আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ টিভিতে অনেকেই দেখেছেন। এ এক বিষম বস্তু। জীবন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে হরদম বেরুতে থাকে হরেক রকমের গ্যাস, যেগুলোর কোনো কোনোটি মারাত্মক বিষাক্ত। তাই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কাছে ঘুরঘুর করা বন্ধ করবার ব্যাপারে সমস্ত দেশেই, মানে যে সব দেশে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে সেই সব দেশে জবরদস্ত কিছু আইন কানুন আছে।
এ তো গেল জীবন্ত আগ্নেয়গিরির বিভীষিকার কথা। কিন্তু মৃত আগ্নেয়গিরি? প্রকৃতি বিচিত্র খেলা খেলতে ভালবাসে। যে আগ্নেয়গিরি জীবন্ত অবস্থায় সাক্ষাত মৃত্যুদূত, সেটাই মৃত অবস্থায় এক অসাধারণ সবুজ আশ্রয়ে পরিণত হয়। আগ্নেয়শিলা এবং ছাইসহ আগ্নেয়গিরির উদগীরণের ফলে পৃথিবীর গহীন গহ্বর থেকে উঠে আসা যত সব উপাদান মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। কোটরে জমে বৃষ্টির জল। আর এভাবেই আগ্নেয়গিরির গহ্বরে গড়ে ওঠে নতুন এক ইকোসিস্টেম। জ্বালামুখ ঘিরে থাকা উঁচু প্রাচীর এই ইকোসিস্টেমকে দেয় প্রাকৃতিক সুরক্ষা।
আজকে আলাপ হবে এমনই দুটি আগ্নেয়গিরি ও জীব বৈচিত্র্যের ঘাটি নিয়ে। এর একটি আফ্রিকায়। তাঞ্জানিয়ার আরুশা অঞ্চলের মৃত আগ্নেয়গিরির কোটর এনগোরঙ্গোরো। আর অন্যটি আমাদের খুব পরিচিত দেশ ইন্দোনেশিয়ার প্রতিবেশী পাপুয়া নিউ গিনিতে। সেটির নাম মাউন্ট বোসাভি।
এনগোরঙ্গোরো
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে নানা আফ্রিকান গোত্রের পূর্বপুরুষেরা এনগোরঙ্গোরো অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। পরবর্তীতে মাসাই জাতির মানুষেরা তাদেরকে তাড়িয়ে এই অঞ্চল কব্জা করে নেয়। মাসাইদেরকে আজতক আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। এই গোত্রের মানুষেরা মূলত গরু চরিয়ে জীবনধারণ করে।
ইউরোপীয়রা উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আফ্রিকার আনাচে-কানাচে হন্যে হয়ে ঘোরা শুরু করে প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠনের ধান্দায়। জার্মানরা তাঞ্জানিয়া দখল করে নিয়ে জার্মান ইস্ট আফ্রিকা নামে শাসন করা শুরু করে। সে সময়েই এই অঞ্চলটির কথা বিশ্বের নজরে আসে। তবে বিরান চারণভূমি আর কতজন মানুষকেই বা টানবে। অন্তত প্রথম মহাযুদ্ধের আগপর্যন্ত এনগোরঙ্গোরো অঞ্চলে দুই জার্মান ভাইয়ের একটি খামার ছাড়া কোনো ইউরোপীয় বসতি ছিল না বলে জানা যায়।
তো সেই জার্মান ভাই দুজন মাঝে মধ্যেই ইউরোপীয় অতিথিদের জন্য সাফারীর আয়োজন করতেন। ১৯২৮ সালে অবশ্য জ্বালামুখের ভেতরে কোনো ধরনের শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৯ সালে অঞ্চলটিকে এনগোরঙ্গোরো ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যাযাবর মাসাইদেরকে অবশ্য এই পার্কে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে শিকার কিংবা যথেচ্ছ চাষাবাদ নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য বানানো হয়েছে কড়া কড়া সব নিয়মকানুন।
এনগোরঙ্গোরোর সবটাই কিন্তু জ্বালামুখ নয়। এই পার্কের আয়তন আট হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি হলেও আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বা কোটরের আয়তন সেই তুলনায় অনেক কম। মাত্র ২৬০ বর্গ কিলোমিটার। জ্বালামুখের পূর্বপ্রান্ত অপেক্ষাকৃত খাড়া দেয়াল দিয়ে ঘেরা। পশ্চিমে অবশ্য বিস্তর খোলা মাঠ আছে। মাঝামাঝি অবস্থানে আছে মাকাত নামের একটি হৃদ।
পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, উর্বর জমি আর মানুষের হস্তক্ষেপ না থাকার কারণে চমৎকার চারণভূমি গড়ে উঠেছে এনগোরঙ্গোরোর জমিতে। আর এতে আকৃষ্ট হয়ে কোটরের মধ্যে আস্তানা গেড়েছে বিরল কালো গণ্ডার, জলহস্তী, গ্রান্ট জেব্রা, ইল্যান্ড, কেপ মহিষসহ প্রায় ২৫ হাজার তৃণভোজী প্রাণী। আর তৃণভোজীদের পিছু পিছু হাজির হয়েছে এনগোরঙ্গোরোর সবথেকে বড় আকর্ষণ; পূর্ব আফ্রিকার সিংহ। ষাটটির মত সিংহ আছে এই অঞ্চলে।
