ইংরেজি সিমবায়োসিস (Symbiosis) কিংবা বাংলা মিথোজীবিতা শব্দটির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। দুটো ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী যখন একে অপরের সাথে বসবাস করতে থাকে এবং সেই সহাবস্থানের দ্বারা উভয়েই কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়, তখন সেই সম্পর্কটিকে আমরা মিথোজীবিতা বলে থাকি।
আমাদের চারপাশের প্রাণীজগতে মিথোজীবিতার এমন অনেকগুলো চমৎকার নমুনা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এরই মাঝে কিছু ঘটনা নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের এ লেখা।
১. আফ্রিকান অক্সপেকার
প্রথমেই আসা যাক আকাশচারী পাখিদের সাথে স্থলচর বিশালাকায় প্রাণীদের বন্ধুত্বের গল্প নিয়ে। বৃহদাকার হাতি থেকে শুরু করে গন্ডার, জেব্রা, কেপ বাফেলোদের পিঠে চড়ে চড়েই দিনের অধিকাংশ সময় পার করে দেয় এ পাখিগুলো। তবে তারা কিন্তু শুধু তাদের স্থলচর বন্ধুদের পিঠে বসে বসে অলস সময় কাটায় না। বরঞ্চ সেখানে বসে তারা খুটে খুটে খেতে থাকে তাদের আশ্রয়দাতাদের গায়ে থাকা নানাবিধ পোকামাকড় ও পরজীবীকে।
এতে উভয়পক্ষই লাভবান হয়ে থাকে। প্রথমত, এ পোকামাকড়গুলো গলাধঃকরণের মধ্য দিয়ে আফ্রিকান অক্সপেকার তার নিজের খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে, পাচ্ছে দরকারি পুষ্টি উপাদান। অন্যদিকে হাতি, গন্ডারের মতো প্রাণীগুলোও অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ‘অতিথি’কে নিজেদের দেহরস দিয়ে আপ্যায়নের ঝামেলা থেকে রেহাই পাচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, অক্সপেকারদের সাথে স্থলচর এই প্রাণীগুলোর এ মিথোজীবিতা চলে আসছে বহুদিন ধরেই। কারণ পাখিগুলোর ঠোঁট এমনভাবেই বিবর্তিত হয়েছে যেন তারা সেই প্রাণীগুলোর চামড়ার গভীর থেকে ঠিকমতো পোকামাকড় খুটে খেতে পারে। অন্যদিকে পিঠে বসে পাখিগুলো যদি তার বাহকের দিকে কোনো বিপদকে এগিয়ে আসতে দেখে, তাহলেই শুরু করে দেয় চিৎকার। ফলে সতর্ক হয়ে পালিয়ে যাবার সময়টাও পেয়ে যায় প্রাণীটি।
২. কাঁকড়া ও অ্যানিমোন
অ্যানিমোন হলো নলের মতো দেহবিশিষ্ট এবং কর্ষিকাযুক্ত একপ্রকার সামুদ্রিক প্রাণী। কাঁকড়ার সাথে অ্যানিমোনদের সম্পর্ক বেশ চমৎকার।
অ্যানিমোনরা হার্মিট কাঁকড়াদের পিঠের উপর চড়ে বসে। এরপর সেই বাহনে চড়ে কাঁকড়ার খাবারের উচ্ছিষ্টাংশটুকু গলাধঃকরণ করতে থাকে সে। তাহলে এখানে হার্মিট কাঁকড়া কীভাবে লাভবান হয়? আসলে এই অ্যানিমোনদের উপলক্ষে সৃষ্টিকর্তা তাদের জীবন বাঁচানোর উপায় করে দিয়েছেন! হার্মিট কাঁকড়ার পিঠের উপর যখন অ্যানিমোন বসে থাকে, তখন তাকে খুব একটা সুস্বাদু খাবার বলে মনে হয় না অক্টোপাসদের কাছে। ফলে তারা কাঁকড়াটিকে ছেড়ে অন্যদিকে নজর দেয়। আর কোনো প্রাণী যদি অ্যানিমোনটিকে খেতে আসে, তবে তার হাত থেকে নিজের পিঠে চড়ে বসা সঙ্গীকে রক্ষার গুরুদায়িত্ব তখন নিয়ে নেয় হার্মিট কাঁকড়া।
কাঁকড়ার পিঠে অ্যানিমোনদের এই চড়ে বসাটা কিন্তু দুর্ঘটনাবশত হয়ে থাকে না। কাঁকড়ারাই খুঁজে খুঁজে অ্যানিমোনদের বের করে নিজেদের পিঠে বসার ব্যবস্থা করে দেয়। এমনকি সে যখন খোলস পাল্টায়, তখন খোঁচা দিয়ে অ্যানিমোনকে নামিয়ে দেয়। তারপরে কাজ সেরে আবারও অ্যানিমোনকে জায়গামতো বসিয়ে দেয়!
