কিছুদিন আগেই ২০১৮ সালের সেরা নতুন ১০টি প্রজাতির নামের তালিকা প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্পিসিজ এক্সপ্লোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভারনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ফরেস্ট্রি কলেজের একটি অংশ। আমাদের গ্রহের বৈচিত্র্যময় প্রজাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং আমরা সেগুলো সম্পর্কে জানার আগেই যেন এরা বিলুপ্ত হয়ে না যায়, সে কারণেই এই তালিকাটি প্রকাশ করা হয়।
আগের বছরে নাম ঠিক করা প্রায় ১৮ হাজার নতুন প্রজাতি থেকে এই তালিকার জন্য প্রজাতি বাছাই করা হয়। ১৮ হাজার প্রজাতি শুনতে অনেক বেশি মনে হলেও, জেনে রাখা ভালো যে, প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়! চলুন জেনে নেওয়া যাক এ বছর সেরা ১০ প্রজাতির তালিকায় কারা স্থান করে নিয়েছে।
প্রটিস্ট
এককোষ বিশিষ্ট প্রটিস্ট স্যান ডিয়েগোর গ্রীষ্মকালীন অ্যাকুয়ারিয়ামের একটি প্রবালে আবিষ্কৃত হয়। তাই এটি প্রকৃতিতে কোথায় পাওয়া যায় সে সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটি ঠিক কোনো প্রাণী, উদ্ভিদ বা ছত্রাক জাতীয় কিছু নয়, এটি মূলত ইউকারইওট। এর জেনেটিক অঙ্গাণুগুলো নিউক্লিয়াসের মাঝে বিদ্যমান, যা একটি পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। অন্য কোনো প্রোটিস্ট গোত্রের সাথে এটির মিল নেই। চাবুকের মতো একটি ফ্ল্যাজেলার মাধ্যমে এটি চলাফেরা করে।
আটলান্টিক বনবৃক্ষ
প্রায় ১৩০ ফুট উচ্চতার ৬২ টন ওজনের এই গাছটি ব্রাজিলের আটলান্টিক অরণ্যের মাথা ভেদ করে দৃষ্টিগোচর হয়। তবুও এই গাছটি আমাজন বনে প্রাপ্ত এই গোত্রীয় অন্য গাছ থেকে কিছুটা ছোট। এই গাছের ফল প্রায় ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় এই প্রজাতির গাছের মাত্র ২৫টি বিদ্যমান, যার অর্ধেকই সুরক্ষিত এলাকায় অবস্থিত। বনটি আগে প্রায় ৩৩ কোটি একর জুড়ে বিস্তৃত ছিল। তবে বর্তমানে এই আদিম অংশের মাত্র ১৫ শতাংশ বিদ্যমান।
অ্যাম্ফিপড
শক্ত খোলসযুক্ত এই প্রাণীটির পিঠ দেখে মনে হয় যেন সেখানে একটি কুব্জ রয়েছে। এটি লম্বায় মাত্র ২ ইঞ্চির মতো হয়ে থাকে। কুমেরীয় মহাসাগরের শীতল পানিতে এটির বসবাস। এটি শক্ত খোলসবিশিষ্ট গোত্রের প্রাণীর ২৬টি প্রজাতির মাঝে একটি, যেগুলো দক্ষিণ মহাসাগরে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান এবং উজ্জ্বল রঙের জন্য পরিচিত।
ব্যাফ্লিং বিটল বা বিভ্রান্তিকর পোকা
নাম শুনে হ্যারি পটার সিরিজের কোনো চরিত্র মনে হলেও আসলে সেরকম কিছু নয় এটি। এই ছোট্ট পোকাটি মাত্র দেড় মিলিমিটার লম্বা। এটি যাযাবর এক শ্রেণীর পিঁপড়ার পাশাপাশি বসবাস করে। প্রতি দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর যখন পিঁপড়ার দল স্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যায়, তখন সাথে এই পোকাগুলো সেখানে চলে যায়। যখন পিঁপড়াগুলো অন্যত্র চলে যেতে শুরু করে তখন এগুলো পিঁপড়ার পেটে নিজেদের মুখের মাধ্যমে আটকে নেয়। এই পোকাগুলো এক ধরনের রাসায়নিক সংকেত ব্যবহার করে, তবে বিজ্ঞানীরা এখনও সেটি ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেননি।
তাপানুলি ওরাংউটান
