প্রজাপতির অজানা কিছু কথা

ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানো রঙিন প্রজাপতির প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে জুড়ি নেই। মাত্র অল্প কিছুদিনের জীবন চক্রের প্রজাপতি সম্বন্ধে মজার ও আকর্ষণীয় অনেক তথ্য রয়েছে, না জানা থাকলে যেগুলো আপনাকে সম্ভবত মুগ্ধ করবে পতঙ্গটির রূপের মতোই। পা দিয়ে স্বাদ গ্রহণ, কাঁদা থেকে পানি পান কিংবা আত্মরক্ষার জন্য ছদ্মবেশের কৌশল ইত্যাদি, সবমিলিয়ে সৌন্দর্যের বাইরেও পতঙ্গটির জীবন দারুণ মনোমুগ্ধকর। আজকের আয়োজনে সংক্ষেপে প্রজাপতি সম্বন্ধে জেনে নেবো মজার অজানা কিছু তথ্য, যেগুলো আপনাকে পতঙ্গটির ব্যাপারে নতুন করে ভাবনার খোঁড়াক যোগাবে।

পা দিয়ে স্বাদ গ্রহণ

প্রজাপতির খাবার খোঁজা বা গ্রহণের ব্যাপারে তাদের পায়ের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অনিন্দ্যসুন্দর এই পতঙ্গগুলো খাদ্যের স্বাদ নেয় তাদের পায়ের মাধ্যমে। খাবারের স্বাদ পরীক্ষা করার যে রিসেপ্টর, তা থাকে প্রজাপতির পায়ে। তাছাড়া, নারী প্রজাপতিরা এক গাছ থেকে আরেক গাছে ঘুরে বেড়ায় এবং পা দিয়ে গাছের নির্দিষ্ট অংশে আঘাত করতে থাকে। এরপর ঐ গাছের নিঃসরিত রস পায়ের কেমোরিসেপ্টরের মাধ্যমে পরীক্ষা করে তারা। যদি তাদের নির্ধারিত মানের সাথে সংগতিপূর্ণ হয়, তাহলে সেখানে ডিম দেয় তারা।

প্রজাপতি স্বাদ গ্রহণ করে পা দিয়ে; Image Source: urbanwildlifeguide.net

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এজন্য যে, জন্মের পর প্রজাপতির লার্ভা যেন এই গাছ বা গাছের পাতা থেকেই প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান পায়। এভাবেই পায়ের মাধ্যমে আদর্শ খাবার বা ডিম দেওয়ার জায়গা খুঁজে বেড়ায় প্রজাপতিরা। তবে, প্রকৃতিতে প্রজাপতিই একমাত্র পতঙ্গ নয় যারা পায়ের মাধ্যমে খাবারের স্বাদ নেয়। ঝিঁঝিঁ পোকা এবং পঙ্গপালের স্বাদের রিসেপ্টরও তাদের পায়ে বিদ্যমান।

শুধু তরল খাবারের উপর নির্ভরশীল

প্রজাপতির মুখে চিবানোর মতো কোনো অংশ নেই, তাই তারা শক্ত খাবার একদমই খেতে পারে না। এদের মুখে নলের মতো একটি প্রোবসিস বা শুঁড় রয়েছে, যা দিয়ে এরা শুধু তরল খাবার গ্রহণ করতে পারে। তরল খাদ্যের মধ্যে এদের মূল খাবার অবশ্য ফুলের মধু, তবে নরম ফল বা গাছ থেকেও খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে।

প্রজাপতির একমাত্র ভরসা তরল খাবার; Image Source: worldwildlife.org

মজার ব্যাপার হলো, প্রজাপতি লার্ভা বা ক্যাটারপিলারদের মুখে ম্যান্ডিবলস নামক চিবানোর অংশ থাকে, যার মাধ্যমে লার্ভাগুলো শক্ত খাবার খেতে সক্ষম। যেহেতু এরা প্রজাপতির মতো বেশি দূর যেতে পারে না এবং যেখানেই জন্মে সেখানেই বড় একটা সময় কাটাতে হয়; সেহেতু, এরা জন্মস্থান গাছের পাতা খেয়েই জীবনধারণ করে প্রাথমিক অবস্থায়।

