মানুষ নিজেকে দিয়ে অন্যান্য প্রাণীর বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ করে এসেছে সবসময়। আর সেই পরিমাপে, একুশ শতকের আগপর্যন্তও পাখিরা সবসময় পিছিয়ে থেকেছে। আসলেই, এটুকু মাথায় আর কতটাই বা বুদ্ধি ধরে! এবার অবশ্য একটু অন্যরকম কিছুই ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। আর তাদের এই ভাবনা আমাদের চেনা পরিচিত কাকের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। অনেকদিন ধরে পর্যবেক্ষণের পর জানা গিয়েছে যে, কাকের বুদ্ধি অতটাও কম নয়। কাক যে ধূর্ত, তা তো আমরা জানি। তবে এর পাশাপাশিও মানুষকে চেনা, নতুন নতুন কৌশল শেখার মতো কিছু ইতিবাচক দিক আছে কাকের। আর এ ব্যাপারগুলোই ভাবতে বাধ্য করেছে গবেষকদের।
বেটি, ২০০০
বেটি নামের কাকটিকে দেখে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সেবার বেশ অবাক হয়ে পড়েছিলেন। বেটি মাথা খাটিয়ে একটা তারকে হুকের মতো করে বাঁকিয়ে নেয়। আর এই পুরো কাজটা সে করে ভালোভাবে নিজের পছন্দসই মাংসের টুকরোকে আটকানোর জন্য। এ ব্যাপারটি দেখে সবাই সেবার হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন আক্ষরিকভাবেই। কাকের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা আছে এবং বেটি নিজের চারপাশ থেকে দেখে এই শিক্ষা অর্জন করেছে- এমনটাই মনে করেন তারা। বেটিকে অনেকে সবচাইতে বুদ্ধিমান পাখির তকমাও দিয়ে দেন সেই সময়।
তবে পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে ভুল ধারণা ভাঙে। গবেষকেরা জানতে পারেন যে, বেটি আশ্চর্য কোনো পাখি নয়। এটি মূলত নিউ ক্যালেডোনিয়ান প্রজাতির একটি পাখি, যেটি জন্মগতভাবেই এই নরম কিছু বাঁকিয়ে ফেলার কৌশল শিখে নেয়। এ প্রজাতির সবগুলো পাখিই এই কাজটি করে থাকে। প্রাথমিকভাবে গবেষকেরা এ প্রজাতির কাকের নির্দিষ্ট এই দিকটি জানতেন না বিধায় বেটি কৌশলটি নিজ থেকেই শিখে ফেলেছে বলে মনে করেন। ক্যালেডোনিয়ান কাক করভিড প্রজাতির পাখিদের মধ্যে অন্যতম। দীর্ঘদিন ধরে এ প্রজাতির পাখিদের মস্তিষ্কের উপরে গবেষণা করার পর গবেষকেরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এদের মানসিক দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করার প্রক্রিয়া অন্যদের চাইতে অনেক বেশি ও দ্রুত। বেটি যদিও প্রাকৃতিকভাবেই কিছু কৌশল শিখেছিল, তবে সেটি মানসিক দক্ষতা নয়- এমনটা বলা যাবে না।
এ প্রজাতির পাখিগুলো কেন এমন করে? এ কাজের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে গাছের গর্ত থেকে পোকামাকড়কে বের করে আনা। পাখিগুলো ছোট ডাল বাঁকা করে এর মাধ্যমে গাছের গর্তে থাকা পোকা বের নিয়ে আসে। গবেষণায় নির্দিষ্ট রকমের ডালকে অন্যান্য ডাল ও পাতার আড়ালে রেখে দেওয়া হয়। তবে পাখিগুলো সেখান থেকে অনেক ডাল-পাতার মধ্যেও নিজেদের জন্য বাঁকা করতে পারার উপযোগী ডাল খুঁজে বের করে আনে। অর্থ্যাৎ, এই ঘটনাটি শুধু পাখির মনে রাখার ক্ষমতারই নয়য়, বুদ্ধিমত্তারও প্রকাশ ঘটায়।
ম্যাকগোয়ান এবং অন্যান্য গবেষণা
পাখি, বিশেষ করে কাকের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অবশ্য কাজ করেন গবেষক ম্যাকগোয়ানও। তিনি বলেন যে, পাখি চেহারা চিনতে পারে, এমনকি কারো চেহারা দেখে ভয় পেতে পারে। এছাড়া, এদের মনে রাখার ক্ষমতা বা স্মৃতিশক্তিও রয়েছে। ম্যাকগোয়ান বলেন,
“একেকজন মানুষ যে একেকরকম এবং তাদের সাথে যে ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যবহার করা উচিত, এ নিয়ে এদের ভালো ধারণা রয়েছে”
২০১৫ সালে ‘বিহেভিয়রাল ইকোলজি অ্যান্ড সোশিওবায়োলজি’ জার্নালে জানানো হয় যে, কাকেরা যাদের সাথে আগে পরিচিত হয়েছে তাদের সাথে পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ করার সময় তুলনামূলকভাবে বেশি সহজ বোধ করে। ম্যাকগোয়ান নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানান যে, তিনি প্রথম গবেষণাগারে যখন প্রবেশ করেন, তখন সেখানকার কোনো কাক তাকে পছন্দ না করলেও পরবর্তী সময়ে তার উপস্থিতি সবার আগে কাকেরাই টের পেতে শুরু করে এবং তারা বেশ পছন্দও করা শুরু করে ম্যাকগোয়ানকে। যদিও এজন্য কাকেদের প্রতিদিন বেশ ভালো পরিমাণ খাবার দিতে হয়েছিলো তাকে। তবে কৌশল যেটিই হোক না কেন, কাকেরা যে তাদের পরিচিত মানুষ, মানুষের চেহারা এবং সে কেমন, সেটি মনে রাখতে পেরেছে, তা-ই ছিল এই গবেষণার মূল ফলাফল।
