সামনের লম্বা পা দুটি এমনভাবে বাঁকানো এবং একসাথে বিশেষ কোণে জুড়ে রাখা, যেন দেখলে মনে হবে পতঙ্গটি নিশ্চয়ই প্রার্থনারত! বিশেষ এই ভঙ্গির কারণেই এই ম্যান্টিসদের নাম প্রেয়িং ম্যান্টিস বা প্রার্থনারত ম্যান্টিস। ম্যান্টিসদের সাথে মানুষের বিশেষ সখ্যতাও বেশ পুরনো। প্রাচীন মিশরেও এদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া, প্রাচীন গ্রিসের মানুষেরা মনে করতো, অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী এই পতঙ্গগুলো। চীনা সংস্কৃতির সাথে অবশ্য ম্যান্টিসদের সম্পর্কটা একটু বেশিই দৃঢ়। প্রাচীন চীনা কবিতায় এদের বর্ণনা করা হয়েছে নির্ভীকতা ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে। উল্লেখ্য, প্রার্থনারত ম্যান্টিসদের শিকার করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ ও যুদ্ধের কৌশল থেকে ‘নর্দার্ন প্রেয়িং ম্যান্টিস’ ও ‘সাউদার্ন প্রেয়িং ম্যান্টিস’ নামের দুটি মার্শাল আর্ট সরাসরি অনুপ্রাণিত। যদিও এই দুই মার্শাল আর্টের মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য।
প্রায় ২,৩০০ এর উপরে ম্যান্টিসের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে গোটা পৃথিবী জুড়ে। অ্যান্টার্কটিকা বাদে সব মহাদেশেই কম-বেশি এদের দেখতে পাওয়া যায়। উত্তর আমেরিকায় মাত্র ২০টি স্থানীয় ম্যান্টিদের প্রজাতি রয়েছে। বাকি সব প্রজাতি অবশ্য হয় চীনা, না হয় ইউরোপীয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে চীনা ম্যান্টিসের প্রজাতি প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ফিলেডেলফিয়ায়, মাত্র ৮০ বছর পূর্বে এবং ইউরোপীয়গুলোর যুক্তরাষ্ট্রের আগমনের সময়ও মাত্র ১০০ বছরের মতো। আকারে চীনা ম্যান্টিসগুলো বেশি বড়, এদের চেয়ে মোটামুটি অর্ধেক আকারের হয়ে থাকে ইউরোপীয়গুলো। অন্যান্য পতঙ্গের তুলনায় পৃথিবীতে ম্যান্টিসদের বিচরণের বয়স অবশ্য তুলনামূলক কম। ম্যান্টিসের সবচেয়ে পুরনো যে ফসিলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, সেটি ১৪৬-৬৬ মিলিয়ন বছরের পুরনো হতে পারে। তবে সেই যুগের সাথে বর্তমানের এই পতঙ্গদের বেশ পার্থক্য রয়েছে। আজকের ম্যান্টিসের মতো প্রাচীন ম্যান্টিসদের প্রসারিত বা লম্বা ঘাড় ছিল না এবং পায়ে তেমন একটা কাঁটাও দেখা যেত না।
ম্যান্টিসের জীবনচক্রের মাত্র তিনটি ধাপ- ডিম, নিম্ফ ও প্রাপ্ত বয়স্কে পরিণত হওয়া। একটি নারী ম্যান্টিস ২০০ বা তারও বেশি ডিম দেয়, যেগুলো ওথেকা নামক ফেনা সদৃশ বস্তুতে ঘেরা থাকে। সময়ের সাথে এগুলো শক্ত হতে থাকে এবং ডিমগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করে। মজার ব্যাপার হলো, ম্যান্টিস, উইপোকা ও তেলাপোকা এগুলোকে নিকট আত্মীয় বলা চলে। কারণ, অতীতে পতঙ্গগুলোর সাধারণ একটি পূর্বপুরুষ ছিল। বিবর্তনের ধারায়, পরিবেশের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে এগুলো এবং শেষ পর্যন্ত আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে।
প্রেয়িং ম্যান্টিসের বৈজ্ঞানিক নাম Mantis religiosa, দৈর্ঘ্যে এরা মাত্র ০.৫-৬ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। এরা ইউরোপীয় ম্যান্টিস নামেও পরিচিত। গড়ে মাত্র এক বছরের মতো জীবনকাল হলেও অল্প সংখ্যক পতঙ্গদের মধ্যে এরা অন্যতম, যেগুলোকে বাড়িতে পোষা যায়। ছদ্মবেশ ধারণে ম্যান্টিসদের তুলনা হয় না। সাধারণত সবুজ বা বাদামী রঙের হয়ে থাকে এরা, তবে পরিবেশ অনুযায়ী আরও অন্যান্য রঙেরও দেখতে পাওয়া যায়। গাছের ডালে, সবুজ পাতার ফাঁকে বা ফুলের গায়ে এরা এমনভাবে আশ্রয় নেয় যে, খালি চোখে সহজে এদের দেখা পাওয়া বেশ কষ্টকর হয়ে যায়।