৩. বুনো শূকর এবং বেঁজি
এবার ঘুরে আসা যাক আফ্রিকান সাভানা থেকে। উগান্ডার একদল বিজ্ঞানী দেশটির কুইন এলিজাবেথ ন্যাশনাল পার্কে বুনো শূকর এবং বেঁজিদের মাঝে এক অদ্ভুত রকমের সম্পর্কের খোঁজ পেয়েছেন।
তারা দেখতে পান, যখনই কোনো বুনো শূকর কোনো বেঁজির মুখোমুখি হচ্ছে, তখনই সে গা এলিয়ে মাটিয়ে শুয়ে পড়ছে। বেঁজিটি তখন শূকরের গা খুটে খুটে নানা রকম পোকামাকড় খেতে থাকে। এভাবে একদিকে বেঁজি তার খাদ্যের চাহিদা মেটায়, অন্যদিকে শূকরটিরও শরীর পরিষ্কারের কাজটি হয়ে যায়।
৪. কুমির ও প্লোভার পাখি
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আমরা সবাই দাঁত মেজে নিই যেন রোগজীবাণুর আক্রমণে অকালে সাধের দাঁতগুলো হারাতে না হয়। প্রাণীদের হয়তো আমাদের মতো ব্রাশ আর টুথপেস্ট নেই, কিন্তু এরপরেও তারা এতটা চমৎকার আর অদ্ভুতভাবে নিজেদের দাঁতকে পরিষ্কারের উপায় বেছে নিয়েছে যে, তা দেখলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
আফ্রিকার কুমির ও প্লোভার পাখির সম্পর্কের গল্পে আসা যাক। খাওয়াদাওয়ার পর হেলতে দুলতে ভয়ঙ্কর এ প্রাণীটি চলে যায় কোনো এক নদীর তীরে। এরপর সেখানে গিয়ে মুখ হাঁ করে শুয়ে থাকে। দূর থেকে কুমিরের দাঁতগুলো দেখতে ভয়ঙ্কর লাগলেও এটাই আসলে প্লোভারদের জন্য সংকেত। পাখিগুলো তখন উড়ে এসে সোজা কুমিরের মুখের ভেতর গিয়ে বসে। এরপর দাঁতে লেগে থাকা খাদ্যকণাগুলো খুটে খুটে খেতে শুরু করে দেয়! এ যেন অনেকটাই ছোটবেলায় বাবা-মা আমাদের দাঁত ব্রাশ করিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা।
এভাবেই আফ্রিকান কুমিরদের দাঁতগুলো রক্ষার গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে প্লোভার পাখিরা। এর মাধ্যমে তারা পাচ্ছে ফ্রি ফ্রি খাবার, অন্যদিকে কুমির পাচ্ছে নিজের দাঁতের সুরক্ষা। কখনো যদি আবার পাখিগুলো কোনো বিপদের ঘ্রাণ পায়, তাহলে সাথে সাথেই চিৎকার জুড়ে দেয়। তার চিৎকার শুনে কুমিরগুলো দ্রুত নদীতে ফিরে যেতে পারে।
সত্যি, কতই না অদ্ভুত তাদের মধ্যকার এ বন্ধুত্ব!
৫. পিস্তল শ্রিম্প ও গোবি মাছ
আবারো ফিরে যাওয়া যাক সমুদ্রের তলদেশে, যেখানে দলবেঁধে কিংবা একাকী ঘুরে বেড়ায় জানা-অজানা কতশত প্রাণী। এবার আমরা জানবো পিস্তল শ্রিম্প ও গোবি মাছের মধ্যকার মিথোজীবিতা নিয়ে।
তাদের সম্পর্কটা বেশ চমৎকার ও বন্ধুত্বপূর্ণ। পিস্তল শ্রিম্পের যদি গোবি মাছের সাথে থাকতে কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে সমুদ্রের তলদেশে মাটির বুকে সে প্রথমে গর্ত তৈরি করে। এরপর দুজনে মিলে সেখানে থাকা শুরু করে। এখানে তো দেখা যাচ্ছে লাভটা হচ্ছে গোবির, তাহলে শ্রিম্পের লাভটা কোথায়?
