হাঁস আমাদের সকলের পরিচিত একটি জলচর প্রাণী। সারাবিশ্বে ১২০ প্রজাতির হাঁস রয়েছে। সচরাচর আমরা যে হাঁসগুলো দেখি সেগুলোর নীল-বেগুনি পালক, উজ্জ্বল সবুজাভ মাথা ও রূপালী-সাদা শরীর থাকে। কিন্তু অল্প সংখ্যক কিছু হাঁস রয়েছে যেগুলো আমাদের সচরাচর দেখা হাঁস থেকে ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। হাঁসগুলো সাধারণত আকর্ষণীয় পালক ও অদ্ভুত ঠোঁটের অধিকারী হয়ে থাকে। সেইসাথে তাদের ডাকার শব্দও হয়ে থাকে অদ্বিতীয়। প্রথম দর্শনে যে কেউই চমকে যেতে পারেন। আজ জানাবো এমনই কয়েকটি ভিন্ন চেহারার বুনো হাঁসের কথা।
হারলিকুইন হাঁস
হাঁসের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে আসে আবদ্ধ পুকুরের কাদা-জলে সারাদিন ডুব-সাঁতার কাটা একটি পাখির নাম। কিন্তু হারলিকুইন হাঁস আবদ্ধ জল কিংবা কম স্রোতের পানিতে ডুব-সাঁতার কাটে না। এরা গ্রীষ্মকালে পর্বত থেকে নেমে আসা জলজ স্রোতে সাঁতার কাটে। আবার শীতকালে শীলাযুক্ত সমুদ্রতটের নিকট যেখানে স্রোত ও বিশালাকার ঢেউ আছড়ে পড়ে, সেখানে সাঁতার কাটতে পছন্দ করে। এরা স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটে ও ভেসে বেড়ায়। শীতকালে সমুদ্রতটে থাকা শীলার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে সাঁতরে চলাচল করে। পানি থেকে উঠে রাস্তা সহজ-সোজা করার অভ্যাস এদের নেই। এজন্যই হয়তো একে সামুদ্রিক ইঁদুরও বলা হয়। হাঁসটির আরও কয়েকটি সুন্দর নাম রয়েছে। যেমন- পেইন্টেড হাঁস, শিলা হাঁস, গ্লাসিয়ার হাঁস ও সাদা চোখের ডুবুরী।
উত্তর আমেরিকায় প্রাপ্ত হাঁসটির চোখের সামনে সাদা দাগ ও কানের চারপাশে গোলাকার সাদা বিন্দুর মতো চিহ্ন থাকে। পুরুষ হাঁসটি দেখতে সেলেট-নীল ও উভয়পাশে লালচে বাদামী বর্ণযুক্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে সাদা দাগ ও বিন্দু থাকে। অপরদিকে স্ত্রী হাঁসটি গাঢ় বাদামী বা ছাই বণের্র হয়ে থাকে। সুন্দর এই হাঁসটি বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Histrionicus histrionicus।
লম্বা লেজী হাঁস
লম্বা লেজী হাঁসের মাথা থেকে লম্বা লেজ পর্যন্ত আলঙ্কারিক পালক রয়েছে। এই হাঁসটি পানির অনেক গভীর পর্যন্ত ডুব দিতে পারে। খাদ্যের সন্ধানে সমুদ্র জলের ২০০ ফুট গভীর পর্যন্ত ডুব দেয়!
