বুদ্ধিগুণে মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক জীবজন্তু রয়েছে যাদের আচার ব্যবহারও মানুষের বোঝার অসাধ্য। এসব জীব-জন্তুদের অবিশ্বাস্য সব ক্ষমতা অবাক করার মতোই। মাঝে মাঝে মানুষের কৌতুহলী প্রশ্ন করে, স্মরণশক্তির দিক দিয়ে মানুষের চেয়ে কি শিম্পাঞ্জির মতো প্রাণীরা এগিয়ে? কিংবা চিন্তা-শক্তির দিক দিয়ে মানুষের চেয়েও কি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে এই পুথিবীতে? যুগে যুগে মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-ব্যবহার, নিয়ম-শৃংখলার মাধ্যমে নিজেদের উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। পশু পাখিদের মতো প্রাণীদের বেলায় তো সে সুযোগ নেই। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে এসব প্রাণীরা কি তবে টপকে যেতে পারতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মনুষ্যকূলকে? কৌতূহলী মানব মন, এসবের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করেছে নানা অবাক করা তথ্য। সেরকম কিছু পশু-পাখিদের কথাই জানবো আজ।
জার্মানির গণিতজ্ঞ ঘোড়া হান্স
উনিশ শতকের শেষের দিকের কথা। জার্মান হাইস্কুলের গণিতবিদ ছিলেন উইলহেলম ভন অস্টেন। তিনি গণিতবিদ হলেও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল ফ্রানলজি বা করোটি সম্বন্ধীয় বিজ্ঞানে। তার এই আগ্রহের জের ধরেই পশুদের মস্তিষ্কের গঠন ও বিকাশ নিয়ে গবেষণার ফলস্বরূপ তার জীবনে আসে দারুণ খ্যাতি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানবজাতি প্রাণীদের যুক্তিকৌশল এবং বুদ্ধিমত্তার মূল্যায়ন করতে অপারগ।
তার অনুমান মেলাতে গিয়ে তিনি পরীক্ষা চালালেন একটি বিড়াল, একটি ভালুক এবং একটি ঘোড়ার উপর। তাদেরকে অস্টেন গণিতের ভাষায় সব শেখাতে শুরু করলেন। কিন্তু তিনি খেয়াল করলেন, বিড়াল তার প্রচেষ্টায় ছিল উদাসীন এবং ভালুক ছিল সম্পূর্ণ বেখেয়ালী। একমাত্র হান্স নামক আরব স্ট্যালিন ঘোড়াটিই তার প্রতিশ্রুতি রেখেছিল।
যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ সব কিছুই করতে পারতো ঘোড়া হান্স। তাছাড়া মৌলিক বর্গমূল নির্ণয় এবং ভগ্নাংশের কিছু কিছু সমাধান বের করতে হান্স বিশেষ পারদর্শীতার প্রমাণ রেখেছিল। ১৮৯১ সালে অস্টেন সমগ্র জার্মানি জুড়ে ‘ক্লেভার হান্স’ শিরোনামে তার প্রিয় ঘোড়া হান্সের প্রদর্শনী শুরু করে। হান্স খুব কমই তার দর্শকদের হতাশ করেছিল বলা যায়।
অস্টেন দর্শকদের সুযোগ দিতেন তার অতি প্রিয় ঘোড়াটিকে প্রশ্ন করে এর সত্যতা যাচাই করার এবং এতে সকলে মজাও পেতো। যেমন একবার, দর্শকদের মাঝ থেকে প্রশ্ন এসেছিল, ছয় আর তিন যোগ করতে। ফন অস্টেন প্রশ্নটি লিখে দিলেন ব্ল্যাকবোর্ডে। প্রশ্নটি লিখার সাথে সাথেই হান্স পা ঠুকতে শুরু করে। একবার পা ঠোকার অর্থ হলো একটি সংখ্যা। দেখা গেলো হান্স উত্তরে ঠিক নয় বার পা ঠুকে থেমে গেলো। এর উত্তর সহজেই অবাক বিস্ময়ে বুঝে নিল দর্শকরা যে হান্স উত্তর দিয়েছে ‘নয়’।
