ডলফিন, কে না চেনে তাদের? পানিতে বিচরণকারী এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি মানুষের সবচেয়ে প্রিয় প্রাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদের দেখলেই কি ছেলে কি বুড়ো, সবারই মন ভালো হয়ে যায়! প্রশিক্ষণ পেলে হেন কাজ নেই, যা এরা করতে পারে না। ফাঁদ পাতা, মানুষকে নকল করা, বাচ্চাদের সাথে বল নিয়ে লোফালুফি খেলার মতো কাজগুলিতে এদের জুড়ি নেই। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রে এরা হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। নাটকীয়তা আনতে সেখানে অধিকাংশ সময়ই এদের অতি বুদ্ধিমান এবং বিভিন্ন কাজে পারদর্শী হিসেবে দেখানো হয়েছে। ফলে এদের নিয়ে জন্ম নিয়েছে অনেক রকম ভ্রান্ত ধারণা। আজ ডলফিনদের সম্পর্কে এমন কিছু প্রচলিত বিশ্বাস তুলে ধরা হবে যেগুলো আদৌ সত্য নয়।
ডলফিনের শ্রবণশক্তি
ডলফিনদের নিয়ে একটি অতি প্রচলিত কথা হচ্ছে, তাদের নাকি দারুণ তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি। কতটা দারুণ? অনেকে বিশ্বাস করেন পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো শুনতে পায় এই ডলফিনেরা। কোনো প্রাণীর শোনার ক্ষমতা নির্ভর করে, তার কান কত রেঞ্জের শব্দ তরঙ্গ গ্রহণ এবং প্রসেস করতে পারে। মানুষ মোটামুটি ২০ হার্জ থেকে ২০ কিলোহার্জ কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট শব্দ তরঙ্গ শুনতে পায়। এর বেশি হলে আমরা তা শুনতে পাই না। ডলফিনরা ১৬০ কিলো হার্জ কম্পাঙ্ক পর্যন্ত শব্দ তরঙ্গ শুনতে পায়। এ হিসেবে তাদের শ্রবণ শক্তি নেহায়েত মন্দ নয়। মানুষের চেয়ে ভালো। কিন্তু সমস্ত জীবজগৎ বিবেচনায় আনলে ডলফিনের সিংহাসন অক্ষুণ্ণ থাকছে না। স্কটল্যান্ডে কিছু কিছু মথ পাওয়া যায় যারা ৩০০ কিলোহার্জ কম্পাঙ্কের শব্দতরঙ্গ শুনতে পায়। তার মানে জীবজগতের সেরা শুনিয়ের মুকুটটা যাচ্ছে এই অমেরুদণ্ডী প্রাণীগুলোর কাছে। আমাদের প্রিয় ডলফিনদের তারা প্রায় দ্বিগুণ পয়েন্টের ব্যবধানে পরাজিত করছে!
ডলফিনদের ভাষা আছে
ডলফিনরা চমৎকার শব্দ তৈরি করতে পারে। কখনো কখনো তাদের কন্ঠস্বর শুনলে মনে হবে তারা বুঝি নিজেদের মধ্যে মজার কোনো রসালাপে ব্যস্ত। কয়েকজন বিজ্ঞানী এটাও দাবী করেছেন যে ডলফিনরা রীতিমত কথা বলে এবং তাদের কথা নাকি ২০২১ সালের ভেতরে ডিকোড করাও সম্ভব হবে! কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রমাণ মিলেছে যে, ডলফিনরা নিজেদের ভেতরে যোগাযোগ করে। কিন্তু প্রকৃতিতে বহু প্রাণী আছে যারা ভাব প্রকাশ করে থাকে!