স্বচ্ছ ডানা

প্রকৃতির সবচেয়ে রঙিন পতঙ্গ প্রজাপতি। নানা রঙে রাঙানো প্রজাপতির ডানা তাদের মূল সৌন্দর্যের আধার। রঙিন এই ডানাগুলো মূলত কাইটিন নামের একধরনের প্রোটিনের স্তর দিয়ে তৈরি, যা অত্যন্ত পাতলা। এই কাইটিনের ডানার উপরে থাকে হাজার হাজার তন্তু বা আঁশ, যেখানে আলোর কারুকার্যে আমরা শত রঙে রাঙানো প্রজাপতির দেখা পাই। বয়স বৃদ্ধির সাথে এই আঁশগুলো যখন ঝরে যায়, তখন শুধু থেকে যায় কাইটিনের তৈরি ডানা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই ডানাগুলো একদম স্বচ্ছ এবং এক পাশ থেকে অন্য পাশে সহজেই দেখা যাচ্ছে।

কাইটিনের ডানা; Image Source: learnaboutbutterflies.com

তবে, কাইটিনের তৈরি স্বচ্ছ ডানার উপরে আঁশ বা তন্তুর যে আবরণ, তা প্রজাপতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এগুলোই ডানাগুলোকে আরও মজবুত করে এবং দুপাশের ভারসাম্য প্রদান করে। সাধারণত মিলনের সময়, খাদ্য গ্রহণ বা উড়তে গিয়ে কিছু আঁশ হারায় প্রজাপতি। কিন্তু, উড়তে এতে প্রজাপতির তেমন সমস্যা হয় না। প্রজাপতি যেহেতু নতুন করে এই আঁশ তৈরি করতে পারে না, সেহেতু, যদি খুব বেশি হারে আঁশ হারায়, তাহলে তা তাদের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরুপ।

জীবন মাত্র কয়েক সপ্তাহের

প্রকৃতির সৌন্দর্যের অন্যতম অংশ হিসেবে বিবেচিত হওয়া প্রজাপতি সাধারণত খুব বেশিদিন বাঁচে না। পূর্ণবয়স্ক একটি প্রজাপতির জীবন মাত্র ১-২ সপ্তাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রজাপতির জীবন চক্রের চারটি ধাপ- ডিম, লার্ভা, পিউপা বা ক্রিসালিস এবং প্রজাপতিতে পরিণত হওয়া।

প্রজাপতির জীবনচক্র; Image Source: louisvillezoo.org

ক্রিসালিস থেকে অবমুক্ত হওয়ার পরই পাওয়া যায় পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতি। এরপর প্রজাপতিরা এদের সমস্ত শক্তির বড় অংশ ব্যয় করে খাওয়া ও বংশবিস্তারের উপর। বেশিরভাগ প্রজাপতি মাত্র এক বা দুই সপ্তাহ বেঁচে থাকে। অল্প কিছু প্রজাপতির প্রজাতি অবশ্য রয়েছে, যেগুলোর জীবনকাল প্রায় ১৮ মাস।

কর্দমাক্ত ডোবা থেকে পানি পান

শুধুমাত্র তরল খাবারের উপর নির্ভরশীল প্রজাপতি মধু খেয়েই তাদের পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে পারে না। অতিরিক্ত গরমের সময়ে কর্দমাক্ত ডোবা বা ভেজা বালি থেকে পানি পান করতে দেখা যায়, যা খনিজ সমৃদ্ধ ও তাদের লবণের চাহিদা এখান থেকেই পূর্ণ হয়।