হাঁসটি পালকের বর্ণ, পালক ঝরানোর ক্রম, খাবার সংগ্রহের আচরণ এবং ডাকার শব্দে সম্পূর্ণ আলাদা। এরা বছরে দু’বার পালক ঝরায় যেখানে অন্যান্য হাঁসগুলো সাধারণত একবার পালক ঝরায়। এছাড়াও খাবার সংগ্রহের জন্য অন্যান্য হাঁসের চেয়ে দীর্ঘক্ষণ পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে। উত্তর মেরুর দিক ও উত্তর আমেরিকায় বিচরণকারী এই হাঁসটির বৈজ্ঞানিক নাম Clangula hyemalis।
মান্দারিন হাঁস
মাছ শিকারী হিসেবে খ্যাত মান্দারিন হাঁসটিকে সাধারণত এশিয়া, চীন, ইউরোপ, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ওয়েলস এ পাওয়া যায়। আবার এটিকে বিশ্বের বিভিন্ন অংশ, যেমন- ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ক্যালিফোর্নিয়ায় বন্দী অবস্থায় পাওয়া যেত। পরে মানুষের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এরা পালিয়ে মুক্ত পরিবেশে চলে যায়।
চীন, জাপান ও উত্তর কোরিয়ায় এই হাঁসকে ভালবাসা ও বিবাহের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই হাঁসের স্ত্রী-পুরুষ সারাজীবন একইসাথে বিশ্বস্ততার সাথে সাঁতার কেটে বেড়ায়। এরা এতটাই বিশ্বস্ত ও ভালবাসায় আবদ্ধ যে, দুটোর একটি যদি কোনো কারণে হারিয়ে যায় অথবা মারা যায়, তবে খুব শীঘ্রই অপরটিও মারা যেতে পারে!
সাধারণত পুরুষ মান্দারিন হাঁসটিকেই খুব সুন্দর দেখায়। কারণ চিত্তাকর্ষক, রঙিন পালক শুধুমাত্র পুরুষ হাঁসটিরই থাকে। এই সৌন্দর্যের মাধ্যমে পুরুষ হাঁস, স্ত্রী হাঁসকে আকর্ষণ করে।
Aix galericulata হচ্ছে মান্দারিন হাঁসের বৈজ্ঞানিক নাম। জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে এই হাঁসটির সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অল্পকিছু হাঁসের মধ্যে মান্দারিন প্রজাতির হাঁসকেও মাংসের জন্য শিকার করা হয় না। কারণ এদের মাংসের স্বাদ খুবই খারাপ।
উড হাঁস
উড হাঁস বা কাঠ হাঁস উত্তর আমেরিকায় প্রাপ্ত জলজ পাখিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর প্রজাতির রঙিন পাখি। বর্ণের দিক থেকে এটি অনেকটা মান্দারিন হাঁসের কাছাকাছি পরিবারের। বৃক্ষাচ্ছাদিত জলায় সাঁতার কাটে ও কাঠে গর্ত করে বাসা তৈরি করার কারণে কাঠ হাঁস বলা হয়।
হাঁসটির মাথা উজ্জ্বল সবুজ ও সাথে সাদা দাগ কাটা থাকে। স্ত্রী হাঁস দেখতে ধূসর-বাদামী বর্ণের হয়। Aix sponsa হচ্ছে হাঁসটির বৈজ্ঞানিক নাম। অবাধে শিকার ও বড় বড় গাছপালা কমে যাওয়ায় সুন্দর এই বন্য হাঁসটি বর্তমানে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
রাডি হাঁস
পুরুষ রাডি হাঁস বা রক্তাভ হাঁসের পালকের বর্ণ লালাভ হয়ে থাকে। এছাড়াও এর ঠোঁটের বর্ণ উজ্জ্বল নীল বর্ণের হয়। এই বর্ণ দিয়ে এরা স্ত্রী হাঁসকে প্রজননের জন্য আকৃষ্ট করে। তবে শীতকালে পালক ও ঠোঁট বিবর্ণ হয়ে ধূসর বর্ণ ধারণ করে। হাঁসটির বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Oxyura jamaicensis।
রাডি হাঁস দীর্ঘ সময় ধরে পানিতে থাকতেই পছন্দ করে। শরীরের আকার বিবেচনায় অন্য যেকোনো হাঁসের চেয়ে এরা বড় ডিম পাড়ে। প্রজনন মৌসুমে এরা খুবই আক্রমণাত্মক হয়। জানা যায়, এরা তীরের নিকটে আসা খরগোশের খাবার সংগ্রহকে বাঁধাগ্রস্থ করতে পারে। এই প্রজাতির হাঁসের দেখা মেলে যুক্তরাজ্যে। তবে সেখানেও এদের সংখ্যা খুবই কমে গেছে। বর্তমানে এই হাসের সংখ্যা ১০০টিরও কম!
