ডলফিনের নাম শুনলে আমাদের মনে হাসিখুশি আদুরে এক প্রাণীর কথা মনে পড়ে। তারা নানারকম খেলায় পটু এবং দারুণ বন্ধু স্বভাবের। মানুষের অন্যতম প্রিয় এ প্রাণীকে নিয়ে আমাদের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। সাধারণ মানুষ ডলফিনকে একটি স্মার্ট, চালাক-চতুর প্রাণী হিসেবেই মানে। এমনকি এটা নিয়েও আমরা বিতর্ক করে থাকি মানুষের পরে দ্বিতীয় বুদ্ধিমান প্রাণী এই জলজ স্তন্যপায়ীরাই!
এর সত্যতা কতটুকু? আদৌ কি তারা অতটাই স্মার্ট?
ফাঁদ পাতা
মিসিসিপির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী গবেষণা কেন্দ্রের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ডলফিনদের একুরিয়াম। একবার তাদের একুরিয়াম পরিষ্কার করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। উদ্দেশ্য জলচর এই প্রাণীগুলো মানুষের নির্দেশ কত দ্রুত রপ্ত করতে পারে তা দেখা। কিন্তু পুরস্কার না মিললে কি কাজে আনন্দ আছে?
ডলফিনেরাও তার বাইরে নয়! তাদের কাজে উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। একুরিয়ামের তলা থেকে ময়লা কাগজ বা অন্যান্য জঞ্জাল এনে দিতে পারলেই একটি করে মাছ পেতো তারা। ফলে মহা উৎসাহে ডলফিনগুলি তাদের কাজ সমাধা করে যাচ্ছিলো। আর বাগিয়ে নিচ্ছিলো তাদের কাঙ্ক্ষিত উপহার।
কিন্তু এদের মাঝে কেলি যা করলো তা যেমন চমকপ্রদ তেমনি অভিনব। ঐ একুরিয়ামেরই একটি ডলফিনের নাম কেলি। সে কাগজের টুকরোগুলো সংগ্রহ করে লুকিয়ে ফেলতে লাগলো। আর কিছুক্ষণ বাদে সেগুলো প্রশিক্ষকদের কাছে ফেরত দিলো।
তবে ফেরত দেওয়ার আগে সে অন্য একটি কৌশল অবলম্বন করলো। আস্ত কগজের টুকরোর বদলে সে সেটিকে ছিঁড়ে অনেক টুকরোতে ভাগ করে তারপর ফেরত দিতে লাগলো। কারণ সে বুঝতে পেরেছিলো ছোট হোক আর বড় হোক প্রতি টুকরো কাগজের জন্যই রয়েছে মাছের বরাদ্দ।
কেলি যে তার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এমন উপায় বের করেছিলো, তা না বললেও চলে। তবে কেলির বুদ্ধির দৌড়ের আরো বাকি আছে।
একদিন কেলির ট্যাঙ্কের উপরে একটি সামুদ্রিক চিল এসে বসলো। অমনি কেলি চট করে তাকে ধরে ফেললো। তারপর যথারীতি জমা দিলো। এই কাজে খুশি হয়ে প্রশিক্ষক অনেকগুলো মাছ একবারে উপহার দিল কেলিকে।
কিছুক্ষণ পরে এক আজব ব্যাপার দেখা গেলো। কেলি তার মাছের কয়েকটি ট্যাঙ্কের উপর ছড়িয়ে রাখতে লাগলো। সেই মাছের লোভে আরো পাখি আসতে লাগলো আর কেলির ফাঁদে পা দিতে থাকলো। কেলিও মনের আনন্দে মাছ সাবাড় করতে লাগলো।
এখানেই শেষ নয়, সী-গাল ধরার ফাঁদ কেলি তার সন্তানদেরও শিখিয়ে দিয়েছিলো। আস্তে আস্তে পুরো দলের সদস্যরাই শিখে নিয়েছিলো পদ্ধতিটি।
বুদ্ধিমান না হলে এমনটি সম্ভব?
