পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো স্থানে ফেলে দেওয়া চিপসের প্যাকেট, কিংবা প্লাস্টিকের বোতল তার গন্তব্য হিসেবে খুঁজে নিচ্ছে সমুদ্রকে। তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে সেই এলাকার জীবন আর প্রকৃতিকে। ভয়ানকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে সমুদ্রের তলদেশে থাকা জীবেরা। ২০১৫ সাল নাগাদ, পৃথিবীতে ৬.৩ বিলিয়ন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা হয়েছে। ভয়ংকর হলেও সত্য যে, এর মাত্র ৯ শতাংশকে পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে, ১২ শতাংশ পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়েছে আর বাকি ৭৯ শতাংশই পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা আছে।
জমা আছে বললে অনেকটাই ভুল হবে, ক্রমান্বয়ে এই প্লাস্টিক মানুষসহ সারা পৃথিবীর সব ধরনের প্রাণীর জন্য হয়ে উঠছে ক্ষতির কারণ। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রান্তে পুঞ্জীভূত প্লাস্টিকের একটা বড় অংশ দিনশেষে জমা হচ্ছে সমুদ্রে। অপচনশীল প্লাস্টিক বছরের পর বছর সমুদ্রে ভাসতে থাকে। সামুদ্রিক প্রাণীর একটি বড় অংশ সাধারণত খাদ্যের জন্য সমুদ্রে ভাসমান ক্ষুদ্র প্রাণিকণা (জুপ্ল্যাঙ্কটন) এবং উদ্ভিদকণার (ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন) উপর নির্ভরশীল।
তবে শুধু সমুদ্র নয়, যেকোনো জলাশয়ের জন্য এই ক্ষুদ্র প্রাণীদের ভূমিকা অপরিসীম। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্যশৃংখলে প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক আর অক্সিজেন সরবরাহকারী হিসেবে এই প্ল্যাঙ্কটনদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের একটা বড় অংশ যখন সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে, তখন তা বেশ ভয়ংকরভাবেই প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সমুদ্রের নীল জলরাশির উপর কালো ছায়ার মতো বিশাল ক্ষেত্রফলজুড়ে প্লাস্টিক ছড়িয়ে আছে। এই বিপর্যয় যে কতটা ভয়াবহ হয় উঠছে, তা উপকূলীয় এলাকায় বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়। আর বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই প্লাস্টিকের ফলে সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য সরবরাহের প্রথম ধাপটিই শিকার হয়েছে বাধার। তবে সমুদ্রে জমে থাকা প্লাস্টিকের ফলে সৃষ্ট সমস্যার তালিকা এখানেই শেষ হচ্ছে না।
প্লাস্টিক সাধারণ যেকোনো দ্রব্যের মতো পচনশীল নয় কেন?
সাধারণ যেকোনো দ্রব্য পরিবেশে রেখে দিলেই কিছুদিনের মধ্যে এর পচন শুরু হয়ে যায়। আর এই পচনের পেছনে দায়ী সাধারণত কিছু অণুজীব। পরিবেশে যতই কঠিন পদার্থ থাকুক না কেন, অণুজীবের হাত থেকে রেহাই নেই। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সবধরনের পদার্থকেই ভেঙে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করতে পারে অণুজীব। কিন্তু কৃত্রিমভাবে নির্মিত প্লাস্টিক অণুজীবের আওতার বাইরে।
তাই সমুদ্রে জমা হওয়া প্লাস্টিক বছরের পর অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়। অণুজীব এদের ভেঙে সরল উপাদানে পরিণত করতে না পারায়, বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে সমুদ্রে এদের পরিমাণ বেড়ে চলছে। তবে তাপ, চাপ সহ অন্যান্য পরিবেশগত কারণে বড় আকারের প্লাস্টিক ক্রমান্বয়ে পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণিকায়, বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘Microplastic’। সাধারণ প্লাস্টিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ক্ষতিকর এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণিকা।
আকারে পাঁচ মিলিমিটার কিংবা তারও ছোট এই প্লাস্টিককণা সমুদ্রের নীল জলে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। খালি চোখে এত ছোট প্লাস্টিক-কণিকা চোখে পড়ে না বলে গভীর সমুদ্রের পানি আমাদের বেশ পরিষ্কার মনে হয়, কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই সেরকম নয়। ফ্রান্স আর অস্ট্রেলিয়ার উপকূল থেকে তিমিদের পরিপাকতন্ত্র থেকে প্রায় আটশত কেজির মতো প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। প্ল্যাঙ্কটন সাইজের এই প্লাস্টিককণাকে সামুদ্রিক মাছেরা যে খাদ্য মনে করে ভুল করছে, সে ব্যাপারটি ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে গবেষকদের কাছে।
খাদ্যের সাথে যদি এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা সামুদ্রিক প্রাণীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, তাহলে তা এর পরিপাক ও প্রজননের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ফলে প্রাণীটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় বিলুপ্তির দিকে। তবে শুধু গভীর সমুদ্রে বসবাসরত প্রাণীই নয় কাছিম, সিল কিংবা সামুদ্রিক পাখির মতো প্রাণীরাও আছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। প্লাস্টিকের সাথে খাদ্যকে গুলিয়ে ফেলার প্রমাণ এদের মাঝেও। সামুদ্রিক কাছিমদের বেশিরভাগই প্লাস্টিক ব্যাগ এবং জেলিফিশের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না বলে গবেষকেরা প্রমাণ পেয়েছেন। ফলে প্লাস্টিককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার ফলে অবধারিতভাবেই সামুদ্রিক কাছিমের একটি বড় অংশ সরাসরিভাবে পলিথিন দূষণের শিকার।
