হাতি, এই নামটি বলার সাথে সাথেই বিশালদেহী এক প্রাণীর ছবি আমাদের মনে ভেসে উঠে। বিশাল দেহ, শুঁড় আর পা নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো এলাকা। তবে আমাদের পরিচিত হাতির বাইরেও ভিন্নরকম হাতির অস্তিত্বের কথা জানা যায়। প্রাগৈতিহাসিক কালে এমন এক প্রজাতির হাতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল যাদের বলা হয় ‘বামন হাতি’।
বামন হাতিরা তাদের পূর্বপুরুষ কিংবা সমসাময়িক কালে বেঁচে থাকা অন্য হাতির তুলনায় আকারে বেশ ছোট ছিল। কিন্তু বামন হাতিদের নিয়ে একটা রহস্য আছে, তাদের সবাই কোনো না কোনো দ্বীপের বাসিন্দা ছিল!
শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী হাতির বর্গ প্রোবোসিডিয়া। এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত অনেক প্রজাতিই ভূমধ্যসাগর ও এশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে আটকা পড়ে। এরাই পরিবেশগত কারণে পরিবর্তিত হয়ে বামন হাতিতে পরিণত হয়। সময়ের স্রোতে এরা কেউই আর টিকে নেই, শুধু রয়ে গেছে এদের দেহাবশেষ। আর এই দেহাবশেষ বিশ্লেষণ করেই জানা গেছে বামন হাতির রহস্য।
দ্বীপে কেন আটকে পড়ে?
এই রহস্যের বেড়াজাল খুলতে হলে ফিরে যেতে হবে দুই মিলিয়ন বছর আগে। পৃথিবীতে তখন চলছে প্লিস্টোসিন উপযুগ। যেটি আমরা সাধারণভাবে জানি ‘বরফ যুগ’ বা ‘আইস এজ’ নামে। সেই যুগেও হাতিদের বিবর্তন চলছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় হাতি তথা প্রোবোসিডিয়ার সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বরফ যুগের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, চরম ঠাণ্ডা চলাকালীন সময়েও হুট করে অল্প সময়ে পৃথিবী গরম হতে শুরু করে। এরকম হওয়াকে বলে ইন্টারগ্ল্যাসিয়াল (Interglacial)।
ইন্টারগ্ল্যাসিয়াল চলাকালীন সময়ের আবহাওয়া অনেকটা বর্তমান পৃথিবীর আবহাওয়ার মতোই। এই ঘটনা শেষে আবারো পৃথিবী ঠাণ্ডা হতে শুরু করে এবং আবারো বরফ শীতল আবহাওয়ায় ফিরে যায়। ইন্টারগ্ল্যাসিয়ালকে অনেকটা বাক্যের কমা চিহ্নের সাথে তুলনা করা যায়। এর মাধ্যমে বাক্য শেষ হচ্ছে না, তবে শব্দগুলো জিরিয়ে নিয়ে যেন আবার শুরু হচ্ছে।
বরফ যুগের পুরো সময়ের তুলনায় ইন্টারগ্ল্যাসিয়ালগুলো ছিল খুবই ক্ষুদ্র সময়। সময়ের হিসেবে একেকটা কয়েক হাজার বছর। বরফ যুগ যে পরিমাণ সময় নিয়ে বিরাজমান থাকে তার তুলনায় কয়েক হাজার বছর ক্ষুদ্র সময়ই। পৃথিবীর জলবায়ুতে দ্রুত পরিবর্তনের সাথে সাথে মেরু এলাকার বরফ আর সমুদ্রের উচ্চতারও বাড়তে হতে থাকে। মেরু অঞ্চল ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকে। ফলে উপকূলীয় এলাকায় দ্বীপ তৈরি হতে থাকে।
ইন্টারগ্ল্যাসিয়াল শুরু হওয়ার আগে এই দ্বীপগুলো বিচ্ছিন্ন এলাকা ছিল না, মূল স্থলভাগের মতো জীববৈচিত্র্যই এই এলাকাগুলোতে দেখা যেত। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের দ্রুত উচ্চতা পরিবর্তনের সাথে সাথে মূল ভূমি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় এই এলাকার জীববৈচিত্র্যে আসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই প্রক্রিয়া সৃষ্ট অনেক দ্বীপেই আটকে পড়ে হাতির বর্গ প্রোবোসিডিয়ার সদস্যরা।
কোথায় পাওয়া গেছে বামন হাতি?
বামন হাতিদের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছে ভূমধ্যসাগরের আর এশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার সাইপ্রাস, মাল্টা, ক্রেটে, সিসিলি, সারডিনিয়া, সাইক্লেডেস ছাড়াও এশিয়ার জাভা, সুমাত্রা,বরনিও, ফিলিপাইন, তিমুর প্রভৃতি দ্বীপে বামন হাতির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়াও ক্যালিফর্নিয়ার চ্যানেল আইল্যান্ড, সাইবেরিয়ার রাংগেল দ্বীপেও খণ্ডাকারে বামন হাতির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
কেন বামন হলো?
