কিছুদিন পরপরই পত্রিকায় খবর আসে যে, সম্পত্তির জের ধরে সৃষ্ট বিবাদে ছেলের হাতে বাবা খুন, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন এবং এমনই আরো অনেক মর্মান্তিক খবরাখবর। অর্থকড়ি আসলে এমনই এক জিনিস, যা ছাড়া আমাদের চলে না। আবার সেটা বেশি হয়ে গেলে অনেকের লোলুপ দৃষ্টিতে সেই অর্থকড়িই আমাদের জীবনকে নরকের মতো বানিয়ে ফেলতে পারে নিমিষেই।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পূর্বে সাধারণত স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তি তাদের সন্তানদের নামে লিখে রেখে যান। এদেশে অন্তত আমরা এমনটাই দেখে আসছি। ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনার দেখা মেলে ইউরোপ-আমেরিকার মতো স্থানগুলোতে। সেখানকার লোকজনের পশুপ্রেম কখনো কখনো এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, আত্মীয়স্বজনকে বাদ দিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পত্তি তারা নিজেদের পোষা প্রাণীদের নামে লিখে দিয়ে যেতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। অবশ্য এই প্রাণীগুলো সেই বিপুল পরিমাণ অর্থের মর্ম অনুধাবন করতে পারে কিনা তা জানার কোনো উপায় নেই!
যা-ই হোক, তেমনই কিছু সৌভাগ্যবান প্রাণীর গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের এ লেখা।
১) তৃতীয় গান্থার এবং চতুর্থ গান্থার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যধিক পরিচিত গৃহপালিত পশু হলো এই কুকুর। অবশ্য বিড়ালকে সবাই যতটা সহজে আপন করে নিতে পারে, কুকুরের বেলায় সেটি সম্ভব হয় না। এটি মূলত এর কর্কশ কণ্ঠে ঘেউ ঘেউ ডাকের কারণেই।
তবে সে যা-ই হোক, দিনশেষে কুকুরের মতো প্রভুভক্ত প্রাণী পাওয়া আসলেই বেশ কঠিন। সেই সাথে সে আপনার এবং আপনার বাড়ির প্রহরীর কাজটিও করে দিচ্ছে অসাধারণভাবেই। ফলে যাদের বাসায় পোষা কুকুর আছে, তারা যে সেটাকে কতটা ভালোবাসে এবং কতটা আদর-যত্ন করে, সেটা তো আমরা সেসব বাসায় গেলেই দেখতে পাই।
এমনই একজন হলো কারলোটা লাইবেন্সটাইন। ‘তৃতীয় গান্থার’ নামে তার একটি পোষা জার্মান শেফার্ড প্রজাতির কুকুর ছিল। তিনি কুকুরটিকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, মৃত্যুর আগে নিজের প্রায় ৬৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার সমমূল্যের সম্পত্তি তিনি লিখে দিয়ে যান নিজের প্রিয় এই কুকুরটির নামে! ১৯৯২ সালে কারলোটা মারা গেলে তৃতীয় গান্থার মালিক হয় সেই ৬৫ মিলিয়ন ডলার সম্পত্তির।
বিশাল সেই সম্পত্তির মাঝে বেশ সুখেই জীবনের বাকি দিনগুলো কেটে গিয়েছিল তৃতীয় গান্থারের। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে একসময় মৃত্যু হয় তার। তখন উত্তরাধিকারসূত্রে তার সেই সম্পত্তির মালিক হয় তারই ছেলে ‘চতুর্থ গান্থার’। কুকুর পিতার সম্পত্তি যতদিনে কুকুর পুত্রের হস্তগত হয়, ততদিনে সেই সম্পত্তির মূল্য গিয়ে ঠেকেছিল ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলারে!
বর্তমানে বেশ আরাম আয়েশের মধ্য দিয়েই দিন কাটছে চতুর্থ গান্থারের। ইতালি ও বাহামাস দীপপুঞ্জে রয়েছে তার নিজস্ব ম্যানশন। সঙ্গীতশিল্পী ম্যাডোনার মালিকানাধীন একটি বাড়িও কেনা হয়েছে গান্থারের জন্য। আটটি বেডরুমওয়ালা সেই বাড়িটি কেনা হয়েছিল সাড়ে সাত মিলিয়ন ডলারে। কাহিনী এখানেই শেষ না। ম্যাডোনা যে বেডরুমে ঘুমাতেন, চতুর্থ গান্থারও ঠিক সেই বেডরুমেই ঘুমাতো!
