আপনি কেন মানবজাতিকে অন্যান্য প্রাণীর থেকে উন্নত মনে করেন? জবাবটা হবে হয়তো তার চিন্তা করার ক্ষমতা বা বুদ্ধিবৃত্তির কারণে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিই তাকে অন্যান্য সকল প্রাণীর থেকে আলাদা করে তুলেছে। অন্য সকল প্রাণী যেখানে পৃথিবীতে কেবল টিকে থাকার সংগ্রামে রত, সেখানে মানুষ নিজস্ব ভাষা ও সভ্যতা গড়ে তুলেছে। অসাধারণ সব প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে এক প্রকার বশে এনেছে পৃথিবীকে। এখন তো পৃথিবী পেরিয়ে মহাকাশ জয় করার স্বপ্নও দেখছে তারা।
কেবল মানুষই কেন এটি করতে পারলো? অন্যান্য প্রাণী কেন পারলো না? কারণ অন্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের রয়েছে বেশ বড়সড় একটি মস্তিষ্ক। শুধু আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সই নয়, অন্যান্য আদি মানবেরও রয়েছিল এ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যটি। ষাট কেজি ওজনের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কের আয়তন যেখানে গড়ে মাত্র ২০০ ঘন সেন্টিমিটার, সেখানে দুই মিলিয়ন বছর আগের আদি মানুষের মস্তিষ্কের গড় আয়তন ছিল ৬০০ ঘন সেন্টিমিটার আর আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক গড়ে ১২০০-১৪০০ ঘন সেন্টিমিটার।
পুরো জগতে অন্য সব প্রাণী যখন নিজেদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক নিয়ে সুখে শান্তিতে আছে, সেখানে হুট করে মানুষের ঘাড়ে এমন বড়সড় একটি জিনিশ বসিয়ে দেয়া হলো, বিষয়টি কি ভালো কিছু হলো? হয়তো ভাবছেন, শরীরের অনুপাতে বড় মস্তিষ্ক মানে যখন বুদ্ধিবৃত্তি বেশি, তাহলেতো এটি বেশ ভালো একটি বৈশিষ্ট্যই। আসলে বিষয়টি এতো সহজ ছিল না। এই বৃহৎ মস্তিষ্কটির জন্য বেশ ভালোই খেসারত দিতে হয়েছিল মানবজাতিকে। এখানে মানবজাতি বলতে কেবল মাত্র আমাদের অর্থাৎ হোমো সেপিয়েন্সদের কথা বলা হয়নি। অন্যান্য আদি মানব প্রজাতির কথাও বলা হয়েছে। চলুন তাহলে দেখি মানবজাতির জন্য কী কী ঝামেলা বয়ে এনেছিল এই বস্তুটি?
বড়সড় একটা খুলির মধ্যে একটা ঢাউস মস্তিষ্ক বয়ে বেড়ানো শরীরের জন্য বেশ ঝামেলার ব্যাপার। তাছাড়া এর জন্যে শক্তির যোগান দেয়াও সহজ কথা নয়। ওজনের দিক থেকে এটি শরীরের শতকরা দুই বা তিনভাগ হলেও, বিশ্রামের সময় শরীরের পঁচিশভাগ শক্তি খরচ হয়ে যায় এর পেছনে, যেখানে একটি এপ বিশ্রামের সময় মস্তিষ্কের পেছনে ব্যয় করে মাত্র শতকরা আট ভাগ শক্তি। আদি মানুষেরা দু’ভাবে এর খেসারত দিয়েছেন: প্রথমত, খাদ্যের সন্ধানে অন্য প্রাণীর তুলনায় তাদের আরো বেশি ছুটতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাদের পেশীও হয়ে গেছে আপেক্ষাকৃত দুর্বল।
অনেকটা সরকারের প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট কমিয়ে শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর মতো, মানুষও তার বাইসেপে শক্তির যোগান কমিয়ে নিউরনে শক্তি যোগাতে শুরু করেছিল। পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য একে ঠিক প্রশংসনীয় কৌশল বলা যাবে না। কারণ একটি শিম্পাঞ্জী একজন মানুষের সাথে তর্কে হয়তো হেরে যাবে, কিন্তু এই প্রাণীটি অনায়াসেই ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে পারবে মানুষকে।