বিশালাকার হাতিরা যখন সীমাবদ্ধ এলাকায় বন্দি হয়ে পড়ে, তখন বেঁচে থাকার প্রয়োজনে দেহের আকার ছোট হয়ে আসে। দ্বীপের সীমাবদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে যারা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে তারা টিকে রয়েছে। সেখানকার পরিবেশ অনুসারে আকারে ছোট এমন হাতিই সুবিধা পেয়েছিল, আর বড়গুলো ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে দেখা যায় হাতিরা দেহের কাঠামো ঠিক আছে কিন্তু দেহের অভ্যন্তরীণ কলকব্জাগুলো ছোট হয়ে গিয়েছে।
মাল্টা আর সিসিলি দ্বীপের Elephas falconeri-কে বামন হাতির উদাহরণ হিসেবে গণ্য করি। মাত্র এক মিটার উচ্চতার পূর্ণবয়স্ক এই হাতি এ যাবৎকালের সবচেয়ে ছোট হাতির একটি। ধারণা করা হয় দ্বীপে বন্দি হওয়ার সময় এর পূর্বপুরুষেরা আকারে বর্তমানের হাতির চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। তবে দ্বীপে বন্দি হওয়ার পর খাদ্য আর চারণভূমির সংকট এদেরকে সরাসরি ছোট আকারের তৃণভোজীতে পরিণত হতে বাধ্য করে। পাশাপাশি মাল্টা কিংবা সিসিলি দ্বীপে হাতির চেয়ে বড় আকারের কোনো শিকারী প্রাণী না থাকায় হাতির উপর চাপও কমে আসে। তাই বড় দেহের প্রয়োজনীয়তাও কমে আসে।
একই ব্যাপার শুধু মাল্টা কিংবা সিসিলিতেই নয়, ঘটেছে জাভা, সুমাত্রাসহ বিভিন্ন দ্বীপে। তাই গবেষকরা এই ব্যাপারটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘আইল্যান্ড ইফেক্ট’ নামে। পরে অবশ্য বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন এটি দ্বীপের প্রভাব নয় বরং সীমাবদ্ধ জায়গায়, সীমাবদ্ধ সম্পদ এবং বড় কোনো শিকারি প্রাণী না থাকার কারণেই এই বামনত্ব প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তবে পৃথিবী থেকে এই বামন হাতিরা হারিয়ে গেলেও ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে এখনো পাওয়া যায় পিগমি হাতি নামে একধরনের বামন হাতি। এ ধরনের হাতি বর্তমান সময়ের হাতির বামন প্রতিরূপ। প্রাগৈতিহাসিক সময়ের বামন হাতির সাথে সম্পর্কিত না হলেও আকারে আর বৈশিষ্ট্যে বেশ মিল দেখা যায় উভয়ের মধ্যেই।
বোরনিও দ্বীপের ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়া অংশে ছোটোখাটো এই পিগমি হাতি বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। ধারণা করা হয় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জাভা দ্বীপের হাতিই এই পিগমি হাতির পূর্বপুরুষ। সম্প্রতি ২০১৫ সালে শ্রীলংকায়ও বামন হাতির দেখা পাওয়া গিয়েছে। এদের ব্যাপারে গবেষণা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে এরাও বর্তমান আধুনিক এশিয়ান হাতির বামন প্রতিরূপ।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো দ্বীপগুলোতে শুধু যে হাতির আকারেই পরিবর্তন এসেছে এমন নয়। পর্যবেক্ষণ থেকে বেরিয়ে এসেছে যে, ঐ একই দ্বীপের ছোট প্রাণীদের আকারও পরিবর্তিত হয়েছে। তারা আকারে কিছুটা বড় হয়েছে। যেমন, দ্বীপে আটকা পড়া ইদুঁর। এ কারণেই ভূমধ্যসাগরীয় কিংবা এশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপের ইদুঁর সাধারণ মূলভূমিতে বসবাসরত ইদুঁরের তুলনায় বড়।
তবে কালে কালে কেন এই বামন হাতিরা হারিয়ে গিয়েছে তার আসল কারণ কী সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। ধারণা করা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন, অগ্নুৎপাত, জলবায়ু পরিবর্তন, চারণভূমি সংকটের মতো সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করার কারণেই হারিয়ে গেছে ক্ষুদ্রাকার এই হাতিরা।
তথ্যসূত্র
1. Sukumar, Raman (2003), The Living Elephants. Page: 31-33
ফিচার ইমেজ- North American Museum of Ancient Life