সামুদ্রিক পাখিও পলিথিন দূষণের শিকার
সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, সামুদ্রিক পাখিদের প্রায় নব্বই শতাংশ সরাসরি প্লাস্টিক দূষণের শিকার। ষাটের দশক থেকেই সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় পাখিদের উপর প্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে জরিপ চালানো হয়। ষাটের দশকে পরিমাণ ছিলো পাঁচ শতাংশেরও কম পাখির পাকস্থলীতে পাওয়া যেত প্লাস্টিক। আশি আর নব্বইয়ের দশকে শিল্প কারখানায় প্লাস্টিক উৎপাদন সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি কপাল পুড়েছে পাখিদেরও। কিছু গবেষণা বলছে, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সামুদ্রিক পাখির পাকস্থলীতেই পাওয়া যায় প্লাস্টিক।
পৃথিবীজুড়ে প্রতি ১১ বছরে প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ দ্বিগুণ হচ্ছে। আর ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট বর্জ্যের সবচেয়ে মারাত্মক শিকার এই পাখিরা। কারণ ১৯৬২ সালে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ ১৮৬ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর উপর গবেষণা করে, তাদের পাকস্থলীতে বর্জ্যের পরিমাণ নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন। নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন সময় সেই গবেষণা পুনরাবৃত্তি করে দেখা গেছে অন্যান্য যেকোনো প্রাণীর তুলনায় পাখির পাকস্থলীতে বর্জ্যের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর তুলনায় পাখির আকার ছোট হওয়ায় গবেষণায় এমন ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে কিনা, এমনটাও প্রশ্ন থেকে যেতে পারে! পাশাপাশি পাখির পাকস্থলীতে মাত্রাতিরিক্ত প্লাস্টিককণিকার উপস্থিতির সম্ভাব্য কারণ হিসেবে পাখির বৈচিত্র্যময় খাদ্যাভ্যাস এবং কৌতূহলী আচরণের পাশাপাশি সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্যও যে দায়ী- সে ব্যাপারে পরিবেশবিদদের সন্দেহ নেই। তবে এর মধ্যে অ্যালবাট্রোসের মতো বড় সামুদ্রিক পাখিদের অবস্থা সবচেয়ে ভয়ংকর। সমুদ্র উপকূলে এই পাখিদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে এবং পাখিদের শবদেহ বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য থেকে এটি পরিষ্কার যে, এই পাখিদের একটি বড় অংশ প্লাস্টিক দূষণের শিকার।
তবে তিমি, হাঙর, কডফিশ কিংবা ম্যাকারেলের মতো বড় সামুদ্রিক প্রাণীদেরও রেহাই নেই। বড় ধরনের প্লাস্টিকের পাশাপাশি মাইক্রোপ্লাস্টিকের ভাণ্ডারে পরিণত হচ্ছে এই মাছেদের পরিপাকতন্ত্র।
দুর্যোগের ঘনঘটা
পৃথিবীজুড়ে প্লাস্টিক সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার পর থেকেই প্লাস্টিক বর্জ্যে পরিত্যাগ নিয়ে বরাবরই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কোমল পানীয় থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের বোতল তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। শুধু ২০১৬ সালেই ১১০ বিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল বানিয়েছে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান কোমল পানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা। আর এই বোতলের বেশিরভাগই উন্মুক্তভাবে পরিবেশে পরিত্যাগ করেছেন ভোক্তারা। তাই অনেক পরিবেশবিদের দাবি, এখনই যদি প্লাস্টিক বোতলের বিকল্প না চিন্তা করা যায় তবে মানবজাতির সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ এক দুর্যোগ।
যৎসামান্য বায়োপ্লাস্টিক
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছেন, কীভাবে পরিবেশে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাবকে কমিয়ে আনা যায়। আর প্লাস্টিকের বিকল্প নিয়েও গবেষণাগারে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ চলছে। আবিষ্কৃত হয়েছে পরিবেশে পচনশীল বায়োপ্লাস্টিকও। কিন্তু সেই প্লাস্টিক উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এই প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে না।
ফলে পরিবেশের উপরও প্লাস্টিকজনিত বর্জ্যের চাপ কমছে না। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য প্রকৃতিকে বাসযোগ্য করে যেতে হলে অবিলম্বে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে, সমুদ্র কিংবা যেকোনো জলাশয় থেকে প্লাস্টিক অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে, বায়োপ্লাস্টিক উৎপাদনের খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় মানবজাতির জন্য অপেক্ষা করছে বিশাল এক দুর্যোগ।
ফিচার ইমেজ: pinterest.com