অর্কিড ম্যান্টিসরা ফুলের সাথে এমনভাবে মিশে যায় যে, অনেকসময় মধু আহরণ করতে আসা পতঙ্গগুলো ফুলের অংশ ভেবে ভুল করে এবং মুহূর্তে পরিণত হয় ম্যান্টিসদের খাবারে। ক্ষিপ্র গতি ও নিখুঁত লক্ষ্যভেদের সাথে শিকার ধরার জন্য ম্যান্টিসদের সামনের পায়ে কাঁটার মতো অংশ রয়েছে, যা ম্যান্টিসকে পরিণত করেছে দুর্দান্ত শিকারি পতঙ্গে।
ম্যান্টিসের খাদ্য তালিকায় ফড়িঙ, মাছি, মৌমাছি ইত্যাদি থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের পতঙ্গ রয়েছে। যদিও, মৃত কোনো কিছু এরা মুখেও তুলবে না, যা-ই খাবে, অবশ্যই জীবিত অবস্থায় মুখে তুলতে হবে সেগুলো।
খাদ্য শৃঙ্খলার ব্যাপারে অবশ্য এরা বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না। হামিংবার্ডদের আক্রমণ করা এদের জন্য খুব সাধারণ ব্যাপার। তবে খাবারের উদ্দেশ্যে তাদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে সানবার্ড, ফ্লাইক্যাচার, ইউরোপিয়ান রবিন থেকে শুরু করে ব্যাঙ ও টিকটিকি পর্যন্ত। খাবারের ব্যাপারে অবশ্য নারী ম্যান্টিসরা আরও ভয়ংকর, এরা যৌনমিলনের আগে বা পরে তাদের পুরুষ সঙ্গীকেই খেয়ে ফেলে! খাওয়ার এই পর্বটি অবশ্য যৌনমিলন চলাকালীন মুহূর্তেও ঘটে থাকে অনেক সময়। ভয়ংকর এই ক্যানিবালিজম শিকার হয় কমপক্ষে ৩০% পুরুষ ম্যান্টিস। মেয়ে ম্যান্টিসের পেটে চলে যেতে হতে পারে যেকোনো সময়, জানার পরও অবশ্য তাদের কাছে আসার আকাঙ্ক্ষায় এতটুকুও ভাটা পড়ে না। নারী ম্যান্টিসরা সাধারণত পুরুষদের থেকে আকারে বড় হয়। মনে করা হয়, পুরুষরা নিজেদের জীবন শুধুমাত্র যৌনমিলনের জন্যই হেলায় হারায় না, বরং তাদের খাওয়ার ফলে তার সঙ্গী ডিমের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টির যোগানও পেয়ে থাকে।
দুর্ধর্ষ এই শিকারি পতঙ্গগুলোর মাথা রয়েছে লম্বা ‘ঘাড়’ বা প্রসারিত থোরাক্সের উপরে। চারপাশের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার সুবিধার্থেই এগুলো নিজেদের ঘাড় ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘোরাতে পারে! সেই সাথে এদের রয়েছে দুটি বড় ধরনের চোখ এবং এগুলোর মাঝে আরও তিনটি সাধারণ চোখ বা ‘ওসেলাই’ রয়েছে! চোখের সাথে কানের সংযোগ অবশ্য তেমন সুবিধার নয় এদের। শোনার জন্য মাত্র একটি কান রয়েছে, তা-ও পেটের এক পাশে। শব্দের উৎসের দিক বা কম্পাঙ্ক নির্ণয় করতে পারে না ম্যান্টিসরা। তবে, আলট্রাসাউন্ড কিংবা পথ অনুসন্ধানের জন্য বাঁদুরের তৈরি করা শব্দ নির্ণয়ে এরা আবার বিশেষ পটু। তাই, বাঁদুরের আক্রমণের বিপক্ষে এরা যথেষ্ট দক্ষতার সাথে পালাতে পারে। কিছু ম্যান্টিসের অবশ্য একটি কানও নেই।
শিকারের উদ্দেশ্যে যেমন ম্যান্টিস ছদ্মবেশ ধারণ করে, তেমনি আত্মরক্ষার খাতিরেও এই বৈশিষ্ট্য তাদের বেঁচে থাকার জন্য খুবই সহায়ক। তাছাড়া, হুমকির মুখে এরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ও সামনের পা প্রসারিত করে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অবস্থান নেয়। যদিও এগুলো বিষাক্ত নয়, তবুও আত্মরক্ষার জন্য ম্যান্টিসরা কামড় দেয়। কিছু কিছু প্রজাতি অবশ্য প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে বাতাসে একধরনের শব্দ তৈরি করতে পারে।
ম্যান্টিসদের খাদ্য তালিকায় অনেক ধরনের পোকা থাকায় সাধারণত এদের উপকারী পতঙ্গ হিসেবে মনে করা হয়। তবে সত্যি বলতে, এরা উপকারী বা ক্ষতিকর পোকার মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য না করে সামনে যা পায় তাই খেয়ে নেয়। পরাগে সহায়তা করা উপকারী মৌমাছি বা ক্ষতিকর ক্যাটারপিলার, এগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই ম্যান্টিসদের। হয়তো আপনি বাগানের ভালোর জন্য ম্যান্টিস নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যে, শেষপর্যন্ত উপকার পাচ্ছেন নাকি অপকার।