সৌভাগ্যক্রমে বিপুল সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া গান্থার তার বাবা সিনিয়র গান্থারকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাতেই পারে। কারণ, তার বাবার রেখে যাওয়া ২০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির আজ মূল্য গিয়ে ঠেকেছে ৪০০ মিলিয়নে! নিজের লিমুজিনে চড়ে ঘুরে বেড়ায় সে, গাড়িটা অবশ্যই মানব-চালকই চালায়! তার ঘেউ ঘেউ শুনলেই এসে হাজির হয় একজন ভৃত্য। তার রয়েছে নিজস্ব একটি সুইমিং পুল, যেখানের সবকিছু তার পছন্দ অনুসারেই ঠিক করা আছে।
২) ট্রাবল
কুকুরটির নাম যেমন ট্রাবল, বাস্তবেও সে ঠিকই বেশ বিপদেই পড়েছিল। অবশ্য সেই বিপদের কতটা যে সে আঁচ করতে পেরেছিল, সেটি অবশ্য চিন্তার বিষয়। কারণ, পশু হয়ে মানবজতির সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ির সেই বহু পুরনো দ্বন্দ্ব অনুভবের ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা যে তাকে দেননি! ঘটনা খুলেই বলা যাক।
২০০৭ সালের আগস্টে ট্রাবলের মালিক লিওনা হেমস্লের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি নিজের ১২ মিলিয়ন ডলার দান করে যান ট্রাবলকে। আসলে এটি কিন্তু হেমস্লের পুরো সম্পদ ছিল না। নিজের সম্পত্তির অধিকাংশই তিনি দান করে গিয়েছিলেন বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায়। তবে হেমস্লের যেকোনো আত্মীয়ের তুলনায় ট্রাবলের অর্থপ্রাপ্তির পরিমাণটা ছিল অনেক বেশি।
হেমস্লের ভাই আলভিন রোজেনথালও মিলিয়ন ডলার পেয়েছিলেন। তবে তাকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তাকে নিয়মিত ট্রাবলের দেখাশোনা করতে হবে। কেবলমাত্র তাহলেই তিনি সেই অর্থ ভোগ করতে পারবেন। হেমস্লের চার নাতি-নাতনীর মাঝে দুজনকে তিনি পাঁচ মিলিয়ন ডলার করে দান করে গিয়েছিলেন। বাকি দুজনকে কোনো এক কারণবশত দেননি।
এরপরেই ক্ষেপে যান হেমস্লের আত্মীয়রা। তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে অভিযোগ জানান এমন সম্পদ বন্টনের বিরুদ্ধে। আদালতও রায় দেয় এই বলে যে, সম্পত্তির বিলি-বন্টনের সময় হেমস্লে মানসিকভাবে সুস্থিত ছিলেন না। ট্রাবলের ভাগ্যের শেষপর্যন্ত তাই ২ মিলিয়ন ডলার জোটে।
সেটাই বা কম কীসে!
৩) টমাসো
দুটো কুকুরের গল্পের পর এবার বেড়ালের দিকে নজর ফেরানো যাক। এখন আমরা যে বিড়ালটির কথা বলতে যাচ্ছি, তার নাম টমাসো। আর এই টমাসোর কাহিনী অনেকটাই বাংলা সিনেমার পথের ভিখারি থেকে লটারি জিতে বিশাল বড়লোক বনে যাবার মতোই।
টমাসো ছিল একটি রাস্তার বিড়াল। আমাদের দেখা আট-দশটা সাধারণ বিড়ালের মতো টমাসোও পথে পথে ঘুরে নিজের অন্ন সংস্থান করে বেড়াতো। কিন্তু একদিন সে পড়ে যায় মিসেস মারিয়া আসুন্তার নজরে। স্বামী হারানো বয়স্ক এ নারী প্রথম দেখেই কালো রঙের এ বিড়ালটিকে পছন্দ করে ফেলেন।
এরপর তিনি বিড়ালটিকে বাসায় নিয়ে আসেন, নাম দেন টমাসো, প্রতিপালন করতে থাকেন নিজের সন্তানের মতো করেই। কোনো সন্তান-সন্ততি না থাকায় নিজের পুরো ১৩ মিলিয়ন ডলারই তিনি দান করে যান টমাসোর নামে।
