অ্যামাজান, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বনভূমি। পৃথিবীর মোট রেইন ফরেস্টের অর্ধেকের বেশি এই মহাবনের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ জ্ঞানে যাদের দখল ভালো, তারা অ্যামাজানের বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক তথ্যই হয়তো জানেন। কিন্তু এই সুবিশাল বনভূমির অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তরভাগ বরাবরই থেকে যায় এক গাঢ় গোপনীয়তার অন্তরালে। যেখানে শুধুই প্রকৃতির নিয়ম চলে, সেখানে এমন অনেক কিছুই বিরাজ করে যা সাধারণ মানুষদের কাছে রীতিমতো ভয়ানক।
নয়টি দেশজুড়ে বিস্তৃত এই অ্যামাজান বনভূমি উদ্ভিদ ও প্রাণীর এক বিশাল অভয়ারণ্য। এখানে রয়েছে ৩৯০ বিলিয়ন বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রায় ১৬,০০০ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। কিছু বিজ্ঞানীর মতে, প্রতি ৩ দিনে অ্যামাজানে একটি নতুন প্রজাতির প্রাণী আবিষ্কৃত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে প্রাণীগুলোর বাস এই অ্যামাজানেই। এদের মধ্যে কেউ তাদের নিজস্ব ছান্দিক ভঙ্গিমায় অতি সাবলীল, কেউ ফটোগ্রাফারদের আকর্ষণের বস্তু। তবে বেশিরভাগ প্রাণীই ভয়ানক বিপজ্জনক, নিজের ভালোর জন্যেই এদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা শ্রেয়। নিরীহ দর্শন প্রাণীগুলোও হতে পারে বিপদের মূর্ত অবতার। আসুন চিনে নিই আমাজানের বৈচিত্রময় প্রাণীজগতের কিছু বিশেষ অংশ।
গ্রীণ অ্যানাকোন্ডা
অ্যামাজানের নদীগুলোতে ওৎ পেতে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ভারী এবং সবচেয়ে শক্তিধর সাপ সবুজ অ্যানাকোন্ডা। লম্বায় এরা হয় ৩০ ফিট আর ওজনে ৫৫০ পাউন্ডেরও (২২৭ কেজি) বেশি। এরা সমগ্র জীবনকাল ধরেই বাড়তে থাকে। ছোট ছোট শিকার এরা দিনে প্রায় ৪০ পাউন্ড পরিমাণে খেতে পারে। অবশ্য বড় শিকার গলাধঃকরণ করতে পারলে পুরো এক সপ্তাহ আর খেতে হয় না।
নারী অ্যানাকোন্ডা দৈর্ঘ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি বড় হয়। এরা ২ ফুট দৈর্ঘ্যের, একবারে ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চার জন্ম দেয়। অতিরিক্ত ওজনের কারণে ভূমিতে বেশি দ্রুত নড়াচড়া করতে না পারলেও পানিতে এরা অনেক দ্রুত ও সাবলীলভাবে চলাফেরা করতে পারে। এদের খাবার তালিকা থেকে বাদ যায় না কিছুই।
যাকেই এরা শক্তিতে পরাজিত করতে পারবে বলে মনে করে, তাকেই দ্রুততার সাথে আঘাত করে পেঁচিয়ে ধরে। এই আলিঙ্গন এর বন্ধন ছাড়ায় এমন সাধ্য নেই কারো। শিকারকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে এরা বেশিরভাগ সময়ই টেনে নিয়ে যায় পানিতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শিকার দম আটকে মারা যায়, এরপর তার হাড়গোড় ভেঙ্গে সুবিধামতো আকৃতিতে নিয়ে এসে সোজা পেটে চালান করে দেয় এই নীরব দানব। জাগুয়ার, কেইমান, বন্য শুয়োর, হরিণ থেকে শুরু করে এই তালিকায় বাদ যায় না মানুষও। বিশেষ করে কম বয়সী মানব শিশু হলে তো কথাই নেই। মাপমতো খাবার পেলে এই গ্রীণ অ্যানাকোন্ডা পুরো মাসব্যাপী না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। সুতরাং ভাগ্যক্রমে এই দানবের সামনে পড়ে গেলে শুধু ভাগ্যের জোরেই আপনি বাঁচতে পারেন।
ব্ল্যাক কেইমান
