আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বলুন তো মানবদেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ কোনটি? চট করে আপনি হয়ত বলে বসবেন মস্তিষ্ক, যকৃত, ফুসফুস কিংবা অন্য কিছু একটা। অথচ এগুলোর একটাও সঠিক উত্তর নয়। বরং সঠিক উত্তর হবে ত্বক। উত্তর ভাবার সময় যার কথা আপনার মনেও আসেনি, সেই ত্বকই আপনার দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ। ত্বক ঠিক কত বড় সে ব্যাপারে একটি ধারণা দেই। দেহ থেকে যদি সম্পূর্ণ ত্বকটিকে আলাদা করা হয়, তবে তা প্রায় ২০ বর্গ ফুট জায়গা দখল করবে!
শুধু আকারের ক্ষেত্রেই নয়, কাজের বৈচিত্রেও আমাদের ত্বক একাই একশো। তবে তার কাজের বর্ণনার পূর্বে ত্বকের সম্পর্কে আরো কিছু জেনে আসা যাক।
ত্বক আবরণী কলার অন্তর্গত। এটি তিনটি স্তরে গঠিত-
এপিডার্মিস
এপিডার্মিস সবচেয়ে বাইরের স্তর। এর নিচে থাকে ডার্মিস স্তর। আর তার নিচে হাইপোডার্মিস। এটি জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে দেহকে সুরক্ষা দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের হতে বাধা দেয় এটি। শরীর থেকে প্রতিনিয়ত ব্যাপন এবং বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ায় যে পরিমাণ তরল বের হয়ে যাচ্ছে, তার কড়া হিসেব রাখে সে।
এর আবার পাঁচটা স্তর রয়েছে। এরা হলো-
- স্ট্রাটাম ব্যাসালি
- স্ট্রাটাম স্পাইনোসাম
- স্ট্রাটাম গ্রানুলোসাম
- স্ট্রাটাম লুসিডাম
- স্ট্রাটাম করনিয়াম
এপিডার্মিস স্ট্রাটিফাইড স্কোয়ামাস এপিথেলিয়াল কোষ দিয়ে গঠিত। এগুলোর খুব দ্রুত বিভাজিত হতে পারে। তবে মজার ব্যাপার হলো, ত্বকের এই স্তরে কোনো রক্তনালী নেই। অর্থাৎ এরা সরাসরি রক্ত থেকে পুষ্টি পায় না। তার বদলে এর ঠিক নিচে বিস্তৃত কৈশিক জালিকা থেকে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেয়ে থাকে। এপিডার্মিসের শতকরা ৯৫ ভাগই কেরাটিনোসাইট জাতীয় কোষ। এছাড়া এখানে রয়েছে মেলানোসাইট, ল্যংগারহ্যান্স এবং মেরকেল জাতীয় কোষ। প্রত্যেক শ্রেণীর কোষ বিশেষ ধরনের কাজে নিয়োজিত।
কেরাটিনোসাইট হলো শরীরের ঢাল। এটি রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন বা ব্যাকটেরিয়া, আণুবীক্ষণিক ছত্রাক, প্যারাসাইট, ভাইরাস প্রভৃতির বিরুদ্ধে দেয়ালের কাজ করে। এসব রোগজীবাণু যদি কোনোভাবে এই দেয়ালকে টপকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে, তবে কেরাটিনোসাইট কোষগুলো দেহকে সংক্রমণ-পূর্ববর্তী সংকেত পাঠাতে থাকে। এই সংকেত পেয়ে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদেরকে দমন করার জন্য যোদ্ধা পাঠিয়ে দেয়। এদের নাম লিউকোসাইট বা শ্বেত রক্তকণিকা। রোগ-জীবাণুকে সাবাড় দেওয়ার কাজটা তারাই করে থাকে।
আমাদের গায়ের রঙ নির্ভর করে মেলানোসাইটের উপর। মেলানোসাইট মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থ তৈরি করে। এই মেলানিনের রঙ কালো। ফলে যার ত্বকে মেলানোসাইট যত বেশি, সে তত গাঢ় বর্ণের। মেলানোসাইটের অভাবে ত্বক ফর্সা হয়। সে হিসেবে বলতে গেলে, ফর্সা হওয়া মানে মেলানিন তথা মেলানোসাইট এর পরিমাণ কম। আর মেলানোসাইট একেবারে না থাকলে শ্বেতিরোগ হয়।