এমন আরেকটি ঘটনা, হান্সকে জিজ্ঞাসা করা হলো চারকে তিন দিয়ে গুণ করলে কত উত্তর আসে? উত্তরে হান্স বারো বার মাটিতে পা ঠুকে জানিয়ে দিলো উত্তর হবে ‘বারো’। হান্স নিজ থেকে প্রদর্শনীতে অনেক মজার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিতো। যেমন একবার হান্সের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘যদি মাসের প্রথম দিনটি বুধবার হয়,পরবর্তী সোমবারের তারিখটি কি?’ হান্স সহজেই ছয়বার পা ঠুকে উত্তর জানিয়ে দিলো। আবার জিজ্ঞাসা করা হলো ষোলো এর বর্গমূল কত হয়? হান্সের কাছ থেকে উত্তর এলো চারবার পা ঠুকিয়ে ‘চার’। যদিও টুকটাক ভুল হান্স মাঝে মাঝেই করতো, তবুও তার উত্তর দেয়ার ক্ষমতা ৮৯% ই সঠিক হিসেবে প্রমাণিত। বলা হয়ে থাকে, হান্সের এই ক্ষমতা একজন চৌদ্দ বছর বয়সী মানুষের সমতুল্য।
নিউইয়র্ক টাইমসে হান্সকে নিয়ে নিউজ প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক সংশয়বাদী স্বাভাবিকভাবেই এই ঘোড়ার ক্ষমতা নিয়ে অনেক সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। জার্মানির বোর্ড অফ এডুকেশন হান্সের এই ক্ষমতা যাচাই করার লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করে, যেখানে তদন্ত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন দুজন প্রাণীবিজ্ঞানী, একজন মনোবিজ্ঞানী, একজন হর্স ট্রেনার, কয়েকজন স্কুল শিক্ষক এবং একজন সার্কাস ম্যানেজার। তাদের যাচাইয়ের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ১৯০৪ সালে এটা প্রকাশিত হয় যে হান্সের ক্ষমতা সত্যিই অবাক করার মতো নির্ভুল ছিল। এসবের পর থেকে হান্স রীতিমত বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠেছিল।
আফ্রিকান তোতাপাখি অ্যালেক্স
ট্রেনিং দিয়ে যে তোতাপাখি কে কথা শিখানো যায় সে কথা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। কিন্তু স্মরণশক্তি বিচারে মানুষের মতোই আফ্রিকান তোতাপাখি অ্যালেক্স কোনো অংশেই কম নয়। বুদ্ধিও খুবই প্রখর। অ্যালেক্সের জন্ম ১৯৭৬ সালে। অ্যালেক্সের বয়স যখন ঠিক এক বছর তখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্র্যান্ডাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইরিন পিপারবার্গ নামের একজন পশু মনোবিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক তার ভালোবাসার এই তোতা পাখিটিকে নিকটস্থ পাখির দোকান থেকে নিয়ে আসেন বাড়িতে।
আইরিন পিপারবার্গ হলেন এই তোতাপাখির মালকিন। পিপারবার্গ এই তোতা পাখিটির নাম অ্যালেক্স রাখেন ‘অ্যাভিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ এক্সপেরিমেন্ট’ (Avian Language Experiment) বা ‘অ্যাভিয়ান লার্নিং এক্সপেরিমেন্ট’ (Avian Learning Experiment) এর আদ্যক্ষর সম্বলিত নামের সাথে মিলিয়ে। ক্রমেই অ্যালেক্স বিখ্যাত হয়ে ওঠে হার্ভার্ড, ব্র্যান্ডাইস এবং অরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তোতা পাখিটিকে নিয়ে বিস্ময়কর সাইকোলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের জন্য। পিপারবার্গ জানান, এই তোতাপাখি যেকোনো কিছুই খুব দ্রুত আয়ত্ত করতে পারে এবং এর মনে রাখার ক্ষমতাও অসাধারণ।
পিপারবার্গ খুব আগ্রহ নিয়েই অ্যালেক্সকে নানা বিষয় শেখাতে থাকেন। অ্যালেক্সও বাধ্য ছাত্রের মতোই পিপারবার্গের সব কথা শুনে তা আত্মস্থ করার চেষ্টা করতে থাকে। চলতে থাকে নানা ট্রেনিং। পিপারবার্গের মতে, অ্যালেক্সের বুদ্ধির পরিমাণ একটি পাঁচ বছরের শিশুর মতোই। অ্যালেক্স ১০০টির বেশি বস্তুর নাম শিখেছিল এবং সেগুলো আলাদা আলাদাভাবে শনাক্ত করতে পারতো। সূক্ষ্ম ধারণা রয়েছে তার সাতটি রং সম্পর্কে। বড় এবং ছোটর মাঝে তফাৎ খুব সহজেই নির্দেশ করতে পারে অ্যালেক্স। একাধিক জিনিসের মাঝে মিল বা অমিল ধরে ফেলতো এই তোতাপাখিটি।