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও অ্যামাজানের সবচেয়ে ভয়াবহ কুমীরদের মধ্যে অন্যতম এই ব্ল্যাক কেইমান। বানর, শ্লথ, পিরানহা, বন্য কুকুর, শুয়োর, অন্য কেইমান, এমনকি অ্যানাকোন্ডাও বাদ যায় না এদের খাদ্য তালিকা থেকে। শক্তিশালী চোয়াল দিয়ে তারা শিকার ধরে পানিতে ডুবিয়ে ফেলে। মুহূর্তে শিকারের দেহ গিলে ফেলতে পারে এরা। যদি শিকারের দেহ বেশি বড় হয়, তাহলে শিকার হত্যা করার পরে এরা কিছুদিন পচতে দেয়, তারপর ছোট ছোট কামড়ে খাওয়া শেষ করে। মানুষের উপরে আক্রমণের রেকর্ডও কেইমানের আছে। তবে ১৩ ফুটের চেয়ে বড় কেইমান দ্বারাই মানুষের আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি। ব্ল্যাক কেইমান ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
ইলেকট্রিক ইল
এমন কোনো প্রাণীর কথা কল্পনা করুন তো, যে নিজের দেহেই আপনার বাড়িতে ব্যবহার্য বিদ্যুতের তুলনায় ৫ গুন বেশি বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। এমনই এক প্রাণী ইল মাছ। এদের দেহে তিনটি এমন অঙ্গ আছে, যেগুলো একসাথে কাজ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এরা বিদ্যুতের সামান্য মাত্রা ব্যবহার করেই এদের শিকারকে ধরাশায়ী করতে পারে।
শিকারকে বিদ্যুতের শক দিয়ে বেহুঁশ কিংবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে এরা খেয়ে ফেলে। বিপদের মুখোমুখি হলে এই ইল মাছ উৎস ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত টানা ৫ মিনিট ধরে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ নিঃসরণ করে। অনেক অভিযাত্রীই পানিতে দুর্ঘটনাক্রমে ইলের গায়ে পা দিয়ে শক খেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা ধারণ করেছেন। একাধিক শক পেলে বা অত্যাধিক বিদ্যুৎ পরিবাহিত হলে মানুষ নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে পানিতে ডুবে মারা যেতে পারে।
পিরানহা
হলিউড মুভির দৌলতে পিরানহা নামক দাঁতালো হিংস্র মাছের কথা নিশ্চয় সবার জানা। ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ানো পিরানহা যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। একঝাঁক পিরানহা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একজন মানুষের দেহ ছিন্নভিন্ন করতে পারে।
পিরানহা মূলত মৃতভোজী। মৃত এবং মৃতপ্রায় প্রাণীদেহ এদের মূল খাদ্য। এছাড়া এরা পোকামাকড় ও জলজ উদ্ভিদও খেয়ে থাকে। এদের শক্ত চোয়াল আর সুসজ্জিত দাঁত বিশেষভাবে তৈরি মাংস ছিঁড়ে খাবার জন্যে। এদের ধারালো দাঁতের কবলে পড়লে মানুষের হাত-পা নিমেষে কেটেকুটে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেতে পারে। পিরানহার চোয়াল এমন বিশেষ যান্ত্রিক সজ্জায় গঠিত যা এদেরকে মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বলশালী কামড়ের অধিকারী করেছে। শুকনো মৌসুমে, সাধারণত খাদ্যের সংকটের সময় পিরানহা বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে।
জাগুয়ার
সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম আর আর দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বৃহত্তম বিড়াল শ্রেণীর প্রাণী হলো জাগুয়ার। এরা একা বাস করে। হরিণ, বুনো শুয়োর, বানর, সাপ ও অন্যান্য তৃণভোজী জীবজন্তু এদের প্রিয় খাবার। যদিও এদের মানুষের উপর আক্রমণের হার একেবারে নেই বললেই চলে, তবু এদের থেকে সতর্ক থাকা বাঞ্চনীয়। কারণ, জাগুয়ারের কামড় বিড়ালশ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কামড়। এদের সুতীক্ষ্ণ দাঁত আর্মাডিলো বা কচ্ছপের পুরু খোলসও ভেদ করে ঢুকে যায়। এমনকি শিকারের মাথার খুলি ভেদ করে সরাসরি মস্তিষ্কে পৌঁছে যেতে পারে এদের দাঁত। যেকোনো শক্তিশালী শিকারের ঘাড় মটকে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এদের চোয়াল।
পয়জন ডার্ট ফ্রগ
আমাজানের রঙ-বেরঙি প্রাণীকুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই পয়জন ডার্ট ব্যাঙ। এর বিচিত্র রঙমাখা শরীর যেন এক ধরনের সতর্কতাই নির্দেশ করে যে, “পারলে ছুঁয়ে দেখো!”
