বিশাল বড় হাতিকে দেখলে আমাদের কত ভয়ই না লাগে। অথচ হাতি প্রাণীটি কিন্তু বেশ শান্তশিষ্ট আর মিষ্টি। ঠিক তেমনি সাপ ছোট হলেও তার বিষ অনেক বেশী মারাত্মক। পৃথিবীতে এমন অনেক প্রাণী আছে যাদের বাহিরের গঠন দেখতে অসম্ভব মিষ্টি আর নিষ্পাপ হলেও বাস্তবে তারা ভয়ানক বিষাক্ত ও বিপদজনক। চলুন আজ জেনে আসি এমন কিছু সাদাসিধে চেহারার বিপদজনক প্রাণীদের কথা।
কায়ান লোরিস
লেমুর গোত্রের এই প্রাণীটিকে দেখলে আপনার বিশ্বাসই হতে চাইবে না যে, এটি একটুও বিপদজনক হতে পারে। বাস্তবে কিন্তু ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। দুষ্টু-মিষ্টি চেহারার এই কায়ান লোরিসের একটু ছোঁয়াতেই মৃত্যু হতে পারে আপনার।
সাধারণত এশিয়ার বোর্নিয়া দ্বীপের বাসিন্দা এই কায়ান লোরিস। দিনে নয়, রাতের বেলা চলাফেরা করতেই পছন্দ করে। হয়তো আপনি জানেন ওরা বিপদজনক, কিন্তু তবু সামনে এলে এদের গোল গোল দুটো চোখ, ছোটখাটো আকৃতি, হাসিহাসি মুখ আর গায়ের নরম পশম দেখলে হাত দিয়ে ধরতে আপনার ইচ্ছে করতেই পারে। কিন্তু দেখতে ছোটখাটো হলেও বেশ মেজাজী কায়ান লোরিসেরা। এরা যেকোনো সময় খপ করে কামড়ে দিতে পারে আপনাকে। আর একবার কামড়ালে এদের মুখে থাকা বিষ সোজা প্রবেশ করবে আপনার শরীরে। আজকাল কায়ান লোরিসের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। তবু বোর্নিয়াতে গেলে হয়তো ওদের দু-একটিকে দেখার সুযোগ আপনার হলেও হতে পারে!
হানি ব্যাজার
নামে হানি শব্দটি থাকলেও কাজেকর্মে মোটেও তেমন কিছু না হানি ব্যাজার। আকৃতি আর মিষ্টি একটি মুখ দেখলে আপনার মনে হতেই পারে যে, এর চাইতে অসহায় আর নরম স্বভাবের কোনো প্রাণী হয় না। দক্ষিণ আফ্রিকা আর বতসোয়ানার মতো জায়গাগুলোতে খোঁজ পাওয়া যাবে হানি ব্যাজারের।
প্রাণীদের মধ্যে নির্ভীক হিসেবে খ্যাতি আছে এই প্রাণীর। দেখতে ছোটখাটো কুকুরের সমান হলেও কী নেই এর খাবারের তালিকায়? কুমির, বিষাক্ত সাপ, পিঁপড়েখেকো সহ আরো অদ্ভুত আর বিপদজনক প্রাণীদের খুব আগ্রহ নিয়ে খায় হানি ব্যাজার। এমনকি পাখির বাচ্চা খাওয়ার জন্য গাছের মগডালে উঠে যেতেও দ্বিধাবোধ করে না এরা। প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র সিংহই এখন পর্যন্ত কাবু করতে পেরেছে হানি ব্যাজারকে। তা-ও আবার তুলনামূলকভাবে দুর্বল আর বৃদ্ধদের। তাহলে ভাবুন, যে প্রাণীটিকে সিংহ পর্যন্ত ঠিক কাবু করতে পারে না, যার খাবার কিনা বিষাক্ত প্রাণী, তার কাছে সাধারণ একজন মানুষ কতটা অসহায়?
কোয়ালা
কোয়ালার নামটি হয়তো আপনি আগেও শুনেছেন। অসম্ভব সুন্দর একটি প্রাণী। কোয়ালাদের সাধারণত পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে বাচ্চা কোয়ালারা যতদিন পর্যন্ত একা চলাফেরার জন্য বড় না হয় ততদিন মায়ের কোলেই থাকে। ইউক্যালিপটাস বনে সময় কাটায় তারা। সেখানেই ইউক্যালিপটাসের পাতা খেয়ে জীবন চলে তাদের। তবে এই পাতায় খুব একটা পুষ্টি থাকে না। শক্তি কম পাওয়ায় দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয় কোয়ালারা।
তাহলে? এই বাচ্চা প্রাণীটির কাছ থেকে বিপদ কী করে আসতে পারে? আদতে দেখতে গোল বলের মতো হলেও কোয়ালাদের ওজন অনেক বেশি। প্রায় ৯ থেকে ১৪ কেজি ভরের একটি কোয়ালাকে দেখলে দূর থেকে আপনার মনে হবে এটি হয়তো বড়জোর দুই কেজি ওজন ধরতে পারে নিজের শরীরে। শুধু তা-ই নয়, কোয়ালাদের নিষ্পাপ আদলের পেছনে আছে তীক্ষ্ণ নখর আর ধারালো দাঁত! তাই একটু রেগে গেলেই কিন্তু আপনার জন্য ঝামেলা দাঁড় করিয়ে দিতে পারে কোয়ালারা। সামনা সামনি কোনো কোয়ালা দেখলেই সেটাকে ধরার, কোলে তোলার বা তাকে একটু আদর করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। কে জানে, কখন মেজাজ খারাপ হয়ে যায়!