এই ফর্সা ত্বক আমাদের কাছে যতটা আকর্ষণীয় হোক না কেন, এটা শরীরের জন্য ঝুকিপূর্ণ। মেলানিন সূর্যের আলো থেকে কোষের ডিএনএ-কে রক্ষা করে। মেলানিন তথা মেলানোসাইটের অভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এজন্য সূর্যের আলোতে নিয়মিত সময় কাটালে আমাদের দেহ মেলানোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় তড়িঘড়ি মেলানিন তৈরি করে নেয় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। এই জন্য রোদে সময় কাটালে আমাদের ত্বক কালো হয়ে যায়। চলতি বাংলায় একে আমরা বলি রোদে মুখ পুড়ে যাওয়া। আর ইংরেজিতে বলে সানবার্ন। এ দুই-ই আসলে এই মেলানোজেনেসিস। অর্থাৎ শরীর জরুরী ভিত্তিতে মেলানিন তৈরি করে নিয়েছে।
এছাড়া ল্যাংগারহ্যান্স কোষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাতে এবং মেরকেল কোষ স্নায়ুতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত।
ডার্মিস
ত্বকের এই স্তরটি এপিডার্মিসের নিচে এবং হাইপোডার্মিসের উপরে অবস্থিত। এটি কুশনের মতো কাজ করে প্রাথমিকভাবে দেহকে তাপ ও চাপ থেকে সুরক্ষা দেয়।
এটি দুটি স্তরে বিভক্ত। উপরের স্তরটি, যা এপিডার্মিসের কাছে থাকে, তার নাম প্যাপিলারি অঞ্চল। অন্য স্তরটি রেটিকুলার অঞ্চল নামে পরিচিত। এটি অপেক্ষাকৃত পুরু। গঠনগতভাবে এই স্তরটি ঘন যোজক কলা দিয়ে গঠিত। এর মধ্যে রয়েছে কোলাজেন ফাইবার, ইলাস্টিক ফাইবার এবং বহিঃকোষীয় পদার্থ। এই কোলাজেন ফাইবার ত্বককে শক্তি প্রদান করে আর ইলাস্টিক ফাইবার দান করে নমনীয়তা।
এখানে মেকানোরিসেপ্টর এবং থার্মোরিসেপ্টর নামক দুই ধরনের বায়োসেন্সর থাকে। এরা চাপ ও তাপকে অনুধাবন করে সেগুলো স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেয়। এভাবে বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের মস্তিষ্ক তথ্য সংগ্রহ করে সচেতন হয়ে ওঠে।
এছাড়া এখানে চুলের গোড়া, ঘর্মগ্রন্থি, তৈলগ্রন্থি, এপোক্রাইন গ্রন্থি এবং রক্তনালী বিস্তৃত থাকে। এসব রক্তনালী ডার্মিস এবং এপিডার্মিসকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। এই দুই স্তরে বিভিন্ন কোষীয় প্রক্রিয়ায় যে সকল বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয়, তা-ও এই রক্তনালীর মাধ্যমে অপসারিত হয়।
ডার্মিসে যে সকল কোষ থাকে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফাইব্রোব্লাস্ট, ম্যাক্রোফেজ আর এডিপোসাইট। ফাইব্রোব্লাস্ট জাতীয় কোষ কোলাজেন ও বহিঃকোষীয় পদার্থ তৈরি করে। আর ম্যাক্রোফেজ ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রোগজীবাণু ধ্বংস করে দেহকে সুস্থ রাখে। এডিপোসাইট হলো ফ্যাট সেল। আমাদের দেহে যে চর্বি জমে, তার আসলে জমা হয় এই এডিপোসাইটের ভেতরে।
হাইপোডার্মিস
হাইপোডার্মিসকে আমরা অনেকে ‘সাব-কিউটেনিস টিস্যু’ নামে চিনি। হাইপোডার্মিস অর্থ যা ডার্মিসের নিচে। ত্বকের সবচেয়ে ভেতরের এই স্তরটি মূলত চর্বি গুদামঘর হিসেবে কাজ করে।
এডিপোসাইটগুলো এখানে গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে জমা হয়ে সারা দেহে বিস্তৃত সাবকিউটেনিয়াস চর্বির স্তর তৈরি করে। এটি আমাদের দেহের সবচেয়ে বড় খাদ্যের মজুদ। অনাহারের সময় এই চর্বি বিপাক প্রক্রিয়ায় দেহে শক্তি যোগান দেয়। আবার মেদবহুল মানুষদের লক্ষ্য, জিম বা পরিশ্রমের মাধ্যমে অতিরিক্ত সঞ্চিত চর্বিকে ক্ষয় করা।
উল্লেখ্য, দেহের কয়েকটি জায়গায় এই সাবকিউটেনিয়াস ফ্যাট থাকে না। এর মধ্যে রয়েছে চোখের পাতা, নারীদের ভগ্নাংকুর, পুরুষাঙ্গের ত্বক, কানের পিনার অংশ এবং অণ্ডকোষের ত্বক।