উত্তরাঞ্চলীয় শাভালার
শাভালার হাঁসটিকে দেখতে আমাদের দেশে প্রাপ্ত হাঁসের মতই লাগতে পারে। কিন্তু পার্থক্য দেখা যায় ঠোঁটে। এই হাঁসগুলোর লম্বা চামচের ন্যায় ঠোঁট রয়েছে। ঠোঁটের প্রান্ত দিয়ে ১১০টি চিরুনীর মতো দাঁত রয়েছে। এর ঠোঁটের গঠন ছাকনির মতো কাজ করে। ফলে এরা কাদা থেকে ক্রাস্টেসিয়ান জাতীয় প্রাণীকে আলাদা করতে পারে। এরা সাধারণত খাবারের জন্য অন্যান্য হাঁসের সাথে প্রতিযোগিতা করে না। Anas clypeata হচ্ছে হাঁসটির বৈজ্ঞানিক নাম।
সার্ফ স্কোটার
সার্ফ স্কোটার হাঁসের অত্যান্ত আকর্ষণীয় ঠোঁট রয়েছে। ঠোঁটের জন্য একে ‘Skunk-headed coot’ নামে ডাকা হয়। এই হাঁসকে গ্রীষ্মকালে প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরে পাওয়া যায়। এরা সাধারণত শামুক, ক্রাস্টেসিয়ান, জলজ পতঙ্গ এবং বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট পোকামাকড় খায়।
Melanitta perspicillata হচ্ছে সার্ফ স্কোটার হাঁসের বৈজ্ঞানিক নাম। IUCN এর তথ্যানুসারে, ২০০৬ সালে ২ লক্ষ ৫০ হাজার – ১ কোটি ৩০ লক্ষ হাঁস ছিল। তবে এই সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে।
স্মিউ হাঁস
কাকের বাসায় ডিম পাড়ায় কোকিলের চতুরতার কথা অনেক শোনা হয়েছে। কিন্তু জানা আছে কী, কোকিলের মতো চুপিসারে ডিম না পাড়লেও কাঠঠোকরার বাসা সম্পূর্ণ নিজের দখলে নিয়ে নেয় স্মিউ হাঁস! সেখানে তারা নিজেদের বাচ্চা লালন পালন করে।
এই হাঁস ইউরোপ মহাদেশের তৈগা অঞ্চল ও এশিয়া মহাদেশে পাওয়া যায়। এর পালক সাদা ও কালো বর্ণের হয়। Mergus Albellus হচ্ছে হাঁসটির বৈজ্ঞানিক নাম।
কিং এইডার
কিং এইডার হাঁসটি উত্তর মহাসাগরীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। Somateria spectabilis হচ্ছে হাঁসটির বৈজ্ঞানিক নাম। বিশ্বে খুব অল্প সংখ্যক হাঁস রয়েছে যাদের মুখ কিং এইডারের মতো। এর ঠোঁটের উপর মুকুটের মতো নব বা গাঁট থাকে। মুকুটের মতো দেখা যায় বলেই নাম হয়েছে কিং (King)। আর উত্তর মহাসাগরীয় অঞ্চলে পাওয়া যাওয়ায় এর নাম হয়েছে এইডার (Eider)। দেখতে সুন্দর এই হাঁসটি খাদ্যের সন্ধানে ৮০ ফুট গভীর পর্যন্ত ডুব দিতে পারে।