আপনি হয়তো বলবেন, তাতে কী? এখন তো আমাদের বৃহৎ মস্তিষ্ক ভালোই কাজে দিচ্ছে। এর কল্যাণে আমরা এখন গাড়ি বানিয়েছি, যা শিম্পাঞ্জীর থেকেও দ্রুত ছুটতে পারে। আর তার সাথে কুস্তি লড়ার দরকারই বা কী? আমরা তো তাকে দূর থেকেই গুলি করে কুপোকাত করে ফেলতে পারি। কিন্তু এই বন্দুক বা গাড়ি তো এসেছে সেদিন, মানুষের নিউরাল নেটওয়ার্ক সমৃদ্ধ হতে হতে আজ এসেছে এ পর্যায়ে। এর আগে দুই মিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় ধরে, এ মস্তিষ্ক নিয়ে মানুষ কিছু পাথুরে চুরি আর চোখা লাঠির চেয়ে বেশি কিছু তো বানাতে পারেনি।
মানুষের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষ দু’পায়ে ভর করে সম্পূর্ণ সোজাভাবে চলাচল করে। এর অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও, বেশ কিছু নেতিবাচক দিকও ছিল। বিশেষ করে নারীদের এটি বেশ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন করে। সোজাভাবে চলার সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের নিতম্ব সংকীর্ণ হয়, ফলস্বরূপ নারীদের বার্থ-ক্যানেলও সংকুচিত হয়ে আসে, এদিকে শিশুর মাথা বড় হয়ে উঠছে। সব মিলিয়ে জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে যায়।
যেসব মায়েরা তুলনামূলক অপরিপক্ব সন্তান জন্ম দিতেন, তারা তখন বেশি বেঁচে থাকা শুরু করেন। তাই সময়ের সাথে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী মানব শিশু অপরিপক্ব অবস্থায়ই জন্মাতে শুরু করে। এজন্যই দেখবেন একটি মুরগীর বাচ্চা যেখানে জন্মানোর দু’সপ্তাহ পর স্বাধীনভাবে বাঁচতে শিখে যায়, সেখানে বছরের পর বছর ধরে যত্ন ও শিক্ষার দরকার হয় একটি মানব শিশুর। এর ফলে আরেকটি বিষয় ঘটেছে- সন্তানের যত্ন নিতে গড়ে উঠেছে পরিবার, পরিবার থেকে এসেছে সমাজ। আর মানবশিশু অপরিপক্ব হয়ে জন্ম নেয়ায়, তাকে ইচ্ছেমত গড়ে তোলা যায়। প্রত্যেকটি মানুষকে করে তোলা যায় যথাযথ সামাজিক প্রাণী।
আজকে আমরা মনে করি এ বৃহৎ মস্তিষ্ক, যন্ত্রপাতির ব্যবহার, কোনো কিছু শেখার অসাধারণ ক্ষমতা ও জটিল সমাজ ব্যবস্থা মানবজাতির জন্য একটি বিশাল সুবিধা এনে দিয়েছে। এখন এটি মনে হওয়া স্বাভাবিক, কারণ এসবই এখন মানুষকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণীতে পরিণত করেছে। কিন্তু এসব কয়েক মিলিয়ন বছর আগে থেকেই ছিল। তবে মানুষ তখন ছিল একটি দুর্বল প্রাণী মাত্র। অন্যান্য প্রাণীকুলের ওপর তাদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না। ভয়ে ভয়ে কাটতো তাদের দিন, কখন কোন প্রাণী আক্রমণ করে বসে।
মিলিয়ন বছর আগেকার মানুষ বড় শিকারে খুব কমই সফল হতো। তারা বেঁচে ছিল মূলত ফলফলাদি বা উদ্ভিদজাত খাবারের ওপর নির্ভর করে। ছোটখাট কিছু প্রাণীকে শিকারও করতো। মাঝে মাঝে বড় কোনো শিকারী প্রাণীর খাওয়ার পর তার শিকারের বাকি ভাগ নিত মানুষ। এ বিষয়ে একটি কৌতূহল জাগানিয়া তথ্য দেয়া যায়- গবেষকদের মতে, আদি মানুষেরা তাদের পাথুরে অস্ত্রগুলোর মূল ব্যবহার করতো কোনো প্রাণীর অস্থি ভেঙ্গে অস্থিমজ্জা বের করতে। ভাবছেন, হয়তো অস্থিমজ্জাই কেন?