আমাদের শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে যে সকল পথে ঔষধ প্রয়োগ করা হয় তার একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা এই স্তরটি। ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন এই স্তরেই দেওয়া হয়।
কাজ
ত্বকের কাজের ইয়ত্তা নেই। এটি যেমন দেহের সবথেকে বড় অঙ্গ, তেমনিই বড় এর কাজের পরিধি। চলুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক সেগুলো-
সুরক্ষা
ত্বকের প্রধান কাজ নিঃসন্দেহে দেহকে আবরণ প্রদান করা। বাইরের রুক্ষ আবহাওয়া থেকে ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো রক্ষা পায় এর ফলে।
আগুনে পোড়া রোগীদের প্রথম ৪৮ ঘন্টায় মৃত্যুর হার এত বেশি, কারণ তাদের দেহে ত্বকের সুরক্ষা থাকে না। ফলে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে তরল পদার্থ হ্রাস পায়, যা তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
তাছাড়া আগেই বলা হয়েছে, অতিবেগুনি রশ্মি এবং রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর হাত থেকে দেহকে রক্ষা করে এই ত্বক।
অনুভূতি
মেকানোরিসেপ্টর এবং থার্মোরিসেপ্টর এর সাহায্যে পরিবেশে চাপের ও তাপের পার্থক্য অনুভব করে মস্তিষ্ককে জানান দেয়।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
ত্বক শুধু তাপমাত্রা অনুভব করতে পারে তা নয়, বরং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও করে। ঠান্ডার সময় দেহের সাবকিউটেনিয়াস চর্বির স্তর দেহের তাপকে বাইরে বেরোতে দেয় না। এতে শরীর উষ্ণ থাকে। আবার গরমের সময় শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে, ঘামের মাধ্যমে তাপ বের করে দেয়। ফলে শরীরে সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকে।
ইম্যুনিটি বা প্রতিরক্ষা
ইম্যুনিটিতে ত্বকের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি Innate Immunity এর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এছাড়া ল্যাংগারহ্যান্স কোষ এবং ম্যাক্রোফেজের সাহায্যে প্যাথোজেন থেকে দেহকে সুরক্ষা প্রদান করে
নিঃসরণ
আমাদের দেহ থেকে বিপাকীয় বর্জ্য পদার্থ মূলত মূত্রের সাথে বের হয়। তবে এদের একটি বড় অংশ ত্বকের মাধ্যমেও দেহ থেকে নিষ্কাশিত হয়। এই তালিকায় রয়েছে ইউরিয়া, এমোনিয়া এবং ইউরিক এসিড। ঘামের মাধ্যমেই এটি ঘটে।
অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হিসেবে ত্বক
ভিটামিন-ডি এর আগের ধাপ ৭-ডিহাইড্রোকোলেস্টেরল আমাদের ত্বকে সঞ্চিত থাকে। সূর্যের আলোতে এই ৭-ডিহাইড্রোকোলেস্টেরল ভিটামিন ডি-তে রূপান্তরিত হয়।
এতসব কাজের কাজী এই আমাদের ত্বক। অনেক শরীরতাত্ত্বিক কাজের কথা তো বললাম, কিন্তু ত্বকের আরেকটি গুরুত্বের কথা এখনো বলা হয়নি! সেটাকেই সম্ভবত আমরা মানব সমাজ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই- সৌন্দর্যবর্ধন! যেমন কয়েকটি মেলানোসাইট এক জায়গায় ঘোট পাকিয়ে আসন গেঁড়ে বসলে, আমরা তার নাম দেই তিল। শরীরবিজ্ঞানের ভাষায় এই তিল আহামরি কিছু নয়। অথচ কোনো এক খেয়ালী কবি বলে গেছেন,
প্রিয়ার মোহন চাঁদ কপোলের
একটি কালো তিলের লাগি
বিলিয়ে দেব সমরখন্দ।।
আপনিই বলুন, কোনো মানে হয় এর?
ফিচার ইমেজ- Health Magazine