গোবির দৃষ্টিশক্তি বেশ প্রখর। যখন পিস্তল শ্রিম্প গর্তে থাকে, তখন সে বাইরে সতর্ক নজর রাখে চারিদিকে। কোনো বিপদের আভাস পাওয়ামাত্রই সে সতর্ক সংকেত পাঠিয়ে দেয় রুমমেটকে (কিংবা গর্তমেট!)। সাথে সাথেই সেখান থেকে পালিয়ে নিরাপদে আশ্রয়ে চলে যায় দুজন। এভাবে আশ্রয় পাওয়ার বিনিময়ে বন্ধুর জীবনটা রক্ষার কাজ করে থাকে গোবি মাছ।
পিস্তল শ্রিম্প চোখে প্রায় দেখতে পায় না বললেই চলে। ফলে যখন তার শিকার করে উদরপূর্তির দরকার হয়, সে তখন বিষয়টা গোবিকে জানায়। এরপর দু’বন্ধু মিলে সমুদ্রের নোনা জলের মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে একজনের খাবার সংগ্রহের কাজে। এ সময় দুজন যাতে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে, সেজন্য শুঁড় দিয়ে গোবির গায়ে স্পর্শ করে থাকে পিস্তল শ্রিম্প। কখনো কখনো দেখা গিয়েছে, গোবি নিজে থেকেই সামুদ্রিক শৈবাল এবং অন্যান্য খাদ্য তার বন্ধুর জন্য নিয়ে যাচ্ছে। কখনো আবার সেই খাবারগুলো সে গর্তের মুখে রেখে দেয় যাতে করে বন্ধু সেখান থেকেই খেয়ে নিতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে পিস্তল শ্রিম্পের আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা ততটা শক্তিশালী নয়। ফলে গোবির মতো এমন একটি প্রাণীর সাথে মিথোজীবিতা গড়ে তোলা তার খুব বেশিই দরকার।
৬. রেমোরা
এখনও সমুদ্রের তলেই থাকছি, তবে চলে যাবো কিছুটা বড় আকৃতির মাছের কাছে।
রেমোরা মাছগুলো সাধারণত ১-৩ ফুটের মতো লম্বা হয়ে থাকে। এদের সম্মুখ পৃষ্ঠদেশীয় পাখনাগুলো সময়ের সাথে সাথে এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে, সেগুলো এখন চোষক কাপের ন্যায় ক্রিয়া করে। এ কাপগুলোর অবস্থান মাছটির মাথার উপরের দিকে। যখন কোনো মান্টা রে কিংবা হাঙর সমুদ্রের বুকে চলাচল করে, তখন খুব সহজেই সেটার গায়ে লেগে থাকতে পারে রেমোরা মাছেরা।
লেগে থাকার ফলে কী লাভ? এর ফলে মূলত দু’দিক দিয়ে উপকৃত হয় রেমোরারা। প্রথমত, সে ফ্রি ফ্রি একজন বাহক পেয়ে গেলো, এবং দ্বিতীয়ত, সে তার বাহকের গায়ে লেগে থাকা কোনো খাদ্যাংশ নিজের পেটে ভরে উদরপূর্তির কাজটাও সেরে নেয়।
তো এখানে হাঙর কিংবা মান্টা রে কীভাবে উপকৃত হচ্ছে? রেমোরা যখন তাদের গায়ে লেগে থাকছে, তখন সে তার বাহকের শরীর পরিষ্কারের কাজটাও করে দেয়। এই পরিষ্কার অভিযানের মাধ্যমে হাঙর-মান্টা রে’র গায়ে লেগে থাকা বিভিন্ন পরজীবী ও ব্যাকটেরিয়া দূর হয়। নাহলে এগুলো তাদের গায়ে জ্বালাপোড়া থেকে শুরু করে ক্ষত পর্যন্ত তৈরি করতে পারতো। ফলে উভয় পক্ষই লাভবান হচ্ছে এ সম্পর্ক থেকে।
নিজেদের দেহ পরিষ্কারে সাহায্য করায় হাঙরেরাও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে ভোলে না। তারাও এই সেবকদের যাতে কোনো বিপদ-আপদ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখে। তবে হাঙরের সকল প্রজাতি যে এমন দয়ালু, সেটা ভাবলে আপনি ভুল করবেন। লেমন শার্ক ও স্যান্ডবার শার্করা কখনো কখনো রেমোরাদের এই চোষণক্রিয়াকে সহ্য করতে পারে না, বরঞ্চ খেয়েই ফেলে তাদের!
৭. মাকড়শা ও ব্যাঙ
আজকের লেখার শেষটা টানছি ডাঙায় ফেরত এসেই। আর যে মিথোজীবী সম্পর্কের কথা এখন বলবো, সেটাও বেশ মজাদার।
এই গল্পের বন্ধুদ্বয়ের বাস দক্ষিণ আফ্রিকায়। একটি কলম্বিয়ান লেজারব্ল্যাক টারান্টুলা এবং অন্যটি ডটেড হামিং ফ্রগ। টারান্টুলাটি চাইলেই ব্যাংটিকে খেয়ে উদরপূর্তি করে নিতে পারতো, কিন্তু সে তা করে না। বরঞ্চ তার সাথে গড়ে তোলে এক অন্যরকম সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক।
টারান্টুলাটি ব্যাঙের সাথে থাকার জায়গা ভাগাভাগি করে নেয়। তবে সেটা অবশ্যই একটি কাজের বিনিময়ে। যেকোনো রকম শিকারীর কবল থেকে ডটেড হামিং ফ্রগকে রক্ষার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয় কলম্বিয়ান লেজারব্ল্যাক টারান্টুলা। এর বিনিময়ে পিঁপড়ার দল যাতে টারান্টুলার ডিমের উপর আক্রমণ চালাতে না পারে, সেই বিষয়ে সতর্ক নজর রাখে ব্যাঙটি। পিঁপড়া আসলেই সে প্রভুভক্ত প্রহরীর মতো সেগুলোকে আপন পেটে চালান করে দেয়।
ফিচার ইমেজ: Youtube