এখন মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে এত প্রাণী কিভাবে এই কোটরের মধ্যে সেধিয়ে থাকে। খাবারে টান পড়বে তো। তা প্রাণীরা সেটা ভালো করেই জানে। প্রতি বছরই তৃণভোজীদের একটা বড় অংশ কোটরের বাইরে চলে যায় পরিযায়ী হয়ে। বিশেষ করে গরমটা বেশি পড়লে এমন ঘটে।
এনগোরঙ্গোরোর আশেপাশের অঞ্চলেও প্রচুর বন্য পশুর দেখা মেলে। এছাড়া কাছেই অবস্থিত তাঞ্জানিয়ার বিখ্যাত সেরেঙ্গেতি ন্যাশনাল পার্ক। কাজেই সাফারির শখ মেটানোর জন্য এ এক আদর্শ স্থান। প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লক্ষ পর্যটক এই অঞ্চলটি দেখতে আসেন।
মাউন্ট বোসাভি
পাপুয়া নিউগিনি বেশ বড় দেশ। জনসংখ্যা অনেক কম। গোটা দেশটাই প্রচুর বৃষ্টিপাতের বদৌলতে যথেষ্ট উর্বর এবং সেই মাফিক বিশাল বিশাল সব বনে ঢাকা। সেই পাপুয়া নিউ গিনির দক্ষিণে পার্বত্য একটি অঞ্চল হচ্ছে মাউন্ট বোসাভি। এটাও এক মৃত আগ্নেয়গিরির কোটর। উচ্চতা প্রায় ৮ হাজার ফুট।
মাউন্ট বোসাভি আয়তনে এনগোরঙ্গোরোর তুলনায় অনেক ছোট। মাত্র ৪ বর্গ কিলোমিটার চওড়া আর এক বর্গ কিলোমিটার গভীর। কিন্তু তা হলে কী হবে, আফ্রিকার তুলনায় এ অঞ্চল অনেক বেশি দুর্গম। ঘন জঙ্গল, পোকা মাকড়ের উপদ্রব, স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া আর হরদম বৃষ্টি পড়বার কারণে এই জঙ্গল ঠেলে পথ চলা খুবই কঠিন। আর মাউন্ট বোসাভির বাসিন্দাদের সব থেকে বড় সুবিধা হল তাদের পাহাড়খানা অনেক বেশি দুর্গম। কাজেই মানুষের চলাচল নেই বললেই চলে। কেবল উত্তরের ঢালে ওয়ালুলু আর কালুলি গোত্রের মানুষের বসবাস। তা তাদের জীবন যথেষ্ঠই পরিশ্রমের। কোটরে নেমে দুই পাক ঘুরে আসার খায়েশ তাদের জাগে না বললেই চলে।
কাজেই মাউন্ট বোসাভির বাসিন্দারা মানুষের উপদ্রব থেকে মুক্ত। আর ২০০৯ সালে এই বাসিন্দাদের ব্যাপারে খোঁজখবর করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা খোঁজ পান এক হারিয়ে যাওয়া জগতের, যে জগতে এই আধুনিক যুগেও মানুষের ছায়া পড়েনি কোনদিন।
মাউন্ট বোসাভি নিয়ে প্রকৃতিবিদদের আগ্রহ বহুদিনের। কিন্তু ওই অঞ্চলে ঢোকাটা একরকমের অসম্ভব। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলে কোনো কিছুই যে নেই। ২০০৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির জর্জ ম্যাকগাভিন এবং বিবিসির একটি ফিল্ম ক্রু এর দল মাউন্ট বোসাভিতে হানা দেয়। হেলিকপ্টারে চড়ে দলবল পাকিয়ে বিজ্ঞানীরা বোসাভির নিকটতম গ্রামে অবতরণ করেন। কাসুয়া ভাষাভাষী সেখানকার লোকেদের কাছে ষাট বছর আগেও লোহার কুঠার এক বিস্ময়ের বস্তু ছিল। এহেন দুর্গম জায়গা থেকে বোসাভির চূড়া হচ্ছে চার দিনের হাঁটাপথ। সেই বোসাভির কোটরের মধ্যে নয় মাস চষে বেড়িয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন প্রায় ৪০টি নতুন প্রজাতি। এর মধ্যে ছিল ১৬ রকমের ব্যাং, তিন প্রজাতির মাছ, বিদঘুটে একটা বাদুড়, গেছো ক্যাঙ্গারু, কুসকুস আর প্রকান্ড একরকমের লোমশ ধেড়ে ইদুঁর যেটার ওজনই প্রায় দেড় কেজি। সব থেকে মজার ব্যাপার হল, এই নিভৃতচারী বাসিন্দারা মানুষকে দেখে মোটেও ভয় পায় না। তাদের গায়ে স্পর্শ করলেও বিশেষ আপত্তি করে না। হাজার বছর ধরে তারা কোনো মানুষ দেখেনি। কাজেই মানুষকে ভয় পাওয়ার উপকারী বিদ্যাটাও বেচারাদের আয়ত্ত করা হয়ে ওঠেনি।
তবে মাউন্ট বোসাভির বাসিন্দাদের জীবনে সুখ কতদিন থাকবে সেটাও দেখবার বিষয়। ইতোমধ্যেই বনখেকোর দল নাকি কোটরের ২০ মাইলের মত দূরত্বের মধ্যে চলে এসেছে।
বিবিসি এই মাউন্ট বোসাভি নিয়ে ‘লস্ট ল্যান্ড অব দ্য ভলকানো’ নামের তিন খণ্ডের একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছে।
ফিচার ইমেজ: Eastern Sun Tours & Safaris