এখানে অবশ্য একটা ঝামেলা ছিল। ইতালীর আইনানুযায়ী, কোনো প্রাণীই উত্তরাধিকারসূত্রে কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারবে না। তবে যদি কোনো ট্রাস্টি খুঁজে পাওয়া যায়, তবে তার তত্ত্বাবধানে সেই প্রাণীটি দানকৃত সম্পদের সুবিধাভোগী হতে পারবে। এজন্য মিসেস মারিয়া তার আইনজীবীদের অনুরোধ করেন প্রাণীদের জন্য কাজ করা কোনো সংগঠনকে খুঁজে বের করতে, যাদের মাধ্যমে তিনি তার মৃত্যুর পরেও টমাসোর ভালো থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তেমন কোনো সংগঠনকেই খুঁজে পাওয়া না গেলে মারিয়ার নার্স স্টেফানিয়াই হন সেই ট্রাস্টি।
৪) সামান্থা
আবারও কুকুর, আবারও সম্পদপ্রাপ্তি, আবারও আইনের কাঠগড়ায় দৌড়াদৌড়ি।
১৯৯৬ সালে ৬০ বছর বয়সী সিডনি আল্টম্যান তার প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের সম্পদ দান করে যান প্রিয় পোষা কুকুর সামান্থার নামে। সেই সাথে সাড়ে তিন লাখ ডলারের নগদ অর্থও ছিল। ওদিকে ম্যারি ডানা নাম্নী এক নারীর সাথে আল্টম্যানের সম্পর্ক ছিল অনেকদিনের। দলিল অনুযায়ী, ডানা যদি সামান্থার অভিভাবকের দায়িত্ব নেয়, তাহলে সে বছরে ৬০,০০০ ডলার করে পাবে। সেই সাথে ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত আল্টম্যানের বেনেডিক্ট ক্যানিয়ন নামক বাড়িতেও তিনি থাকতে পারবেন।
তবে সমস্যা হলো, সেই বাড়িটিতে ডানার ততদিনই থাকার অনুমতি ছিল যতদিন সামান্থা বেঁচে থাকে। তার মৃত্যুর পর দলিল অনুযায়ী ডানার আর কোনো অর্থ পাওয়ার উপায় ছিল না। সেই সাথে তাকে বাড়িটিও ছেড়ে চলে যেতে হতো। আর বাড়ি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ কোনো প্রাণীদের দাতব্য সংস্থাকে দিয়ে দেয়ার কথাও বলা হয়েছিল।
প্রায় ছ’বছর ধরে আল্টম্যানের সাথে থাকা ডানা স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। ওদিকে সামান্থার বয়স ততদিকে গিয়ে ঠেকেছিল ১৫ বছরে, যা কিনা একটি কুকুরের জন্য বেশ ভালোই বয়স। ফলে খুব বেশিদিন যে ডানা অর্থকড়ি লাভ করতে পারবেন না, তা তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। সেজন্য আল্টম্যানের সম্পদের ২.৭ মিলিয়ন ডলার দাবি করে তিনি আদালতের দ্বারস্থও হয়েছিলেন।
৫) জিজু
কুকুর-বিড়ালের গল্প তো অনেক হলো। এবার তাহলে আরেকটি পোষাপ্রাণীর দিকে নজর দেওয়া যাক। সেটা কী হতে পারে বলুন তো? একটি মুরগি! হ্যাঁ, একটি মুরগি নিয়েই এখন কথা বলবো আমরা।
২০০২ সালে জিজুর মালিক মাইলস ব্ল্যাকওয়েলের স্ত্রী ব্রায়োনি রাসায়নিক সংবেদনশীলতার কারণে মারা যান। এর তিন সপ্তাহ পর মারা যান ব্ল্যাকওয়েল নিজেও। যেহেতু তাদের কোনো সন্তান-সন্ততি ছিল না, তাই দ্বিধাহীনভাবেই তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার তারা লিখে দিয়েছিলেন জিজুর নামে।
অবশ্য এটাই কিন্তু ব্ল্যাকওয়েল-ব্রায়োনি দম্পতির সম্পত্তির শেষ না। এরপর তারা আরো ৪২.৫ মিলিয়ন ডলার দান করে গিয়েছিলেন টাবনি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামক এক দাতব্য সংস্থায়। সঙ্গীত, চিত্রকলা ও প্রাণীদের দেখাশোনার জন্য ১৯৯৭ সালে তারা এ সংস্থাটি চালু করেছিলেন।
ফিচার ইমেজ: USA Today