জবাবটা পেতে সে সময়টার কথা একটু ভাবুন। ধরুন, একটা সিংহ একটা জিরাফকে শিকার করলো। সিংহের সাথে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করার সামর্থ্য তো আর মানুষের নেই। তাই সে বেশ আয়েশ করে তার শিকারকে ভক্ষণ করলো। এবার হায়েনা, শৃগালদের পালা। সিংহের ফেলে যাওয়া শিকারের বাকী অংশটা সাবাড় করবে তারা। তাদের সাথে লাগতে যাওয়ার সাহসও নেই মানুষের। তারা খেয়েদেয়ে চলে যাওয়ার পর যদি কিছু বাকি থাকে তবে মানুষের পালা। এসময়ে এসে যা অবশিষ্ট থাকে তা থেকে হাড়গুলো ফেলে দিলে আর কিছু বাকী থাকবে বলে মনে হয় না, তাই যতটুকু সম্ভব হতো তা-ই খাওয়ার চেষ্টা চালাতো মানুষ।
এ বিষয়গুলো বর্তমান মানুষের মনঃস্তত্ব বুঝতে সহায়তা করে। খুব সাম্প্রতিক কালের আগে একটা সময় ধরে মানবজাতি খাদ্য শৃংখলের মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিল। ছোটখাট প্রাণীকে শিকার করতো। মাঝেমধ্যে নিজেও পরিণত হতো বড় প্রাণীদের শিকারে। গবেষকদের মতে, চার লক্ষ বছর পূর্বে থেকে মানবজাতির কিছু প্রজাতি বড় বড় শিকারে সফল হতে শুরু করে। আর লাখখানেক বছর আগে, যখন বর্তমান মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সদের উত্থানের সাথে মানুষ খাদ্য শৃংখলের সবচেয়ে উপরের পর্যায়ে চলে আসে। মানুষ যেন হুট করেই অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
অন্যান্য প্রাণী, যারা পিরামিডের চূড়ার দিকে ছিল, যেমন- সিংহ, হাঙ্গর ইত্যাদি, তারা এ পর্যায়ে অনেকটা ধীরে ধীরে এসেছে। মিলিয়ন বছরের বিবর্তনে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তারা। তাই বাস্তুসংস্থানও মানিয়ে নিয়েছে তাদের সাথে। যেমন সিংহ যখন সময়ের সাথে সাথে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, হরিণ আরো দ্রুত দৌড়াতে শিখে গেছে, হায়েনা আরো সহযোগী হয়ে উঠেছে, আর গণ্ডার হয়ে উঠেছে অতিরিক্ত বদমেজাজি। সবাই মিলে এক ভারসাম্য তৈরি করেছে প্রকৃতিতে।
কিন্তু গবেষকদের মতে, মানুষ এতটা দ্রুতই চূড়ায় উঠেছে যে বাস্তুসংস্থান মানিয়ে নিতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষ নিজেই মানিয়ে নিতে পারেনি তার নতুন পাওয়া ক্ষমতার সাথে। আগের শক্তিশালী প্রাণীরা ছিল নিজেদের আত্মবিশ্বাস আর গৌরবে পরিপূর্ণ। মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের দোর্দণ্ড প্রতাপ তাদের এই গৌরব এনে দিয়েছে। কিন্তু মানুষ এটা পায়নি। তারা এখনো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারেনি; তার অবস্থা অরক্ষিত, ভীত এক স্বৈরাচারের মতো।
এ কারণেই মানুষ এত বেশী ভয়ংকর আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। সমগ্র প্রকৃতির জন্যই তারা একপ্রকার হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠছে। ধ্বংসাত্মক সব যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাস্তুসংস্থানের বিপর্যয়ের মতো এমন অনেক বিষয়ের কারণ মানুষের এই দ্রুত ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা। তাদের কর্মকাণ্ডে পুরো পৃথিবীর ভবিষ্যৎই যেন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। আর এসবের জন্য মূলত দায়ী কি মানুষের এ বৃহৎ মস্তিষ্কটি?