মাস্কের ব্যবহার
জলের উপরিভাগের মাছের তুলনায় নিচের মাছগুলো অনেক বেশি নাদুসনুদুস হয়ে থাকে। কারণ তলায় খাদ্যের যোগান অনেক বেশি; খাদ্যের জন্য তাই দৌড়াদৌড়ি করতে হয় কম। বোতল-নাক ডলফিনদের আবার এসব মোটাসোটা মাছগুলির উপর বেজায় লোভ।
জলের তলায় নাক দিয়ে এই মাছগুলোকে বালির উপরে খুঁজে বেড়ায় এরা। এতে যে অনেক সময় হিতে বিপরীত হয় না, তা নয়। মাঝে মধ্যে রাগী গোবদা গোবদা কাঁকড়ার সামনে পড়ে যায় এরা। তখন অবস্থা সঙ্গীন হয়ে ওঠে। ডলফিনগুলোর নাকের উপরে ধারালো দাঁড়া দিয়ে কামড় বসায় ওগুলো।
সাথে আছে সমুদ্রের তলদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা আকারের ধারালো পাথর। তাতে গুঁতো খেয়ে নাকের বারোটা বাজা অসম্ভব কিছু নয়। এই ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য তারা ব্যবহার করে সামুদ্রিক স্পঞ্জ। ওগুলোকে নাকের মাথায় আটকে রেখে দিব্যি মাছ খুঁজে বেড়ায় ওরা। কাঁকড়ার কামড় আর পাথরের ঘষা সব স্পঞ্জের উপর দিয়েই যাক!
বুদ্ধিটা নেহায়েত মন্দ নয়, কী বলেন?
অনুকরণ ক্ষমতা
ডলফিনদের আরেকটি ক্ষমতা হচ্ছে অনুকরণ করার বিষয়টি। তারা অন্যসব প্রাণীর তুলনায় খুব নিখুঁতভাবে মানুষের হাবভাব নকল করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, মানুষের কন্ঠ অনুকরণ করায় তাদের জুড়ি মেলা ভার। প্রাণীজগতে অনেক প্রাণীই দেখা যায়, যারা মানুষের বৈশিষ্ট্য নকল করতে পারে, যেমন বানর বা টিয়াপাখি। কিন্তু বানর শুধু মানুষের অঙ্গভঙ্গি নকল করতে পারে। অপরদিকে টিয়াপাখি পারে শুধু মানুষের কন্ঠ নকল করতে।
অপরদিকে ডলফিল শুধু মানুষের অঙ্গভঙ্গি নয়, কন্ঠস্বরও নকল করতে পারে নিপুণ দক্ষতায়। অথচ তাদের শারিরীক গঠন মানুষের সাথে একেবারে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। তাই মানুষের শারীরিক ভঙ্গিমা নকল করতে হলে সেটা যে তাদের অনেক ভেবেচিন্তে মাথা খাটিয়ে করতে হয়, তা তো না বললেই চলে। আর যা-ই হোক, পাখনাকে হাতের মতো আর লেজকে পায়ের মতো করে ব্যবহার চাট্টিখানি কথা নয়!
অন্যদিকে মানুষের ভোকাল কর্ড থেকে তাদের ভোকাল কর্ড তো বেমালুম আলাদা। মানুষের কন্ঠস্বর বলতে গেলে তাদের কাছে ভিনগ্রহী এলিয়েনের মতোই। তবু ডলফিনের কন্ঠে মানুষের কন্ঠস্বর শুনলে আঁতকে উঠতে হয়! এতোই নিখুঁতভাবে কাজটা সমাধা করে ওরা!
হাঙরের মোকাবেলা
ডলফিনরা যেখানে ঘুরে বেড়ায়, তার আশেপাশেই হাঙর দেখা যায়। কখনো কখনো ক্ষুধার্ত হাঙর ডলফিনকেও তাড়া করতে ছাড়ে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাঙ্গরের কপালে জোটে লবডঙ্কা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাঙ্গর কামড় বসায় বটে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারে না। বড়জোর এক খাবলা মাংস উঠিয়ে নেয়।
বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন, হাঙরের আক্রমণে আহত হলেও ডলফিনেরা খুব বেশি গা করে না। যেন এটা এদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এমনকি তাদের আচরণে ব্যথার চিহ্নও নেই। আশ্চর্য বিজ্ঞানীরা দুটি ডলফিনকে পর্যবেক্ষণে রাখলেন। তাদের গায়ে হাঙরের আক্রমণে বাস্কেটবলের মতো সাইজের দুটি ক্ষত তৈরি হয়েছিলো।
সপ্তাহখানেকের ভেতরে তাদের ক্ষত ঠিক হয়ে গেলো এমনভাবে, যেন ওখানে কোনো ক্ষত ছিলোই না। ক্ষততে কোনো ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশনও হয়নি।
গবেষণায় বেরিয়ে এলো, এই প্রাণীগুলোর শরীরে কোনো ক্ষত তৈরি হলে সেখানে একধরনের অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথানাশক রাসায়নিক ক্ষরিত হয়। ফলে সমস্ত ব্যাপারটা উপেক্ষা করে চলতে পারে!