বড় এপের দেখা পাওয়া বেশ মুশকিল, আর তাপানুলি ওরাংউটানের ক্ষেত্রেও এটি সঠিক। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন বড় ধরনের এপ। পুরুষগুলো লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট, তবে স্ত্রী এপগুলো লম্বায় চার ফুট হয়ে থাকে, যা স্বাভাবিক ওরাংউটানের সমান। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় আড়াই লক্ষ একর বিচ্ছিন্ন পাহাড়-পর্বত ও বন-বাদারে মাত্র ৮০০টি তাপানুলি ওরাংউটান অবশিষ্ট রয়েছে। সুমাত্রা ও বোর্নিওর ওরাংউটানের তুলনায় এই প্রজাতিটি ভিন্ন। প্রায় ৩৩ কোটি বছরেরও পূর্বে এক ধরনের ওরাংউটান হচ্ছে এই প্রজাতির পূর্বসূরি।
সোয়ার’স স্নেইলফিস
অনেকটা ব্যাঙাচির মতো দেখতে এই মাছটি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের একদম তলানিতে থাকে। এটিই সমুদ্রের সবচেয়ে গভীরে থাকা মাছ। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২২-২৬ হাজার ফুট নিচে থাকে, ধারণা করা হয় ২৭ হাজার ফুটের নিচে মাছ বাঁচতে পারে না। লম্বায় এটি মাত্র চার ইঞ্চি হয়।
হেটারোট্রফিক বা পরভোজী ফুল
চমৎকার এই ফুলটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জাপানে অল্প সময়ের জন্য প্রস্ফুটিত হয়। এক ধরনের ছত্রাকের সাথে মিথোজীবী হিসেবে থাকে এটি। যেখানে বেশিরভাগ গাছ সূর্য থেকে শক্তি গ্রহণ করে ফটোসিনথেসিসের মাধ্যমে পুষ্টি গ্রহণ করে, সেখানে এটি ছত্রাকটির কোনো ক্ষতি না করেই সেখান থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে। এটি লম্বায় মাত্র চার ইঞ্চি। এই ফুলটি গুরতরভাবে বিপন্নপ্রায়। জাপানের ইশিগাকি দ্বীপের দুটি স্থানে মাত্র ৫০টির মতো গাছ দেখা যায়। সর্বপ্রথম ফুলটির নমুনা সংগ্রহকারী তাকাওমি সুগিমতোর নামানুসারে ফুলটির বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে।
ভলকানিক ব্যাকটেরিয়া
সমুদ্রের নিচের আগ্নেয়গিরি জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। ২০১১ সালে ক্যানারি দ্বীপের তীরে তোগোরো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে ঠিক এমনটিই ঘটে। কিন্তু তিন বছর পরে সেখানে এক ধরনের প্রোটেওব্যাক্টেরিয়ার উদ্ভব হয়। তোগোরোর কর্ণে প্রায় অর্ধ একর জায়গা জুড়ে একটি সাদা মাদুরের মতো সৃষ্টি করেছে এটি। সেখানে একটি নতুন বাসস্তুতন্ত্রের সূচনার জন্য সাহায্য করছে এই ব্যাকটেরিয়া।
মারসুপিয়াল সিংহ
প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ বছর পূর্বে অস্ট্রেলিয়ার উন্মুক্ত বনে মারসুপিয়াল সিংহ বসবাস করতো এবং এর অধিকাংশ সময় গাছে অতিবাহিত করতো। আবহাওয়া শুষ্ক ও ঠাণ্ডা হওয়ার সাথে সাথে এই সর্বভুক প্রাণীটির ওজনও বাড়তে থাকে। কুইন্সল্যান্ডের একটি স্থানে ফসিল উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই প্রজাতির সন্ধান মেলে।
কেইভ বিটল বা গুহা পোকা
গুহায় বসবাসকারী পোকাগুলো অন্যান্য সাধারণ পোকার মতোই, তবে এগুলোকে অভিযোজিত হতে হয়। চীনের দক্ষিণে অবস্থিত একটি প্রদেশের গুহা থেকে এই প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়। অভিযোজিত হওয়া এই পোকার মাকড়সার মতো পা, অখণ্ড দেহ রয়েছে। তবে চোখ বা ওড়ার মতো পাখা নেই। এটি লম্বায় অর্ধ ইঞ্চির মতো হয় এবং এর মাথাটি বেশ লম্বা।
এগুলোই এবছরের সেরা ১০টি নতুন প্রজাতি। প্রতি বছর মে মাসের ২৩ তারিখে আধুনিক শ্রেণীবিন্যাসের জনক ক্যারোলাস লিনিয়াসের জন্মদিনে প্রকাশ করা হয় সেরা ১০ প্রজাতির এই তালিকা।
ফিচার ইমেজ: CNN.com