লাল পান্ডা
ফায়ার ফক্স বললে প্রথমেই আমাদের মাথায় চলে আসে সার্চ ইঞ্জিনের কথা। তবে এই ফায়ার ফক্স কোনো সার্চ ইঞ্জিন নয়। বলছিলাম লাল পান্ডার কথা। জন্মের পর থেকে সাধারণত এরা মায়ের সাথেই থাকে। আর যাদের কপালে দুর্ভাগ্য থাকে, তারা চলে যায় বড় কোনো প্রাণীর পেটে। ফলে নিজেদের বাঁচাতেই প্রকৃতি লাল পান্ডাদের দিয়েছে ধারালো দাঁত আর থাবা। এরা অনেকটা কোয়ালার মতনই। তবে তার চাইতেও অনেক বেশী সহজে আপনার শরীরকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে পারবে সহজেই।
তাই কখনো কোনো লাল পান্ডার সামনে পড়লে, তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া না করে দূরত্ব বজায় রাখুন। মাখন কাটতে কি ছুরির কোনো সমস্যা হয়? কত মসৃণ করেই না চালানো যায় ছুরিকে মাখনের ভেতরে। ঠিক একইভাবে লাল পান্ডার নখও আপনার মাংসের ভেতরে দ্রুত আর সহজে চলে যাবে। আপনি হয়তো টের পাওয়ার সুযোগটাও পাবেন না!
জিওগ্র্যাফিক কোণ স্নেইল
হাসছেন নিশ্চয়ই নামটা শুনে? শামুক! শামুক কীভাবে বিপদজনক প্রাণী হতে পারে। দেখতেই তো একেবারে ছোট্ট। আর গতি? সেটার তো কোনো তুলনাই নেই। এত ধীরগতির প্রাণী থেকেও বিপদ আসতে পারে? হ্যাঁ, পারে। এমনিতেই কোনো কোনো প্রজাতির শামুক বেশ বিষাক্ত হয়। তবে তাদের ৫০০ প্রজাতির মধ্যে জিওগ্র্যাফিক কোণ স্নেইল যেন একটু বেশিই বিষাক্ত।
নিজের রঙচঙে খোলসের জন্য বেশ বিখ্যাত শামুকটি। মানুষ সংগ্রহ করার জন্য এই শামুকের খোল খুঁজে বেড়ায়। আপনিও যদি হন সেই মানুষগুলোর মধ্যে একজন তাহলে সাবধান থাকুন। কারণ জিওগ্র্যাফিক কোণ স্নেইলের থাকে একটি সূচালো কাঁটার মতন বস্তু। এটি দিয়ে খুব সহজেই নিজের শরীরের বিষাক্ত পদার্থ শিকারের শরীরে ঢুকিয়ে দিতে পারে প্রাণীটি।
এমনিতে এই বিষ শামুক ব্যবহার করে নিজের বেঁচে থাকার তাগিদেই। বেশ ধীরগতির হওয়ায় খাবারের কাছে পৌঁছতে সময় লেগে যায় অনেকক্ষণ। এর ভেতরে অন্য কেউ এসে খেয়ে যায় তার খাবার। এই সমস্যা থেকে দূরে থাকতেই প্যারালাইসিসের বিষ ভরা থাকে জিওগ্র্যাফিক কোণ স্নেইলের শরীরে। দরকার হলেই সেটা প্রতিপক্ষের শরীরে প্রবেশ করায় শামুকটি। এতে প্রতিপক্ষ ধীর হয়ে যায়। সেই সুযোগে এটি খাবার খেয়ে ফেলতে পারে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা হলে ব্যাপারটা খুব বিপদজনক হতে পারে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে শামুকের বিষে প্যারালাইজড হয়ে মৃত্যুবরণ করে মানুষ। তবে তাকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে যতক্ষণ না বিষের প্রভাব কেটে যায় ততক্ষণ আক্রান্তকে বাঁচিয়ে রাখা। অন্যথায় মৃত্যু হয়ে যায় নিশ্চিত!
গোল্ডেন পয়জন ডার্ট ফ্রগ
অসম্ভব সুন্দর দেখতে এই ব্যাঙটি মাত্র ২ ইঞ্চি লম্বা। তবে কথায় আছে, “ছোট মরিচের ঝাল বেশি?”, এটি পুরোপুরি সত্যি গোল্ডেন পয়জন ডার্ট ফ্রগের ক্ষেত্রেও। দেখতে ছোট হলে কী হবে, এর শরীরে আছে ১০ জন মানুষকে নিমিষে মেরে ফেলার মতো বিষ! কলম্বিয়ার বাসিন্দা এই ব্যাঙের বিষ অনেকে ব্যবহার করে তীর বা ডার্টের মাথার নিজেদের শিকারের কাজে। আর সেখান থেকেই উদ্ভূত হয় এই ব্যাঙটির এমন নাম।
ব্লু রিংড অক্টোপাস
অক্টোপাস আর সব প্রজাতির চাইতে এটি দেখতে সুন্দর হলেও, সামুদ্রিক আর যেকোনো প্রাণীর চাইতে এর বিষাক্ততার পরিমাণটাও অনেক বেশী। অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের যে স্থানগুলোতে মানুষ সাঁতার কাটতে পছন্দ করে সেখানেই দেখা পাওয়া যায় নীল রিং পরা অক্টোপাসের। প্রাথমিকভাবে অক্টোপাস কামড়ে দিয়েছে সেটা বুঝতেই মানুষের অনেক সময় লেগে যায়। আর যতক্ষণে বুঝতে পারে ততক্ষণে করার আর কিছুই থাকে না!
ফিচার ইমেজ: WWF-Australia