ডলফিনের ঘুম
ডলফিন জলে থাকলেও শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য নিয়মিত বিরতিতে জলের উপরে উঠে আসতে হয়। সুতরাং ঘুমাতে হলে হয় তার জলের তলায় ঘুমাতে হবে, নইলে জলের উপরে। কিন্তু জলের তলে ঘুমালে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অপরদিকে জলের উপরে ঘুমালে শত্রুর দৃষ্টি সহজে তার উপরে পড়বে। তাই ঘুমানোর মত কাজগুলি তাদের জন্য বেশ বিপদজনক কাজ হয়ে দাড়ায়।
এমতাবস্থায় ডলফিন যে পথ বেছে নিয়েছে, তা খুবই চিত্রাকর্ষক। এরা কখনোই পুরোপুরি ঘুমায় না। তার বদলে ঘুমানোর সময় অর্ধেক মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় করে দেয়। বাকি অর্ধেক মস্তিষ্ক সজাগ থাকে। এই সময়ে একধরনের অটো-পাইলটে চলে যায় এরা।
একটি চোখ যথারীতি বন্ধই থাকে, কিন্তু অন্য চোখ? সেটি কিন্তু খোলা রাখে সে। এই খোলা চোখে এরা দেখতে পায় আশেপাশে শত্রুর কোনো উপস্থিতি আছে কিনা। শুধু তা-ই নয়, আধোঘুমে এরা চলাচল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, পারে সমুদ্রপৃষ্ঠে ভেসে উঠতে। এমনকি বিপদের সম্ভাবনাও তার ঘুমন্ত মস্তিষ্ককে এড়িয়ে যেতে পারে না।
প্লে-বয় ডলফিন
ধরুন, আপনি কয়েকজন বন্ধুর সাথে পার্কের একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এদের মধ্যে আপনি নিয়মিত জিমে যান। আপনার বুকের পেকটোরালিস মাসল জামা ফেটে বাইরে আসতে চাচ্ছে। আর হাতে পুরু বাইসেপ; তার কথা না-ই বলি!
ঠিক এমন সময়ে চমৎকার একজন মেয়ে আপনার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলো। স্বয়ংক্রিয়ভাবে, আপনার বুক কয়েক ইঞ্চি প্রসারিত হয়ে যাবেই যাবে। হয়তো জামার হাতা গুটিয়ে বাইসেপস-ট্রাইসেপসও দেখিয়ে দিতে পারেন! এ আর তেমন কিছু নয়, শুধুমাত্র একটু দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা!
কিছু কিছু ডলফিনও ঠিক এভাবে নিজেকে ‘হিরো’ প্রমাণ করতে চায়। তাদের তো আর বাইসেপস নেই। তাহলে হয়তো পেশি ফুলিয়ে কাঙ্ক্ষিত মেয়ের সামনে যেত। তাই সে ভারি পাথর তুলে ধরে নিজের মুখ দিয়ে। শক্তিমত্তার পরিচয় দেওয়ার জন্য বুদ্ধিটা বেশ চিত্তাকর্ষকই বটে।
ভালো কথা, এ ধরনের ডলফিনেরা একটু রাগীও হয় বটে। মাসল পাওয়ার বলে কথা!
মোদ্দাকথা হলো, ডলফিনেরা এমন সব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় এবং এমনভাবে কিছু পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে যে, তাদের চালাক-চতুর না বলে উপায় নেই। তবে তাদের অনেক আচরণ অন্যান্য প্রাণীর ভেতরেও দেখা যায়। যেমন ধরুন, ডলফিন আয়নায় নিজেদের চিনতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু দোয়েলও কিন্তু সেই গুণে গুণান্বিত।
তারপরেও এত বেশি বৈশিষ্ট্যের সমাহার শুধুমাত্র একটি প্রাণীর ভেতরে ঘটেছে, প্রাণিজগতে (অবশ্যই মানুষ ছাড়া) যা বেশ দুর্লভ। সুতরাং তাদেরকে আমরা বুদ্ধিমান হিসেবে ধরে নিতেই পারি। নইলে তাদের মেধার প্রতি অবিচার করা হবে।
তবে মানুষের ডলফিন প্রিয়তার কারণে তাদের নিয়ে এমন সব গল্প ছড়িয়ে আছে, যার আদৌ কোনো সত্যতা নেই। কী সেগুলো? আগামী কোনো একদিন সেগুলো নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হবো নাহয়।