এই বিশেষ প্রজাতির ব্যাঙ তাদের ত্বক থেকে এক ধরনের বিষ নির্গত করে। এই বিষ অন্য কোনো প্রাণীর ত্বক দ্বারা বেশি পরিমাণে শোষিত হলে তাৎক্ষণিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারে। এই ব্যাঙের দেহে এত পরিমাণ বিষ জমা থাকে, যা ২০ জন মানুষ কিংবা ১০,০০০ ইঁদুর হত্যা করতে সমর্থ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বিষ তারা পায় তাদের খাদ্য বিভিন্ন পোকামাকড়ের দেহ থেকে। কারণ পরীক্ষাগারে এদের বন্দী রেখে আলাদা ধরনের খাদ্য দিয়ে দেখা গেছে যে এদের শরীরে বিষ তৈরি হয় না।
ভ্যাম্পায়ার বাদুড়
গল্পের বা টিভি সিরিজের মানুষ ভ্যাম্পায়ার নয়, এই ভ্যাম্পায়ার বাস্তব জলজ্যান্ত এক প্রজাতির বাদুড়। মেক্সিকো এবং সমগ্র মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে এদের দেখা পাওয়া যায়। এদের মুখের দু’পাশের লম্বা দাঁত এরা শিকারের শরীর থেকে রক্ত শোষণ করতে ব্যবহার করে। এদের মূল খাদ্যই রক্ত। গরু-ছাগল, ঘোড়া প্রভৃতি স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্ত খেতে এদের দেখা যায়। এমনকি সুযোগ পেলে এরা মানুষের গলাতেও দাঁত বসায়। টানা ৩০ মিনিট পর্যন্ত এরা রক্ত চুষে খেতে পারে।
এদের কামড় যদিও ব্যাথাদায়ক হয় না, তবে খুব বেশি রক্ত হারানো শরীরের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। কামড়ের জায়গাটিতে জীবাণু সংক্রমণ হবার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া কিছু বাদুড় র্যাবিস ভাইরাস বহন করে।
হিংস্র-নিরীহ সকল প্রাকার প্রাণীই আছে এই অ্যামাজানে। স্রষ্টার যেনো এক অনন্য ক্রীড়াক্ষেত্র এই মহাবন। প্রাণী ও উদ্ভিদের এই মহাঅভয়ারণ্য যুগ যুগ টিকে থাক জীববৈচিত্রের আধার হয়ে।
তথ্যসূত্র
১) en.wikipedia.org/wiki/Amazon_rainforest
২) worldatlas.com/articles/what-animals-live-in-the-amazon-rainforest.html
৩) ipfactly.com/top-15-dangerous-animals-amazon-rainforest/
৪) ascentoftheamazon.com/learning-resources/amazon-animals-a-to-z/
৫) en.wikipedia.org/wiki/Piranha