২০১৫ সালে প্রকাশিত আরেকটি জার্নালে ‘অ্যানিমেল বিহেভিয়র’এ দেখানো হয় যে, নির্দিষ্ট একটি গবেষণায় একদল গবেষক মুখে মুখোশ পরে, কাকের মৃতদেহ নিয়ে ওয়াশিংটনের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়ান। পরবর্তী সময়ে একই মুখোশ পরে হাতে কোন কাকের মৃতদেহ ছাড়া গেলেও এই গবেষক দলের উপরে আক্রমণ করে কাকেরা।
আমাদের পূর্ববর্তী বংশধর, বনমানুষদের মস্তিষ্কে একটি নির্দিষ্ট রকমের গঠন খুঁজে পাওয়া যায়। একে নিও-কর্টেক্স বলা হয়। এর মাধ্যমে উন্নত চিন্তা করা সম্ভব হয়। কিন্তু করভিড প্রজাতির মস্তিষ্কে এমন গঠন খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এই প্রজাতির মস্তিষ্কের যে গঠন, সেটিকেও খুব একটা কম বলা যায় না। এদের মস্তিষ্কের কিছু উল্লেখযোগ্য স্নায়ু রয়েছে, যেটি বেশ ভালোরকম মানসিক দক্ষতার প্রকাশ করে। এখানে অবশ্য মস্তিষ্ক নয়, আরও উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যাপার রয়েছে। আদিমানব এবং করভিডদের মধ্যে ব্যবহারের দিক দিয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
এই দুই প্রজাতিই খুব সহজে যেকোনো পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে এবং সমস্যা, পরিবর্তন ইত্যাদি সামলে নিয়ে সমাধান খুঁজে বের করাটাও তাদের স্বভাবের মধ্যে পড়ে। এটি খুব অবাক করার মতো ব্যাপার যে, দুটো ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি দু’ভাবে বেড়ে উঠেও একইরকম কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করছে। ধীরে ধীরে এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন মানুষকে সাহায্য করেছে, তেমনই কাউকে চেনা, বিপদকে আগে থেকে টের পাওয়া ও নতুন কিছু শেখার এই ব্যাপারগুলো করভিড প্রজাতিকেও সাহায্য করবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
আপনি হয়তো ভাবছেন, প্রাণীদের মধ্যে সবারই কম বেশি বুদ্ধিমত্তা রয়েছে। আর এই বুদ্ধিমত্তার তালিকায় সবচাইতে ওপরে আছে মানুষের নাম। ব্যাপারটা কিছুটা সত্যি। মানুষ অন্যান্য প্রাণীর চাইতে বেশি বুদ্ধিমত্তার চর্চা করে। তবে, ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু প্রাণী মানুষের চাইতেও বেশি দক্ষতা প্রকাশ করে। এই যেমন- শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে মানুষের চাইতে বেশি স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা দেখা যায়। এতে করে বনের মধ্যে নিজেদের খাবার ঠিক কোথায় আছে, সেটি খুঁজে বের করতে তাদের জন্য সহজ হয়।
মূলত, বুদ্ধিমত্তার হিসাব করাটা খুব কঠিন। এটি যেমন প্রাকৃতিকভাবে যে কৌশলগুলো আসে সেগুলোর মধ্যেও বিদ্যমান, তেমনই স্বাভাবিকের বাইরে গিয়ে নিজের মতো করে কোনো পদ্ধতি তৈরি করে নেওয়াতেও প্রকাশ পায়। বিবর্তনের সাথে সাথে সাধারণত কিছু প্রাণী নিজেদের মধ্যে কিছু অভ্যাস আয়ত্ত করে নেয়। আর সেটিও নিজেদের বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। এজন্যই গরু নিজের কিছু সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই নানান কৌশলে খাবার খায়। অন্যদিকে, জিরাফ খাবার খাওয়ার জন্য শুধু গলাটা বাড়িয়ে দেয়। সম্প্রতি ০০৭ নামে এক নিউ ক্যালেডোনিয়ান ধাঁধার সমাধান করার দক্ষতা প্রকাশ করে।
এই যে নতুন কিছু করা, এই যে মানুষকে চেনা, ছবি আঁকা বা যন্ত্রপাতির সাথে কাজ করা- এই সবকিছুই প্রাণীদের মানসিক দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার জানান দিচ্ছে। যেটি পরবর্তী সময়ে হয়তো আরও বাড়বে। মানুষ নিজের মস্তিষ্ককে বেশি ব্যবহার করছে, অন্যান্য প্রাণী কিছুটা কম। তবে শুধু কাক নয়, ভবিষ্যতের প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই এই অনুশীলনের পরিমাণ আরও বাড়বে। অন্তত, নিউ ক্যালেডোনিয়ান কাকেদের পর এমনটা আশা করাই যায়!
বিজ্ঞানের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/