বাক বাকুম করে পুরুষ কবুতরের স্ত্রী কবুতরকে আকর্ষণ করতে আমরা অনেকেই দেখেছি। বিপদে পড়লে কাকেরাও তারস্বরে চিৎকার করে অন্য প্রজাতিকে সতর্ক করে দেয়। বিজ্ঞানীরা তাই যোগাযোগ করার ক্ষমতাকে ভাষা বলতে নারাজ। তারা ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, যেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু শব্দ থাকবে আর যাদের সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকবে এবং সেই সব শব্দের সুনির্দিষ্ট বিন্যাস দ্বারা বাক্য গঠন করতে হবে। ডলফিনরা স্বল্প পরিসরে যোগাযোগ করতে পারলেও সেটাকে ভাষা বলা চলে না কোনোভাবেই। যা-ই হোক, তাদের ভাষা থাকুক আর না-ই থাকুক, ডলফিনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তাতে বিন্দুমাত্র কমবে না একথা বলাই বাহুল্য!
আনন্দের জন্য যৌনতা
প্রাণীকুলের কাছে যৌনতা নিতান্ত বংশরক্ষার মাধ্যম হলেও মানুষের কাছে তা নয়। যৌনতা মানুষের কাছে বিনোদনের সবচেয়ে শক্তিশালী, আদিম এবং কার্যকর মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। প্রাণীকুলে সে একাই এই চর্চা করে বলে হয়ত একটু লজ্জার আবরণ ছিলো তাতে। কিন্তু মানুষকে মুক্তি দিলো ডলফিনরা।
মানুষের পরে দ্বিতীয় প্রজাতি পাওয়া গেল যারা আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে বিনোদন হিসেবে যৌনতায় লিপ্ত হয়। অন্তত এতদিনে মানুষ এটাই জেনে এবং মেনে এসেছে। এত দিনে ডলফিন মানুষের বাইরে একাই এই সম্মানটুকু ভোগ করে এলেও এখন তার মর্যাদায় অংশীদার এসেছে! কিছু কিছু ইঁদুর আছে যারা যৌনকার্যে লিপ্ত হলে তাদের মস্তিষ্কে আনন্দ অনুভুতি হয়। সিংহীদের ভেতরেও অনুরুপ ব্যাপার ঘটে।
ডলফিনের হাসি
আপনি যদি ডলফিন পার্কে বা চিড়িয়াখানায় তাদের সাথে সময় কাটিয়ে থাকেন, তাহলে তাদের মুখের হাসিখুশি ভাবটা আপনার চোখে পড়েছে, হলফ করে বলা যায়। তাদের মজার কার্যকলাপের বাইরে এই হাসিখুশি ব্যাপারটা মানুষকে তাদের দিকে আকর্ষণের প্রধান কারণ! বোতল-নাক ডলফিনের হাসিমুখ দেখলে রোকনুজ্জামান দাদাভাই তার বিখ্যাত ছড়ায় ডলফিনের কথা প্রথম দিকেই লিখতেন। এতদিন দিন মানুষ ভাবতো তারা খুব সুখী প্রাণী, তাই অমন অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে রাখে মুখে। কিন্তু এতদিনে বুঝি এই ভাবনার দিন ফুরোলো।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, হাসি সম্পূর্ণ একটি মানবীয় ব্যাপার। এটা মানুষের মনোভাব প্রকাশের মাধ্যম। অন্য প্রাণীর মুখ হাসি হাসি থাকলেই তারা যে খুব খুশি, এ কথা ভাবা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। খুব একচোট দৌড়ের পরে কুকুরেরা যখন মুখ হাঁ করে হাঁপায় তখনও তাদের মুখের অভিব্যক্তি অনেকটা হাসিমুখের সাথে মিলে যায়। অথচ বেচারা তখন ক্লান্তির চূড়ায়। তাছাড়া ডলফিনের মুখের মাংসপেশি এমনভাবে সজ্জিত যে তারা চাইলেই অন্যরকম মুখভঙ্গি করতে পারবে না।
