থাকে। চমৎকার উজ্জ্বল রঙের জন্য এরা খুবই বিখ্যাত। এদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রজাতি সবুজ, সোনালী ও বাদামী রঙের হয়ে থাকে।
৩. এমরাল্ড সোয়ালোটেইল
দক্ষিণ এশিয়ার বনগুলোর স্থানীয় বাসিন্দা এই এমরাল্ড সোয়ালোটেইল হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও রঙিন প্রজাপতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এরা এমরাল্ড পিকক নামেও বেশ পরিচিত। এদের নামের মতোই এদের ডানাগুলোতে গাঢ় সবুজ কিংবা কালো রঙের উপর এমরাল্ড বা পান্নার মতো সবুজ রঙের নকশা করা থাকে। এদের ডানার নিচের অংশটি কমলা রঙের এবং তাতে নীল-কালো ছোপ থাকে। ডানা মেললে এদের আকার হয় প্রায় ৩.৯ ইঞ্চি পর্যন্ত।
২. অর্কিড মৌমাছি
বিশ্বের সবচেয়ে রঙিন পোকাগুলোর মধ্যে অন্যতম পোকা হলো এই অর্কিড মৌমাছি। বিশ্বে এদের প্রায় ২০০টির মতো প্রজাতি খুঁজে পাওয়া যায়। এরা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার গ্রীষ্মপ্রধান এলাকাগুলোতে বসবাস করে। এই অদ্ভুত সুন্দর পোকাগুলোকে ধাতব নীল, সবুজ, বেগুনী, সোনালী ইত্যাদি নানা রঙে দেখতে পাওয়া যায়।
এদের নাম অর্কিড মৌমাছি হওয়ার কারণ হলো এরা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের প্রায় ৭০০টি প্রজাতির অর্কিডের পরাগায়ন ঘটাতে সাহায্য করে। চমৎকার রঙের এই মৌমাছিগুলোর আরেকটি মজার বৈশিষ্ট্য হলো এদের লম্বা জিভ। এদের লম্বা জিভটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১.৬ ইঞ্চির কাছাকাছি হয়ে থাকে। এর সাহায্যে এরা ফুলের গভীর থেকে মধু সংগ্রহ করে।
১. সেক্রোপিয়া মথ শুঁয়াপোকা
বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর পোকার খেতাব যে পোকাটির দখলে তার নাম হলো সেক্রোপিয়া মথ, শুঁয়োপোকা। এই পোকাটির মতো সুন্দর ও নানা রঙে রঙিন পোকা হয়তো আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুঁয়োপোকা দশার পরবর্তীতে এই মথগুলো ডানা মেলা অবস্থায় আকারে প্রায় ৬ ইঞ্চির বেশি হয়ে থাকে। এরাই উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় মথ। মথগুলো দেখতে অনেক সুন্দর হয়, তবে মথের চেয়ে শুঁয়োপোকা দশাতেই এরা বেশি সুন্দর। এই লার্ভাগুলো সাধারণত ম্যাপল গাছে বাস করে।
ডিম থেকে বের হওয়ার পর সেক্রোপিয়া মথ কালো রঙের হয়। ধীরে ধীরে বড় হওয়ার সময় এদের গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উঁচু স্থানে কালচে লোম জন্মায়। এই উঁচু স্থানগুলোই সবুজ, নীল, হলুদ ও কমলা রং ধারণ করে। আর এগুলোই এদেরকে দেয় অদ্ভুত রঙিন এক সৌন্দর্য, যা যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।
ফিচার ইমেজ – wikimedia.org