কাঁদা থেকে পানি পান; Image Source: rcannon992.com

প্রজাপতির এই বৈশিষ্ট্য নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে বেশি লক্ষ্যণীয়, যা পুডলিং নামে পরিচিত। মনে করা হয়, এই খনিজ সমৃদ্ধ পানি বংশ বিস্তারে পুরুষ প্রজাপতির সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।

ঠাণ্ডায় প্রজাপতি উড়তে পারে না

প্রজাপতির নিজের জন্য দরকারি তাপমাত্রা উৎপন্ন করতে পারে না। কারণ, এরা শীতল রক্তের পতঙ্গ। তাই, এদের জীবনচক্রের উপর আশেপাশের পরিবেশের তাপমাত্রার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। প্রজাপতির বাসস্থানের তাপমাত্রা কমতে শুরু করলে এদের শরীরের তাপমাত্রাও কমতে শুরু করে এবং একসময় আর ডানা মেলে উড়তে পারে না।

অতিরিক্ত ঠান্ডায় প্রজাপতি উড়তে অক্ষম; Image Source:  Sebastian Knight/Shutterstock

৬০-১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা পর্যন্ত এরা উড়তে পারে। তবে ৮২-১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা প্রজাপতির জন্য আদর্শ মনে করা হয়। অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় এরা উড়তে অক্ষম হলে পাথর, গাছ বা পাতার উপরে আশ্রয় নেয়। এই সময় তারা শিকারের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়।

দৃষ্টিশক্তি তেমন প্রখর নয়

প্রজাপতিরা ১০-১২ ফুটের বেশি দূরত্বের বেশি খুব ভালো দেখতে না পারলেও মানুষ যে অতিবেগুনি রশ্মি দেখতে পায় না, তা আবার তারা ঠিক দেখতে পারে। খাবার সংগ্রহের জন্য ফুল যাচাই ও সঙ্গী নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রজাপতির এই দৃষ্টিশক্তি দারুণ ভূমিকা রাখে।গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজাপতির কমপক্ষে ১৫টি ভিন্ন ধরনের ফটোরিসেপ্টর রয়েছে! প্রতিটি রিসেপ্টর ভিন্ন ভিন্ন রঙে উদ্দীপিত হয়।

শিকারির খাবারে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচতে ছদ্মবেশ

খাদ্য শৃঙ্খলার নিচের দিকের প্রাণী হওয়ায়, পাখি, মাকড়শা, টিকটিকি ও অন্যান্য আরও অনেক প্রাণীর খাদ্য তালিকাতেই প্রজাপতি রয়েছে। আত্মরক্ষার অন্য তেমন কোনো শক্তিশালী উপায় না থাকায় ক্ষুধার্ত শিকারির হাত থেকে বাঁচতে প্রজাপতির সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছদ্মবেশ। ডানার রঙ ও নকশার সাথে মিলিয়ে আশ্রয়স্থল নির্ণয় করতে পারলে সহজেই শিকারের নজর এড়িয়ে যেতে পারে এরা।

আত্মরক্ষায় প্রজাপতির কৌশল; Image Source: Katarina Christenson/Flickr

অবশ্য কিছু প্রজাপতি আবার ছদ্মবেশের ঠিক বিপরীত কৌশল অবলম্বন করে। অত্যন্ত কড়া রঙের নকশার মাধ্যমে এরা নিজেদের উপস্থিতি একরকম সগৌরবের ঘোষণা করে বেড়ায়। অত্যন্ত রঙিন কিছু পতঙ্গ বিষাক্ত হওয়ায় শিকারি প্রাণীগুলো এদের এড়িয়ে চলে, আর এ সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে কিছু প্রজাপতি। প্রজাপতিরা বিষাক্ত নয়, তবে বিষাক্ত পতঙ্গের নকশার গড়নে কিছু প্রজাপতির ডানা রাঙানো থাকলে তা আত্মরক্ষায় বেশ কাজে দেয়।

This article is in Bangla language. It is about amazing facts about butterflies. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: JOEL SARTORE, NAT GEO IMAGE COLLECTION

 

Related Articles

Exit mobile version