আপনারা হয়ত অনেকে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের এনিম্যাল সায়েন্স ফিকশনটি পড়েছেন। সেখানে পশু পাখিদের এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছিলো যে তাদের হাসি, কান্না, আনন্দ আর বিষাদ সবই হাসি দিয়ে প্রকাশ করতো। ডলফিনদের ব্যাপারটাও এমন। ডলফিন বিশেষজ্ঞ জাস্টিন গ্রেগ বলেন, “ও আচ্ছা! ডলফিনদের মুখে হাসি লেগে থাকে কারণ তাদের মুখটাই এমন।”
ডলফিনদের পরিবার
ডলফিনদের পরিবার আছে এবং তারা সারাজীবন একই সাথে কাটিয়ে দেয়- এমন কথা শুনতে নিশ্চয়ই বেশ ভালো শোনাবে। ডলফিনদের নিয়ে এই মিথটির উৎপত্তির পেছনে মূল কারণ এই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ছোট ছোট গ্রুপে দেখা যায়। কিন্তু তাদের পরিবারিক বন্ধনের সত্যতা মেলেনি।
বাচ্চারা যতদিন না স্বাবলম্বী হচ্ছে ততদিন তারা অন্য অনেক প্রাণীর মতো মায়ের সাথে থাকে। তবে সেই দলে কোনো বাবার অস্তিত্ব থাকে না কিংবা কেউ পিতৃত্বের দাবী নিয়ে আসে না। ডলফিনরা ছোট ছোট দলে থাকে, কারণ তাতে শত্রুর আক্রমণ মোকাবেলা করতে সুবিধা হয়। তাছাড়া ডলফিনরা সিংহের মত দলগত শিকারী নয়। বরং একাকী খাদ্য সংগ্রহে তাদের আগ্রহ বেশী। যেমন বোতল নাক ডলফিন অল্প গভীর জলে কাদার দেওয়াল তৈরি করে মাছদের আটকে ফেলে। তারপর সেগুলো দিয়ে উদরপূর্তি করে।
কিন্তু কিছু কিছু সময় দেখা যায়, তারা দলবেঁধে মাছগুলোকে তীরের দিকে নিয়ে যায়। তারপর একসাথে প্রবল ঝটকা দিয়ে সেগুলোকে কিনারায় তুলে দেয়। গাঙ্গেয় ডলফিনেদের ভেতরে এ প্রবণতা দেখা যায়। তবে সেগুলো নিছক একটি ভালো ভোজের আশায়। অন্যথায় তারা কখনো একটিমাত্র দলে সারাজীবন কাটিয়ে দেয় না। বরং একদল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেয়। আবার তার ছেড়ে যাওয়া দলে অন্য সদস্য যুক্ত হয়।
মিলিটারি ডলফিন
পশুপাখি দিয়ে পুঁতে রাখা গোপন বোমা, ল্যান্ডমাইন শনাক্তকরণ নতুন কিছু না। বম্ব স্কোয়াডে কুকুরের অন্তর্ভুক্তি নিয়মিত ব্যাপার। আমেরিকা ল্যান্ডমাইন শনাক্তকরণে ‘আফ্রিকান জায়ান্ট র্যাট’ বেশ সফলতার সাথে ব্যবহার করে আসছে। এরা মূলত বিস্ফোরক রাসায়নিকের গন্ধ শুঁকে কাজ করে। যা-ই হোক, কথা বলছিলাম ডলফিন নিয়ে। ১৯৬০ সাল ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার কথা। আমেরিকা সমুদ্রে নজরদারি করার জন্য ডলফিনদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবহার করেছিলো। তাদের কাজ ছিলো জলের নিচে মাইন ও বোমা খুঁজে বের করা- এ কথা বহুল পরিচিত। এমনকি স্নায়ু যুদ্ধের সময় রাশিয়া ‘কিলার ডলফিন’কে ট্রেনিং দিচ্ছে এমন শোনা গিয়েছে। কিন্তু এসব পরে গুজব বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
পরিশেষে বলতে গেলে, ডলফিন নিয়ে আমাদের মধ্যে বাকবিতন্ডা যা-ই থাকুক না কেন, এরা যে আমাদের একটা আনন্দের উৎস, তাতে দ্বিমত নেই। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি যে বেশ স্মার্ট তা আমরা আগের নিবন্ধে প্রমাণ পেয়েছি। আমাদের দেশে নদ নদীতে এখনও কিছু ডলফিন প্রজাতি পাওয়া যায়, স্থানীয়ভাবে যা শুশুক নামে পরিচিত। আমাদের কর্তব্য এদের সংরক্ষণ করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই আনন্দপ্রিয় প্রাণীগুলোকে নিজের চোখে দেখতে পারে।
ফিচার ইমেজ- auntybinnaz