দু’রকম দুটো ত্রিকোণ বস্তু নিয়ে যদি অ্যালেক্সকে প্রশ্ন করা হতো এদের মাঝে মিল কোথায়, তবে অ্যালেক্স উত্তর দিতো সহজেই- আকৃতি। বস্তু দুটোর মাঝে পার্থক্য কোথায় দেখাতে বললে খুব সহজেই উত্তর আসতো- রং। অ্যালেক্সকে একবার আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে তাকে নির্দেশ করেই জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘কী রং?’ ছয়বার শুনেই অ্যালেক্স তার রং ‘গ্রে’ বা ধূসর তা শিখে নিয়েছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ৩১ বছর বয়সে অ্যালেক্স হঠাৎ করেই মারা যায়। তার মৃত্যুর পঞ্চবার্ষিকীতে ‘গ্রে প্যারট স্টুডিও’ অ্যালেক্স ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘লাইফ উইথ অ্যালেক্স’ নামে একটি ডিভিডি প্রকাশ করে। ল্যাব ম্যানেজার এবং ডিভিডিটির প্রযোজক আরেলিন লেভিন-রাও এর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ছিল সমগ্র বিশ্ববাসীকে এই বিশেষ তোতা পাখিটির বিশেষত্বকে সবার মাঝে তুলে ধরার জন্য।
আমেরিকান কুকুর ববি
কুকুরদের মাঝেও যে বিস্ময়কর ক্ষমতা রয়েছে তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ ববি নামের সেই কুকুরটি। ১৯২৩ সালের ঘটনা। ফ্র্যাঙ্ক এবং তার স্ত্রী এলিজাবেথ তাদের প্রিয় কুকুর ববিকে নিয়ে উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ানা রাজ্যে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হন।
কিন্তু হঠাৎই ববি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার মালিক ধরেই নিলেন ববিকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ববিকে না পেয়ে ফ্যাঙ্ক আশা ছেড়ে দিয়ে তার ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখেই নিজের আবাসস্থল ওরেগনে ফিরে আসেন। ওরেগনের সেই বাড়িতেই ফ্র্যাঙ্ক ববিকে প্রথম নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ববির মালিক তখন জানতেন না যে তার প্রিয় কুকুরটি তার মালিককে খুঁজে না পেয়ে ততদিনে শুরু করে দিয়েছিল এক আশ্চর্য অভিযান।
ঠিক দুই বছর পর কুকুরটি প্রায় আড়াই হাজার মাইলের পথ মিসৌরি নদী, বরফ-আবৃত রকি পর্বত পেরিয়ে ববি পৌঁছে গেলো তার মনিবের ওরেগনের বাড়িতে। অবাক করা এই ঘটনায় তোলপাড় পড়ে যায় সারা আমেরিকা জুড়ে। খ্যাতির আসনে বসিয়ে দেওয়া হয় ববিকে।
আমেরিকান ওয়ান্ডার ডগ হিসেবে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠে ববি। তার এই অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত ক্ষমতার জন্য অনেক পুরস্কারও পেয়েছিল ববি। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েকশো অনুরাগী ববিকে উদ্দেশ্য করে প্রচুর চিঠি পাঠিয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে নির্মিত একটি নির্বাক চলচ্চিত্রেও ববিকে দেখা গিয়েছিল প্রধান চরিত্রে।
এই বিশ্বে এমনই অনেক প্রাণী রয়েছে যাদের বুদ্ধিমত্তা জানার জন্য গবেষকদের নিরন্তন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে এসব জীবজন্তুর জ্ঞানের পরিধিকে বিজ্ঞানীরা কীভাবে ব্যবহার করেন তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে রয়েছেন বিশ্বের পশুপ্রেমিকরা।
ফিচার ইমেজ: Alex Foundation