পোকা অনেকের কাছেই আতংকের একটি জিনিস। কিলবিলে পোকা দেখলে কার না ভয় লাগে! ছোট্ট একটা তেলাপোকা দেখেই অনেকে আবার লাফিয়ে উঠে। সেই পোকার আকার যদি আপনার হাতের তালুর সমান হয় কিংবা প্রায় এক হাত লম্বা হয় তাহলে কেমন হবে বলুন তো? হ্যাঁ, পৃথিবীতে এমন অনেক পোকা আছে যা আকারে স্বাভাবিক পোকার চেয়ে অনেক বড় আর দেখতেও ভয়ঙ্কর! এসব পোকা দেখলে চমকে উঠবে যে কেউ। আজকে চলুন জেনে নেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় এমনই ৮টি পোকা সম্পর্কে।
৮. গোলিয়াথ বিটল
বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোকাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গোলিয়াথ বিটল। গোলগাল ভারী শরীরের এই পোকাটি স্কারাবিয়াডি (Scarabaeidae) গোত্রের অন্তর্গত। গোলিয়াথ বিটলের আকার সাধারণত পুরুষ পোকার ক্ষেত্রে ২.৪ ইঞ্চি থেকে ৪.৩ ইঞ্চি এবং স্ত্রী পোকার ক্ষেত্রে ২.০ ইঞ্চি থেকে ৩.১ ইঞ্চির মধ্যে হয়ে থাকে। লার্ভা অবস্থায় এই পোকার ওজন হয় প্রায় ৮০ থেকে ১০০ গ্রামের মতো।
বিশাল আকারের কারণে বাইবেলে বর্ণিত দানবীয় যোদ্ধা গোলিয়াথের নাম অনুসারে এই পোকার নামকরণ করা হয়েছে। অনেকেই এই পোকাকে এর ভারিক্কী দেহের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোকা ভেবে ভুল করেন।
গোলিয়াথ বিটলের দেখা মেলে আফ্রিকার গ্রীষ্মপ্রধান বনগুলোতে। গাছের রস ও বিভিন্ন ফল খেয়ে বেঁচে থাকে এরা। এরা সাধারণত তৃণভোজী। তবে ল্যাবরেটরিতে প্রোটিন সমৃদ্ধ কুকুর ও বিড়ালের খাবার খাইয়েও এদের বড় করার নমুনা রয়েছে। পুরুষ পোকা সাধারণত সাদা-কালো কিংবা বাদামী রঙের হয়ে থাকে। দেখতে ভয়ংকর হলেও এরা খুব শান্ত স্বভাবের। শীতের দিন চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকতেই এরা বেশি পছন্দ করে। তবে ভয় পেলে উড়ে পালিয়ে যায়।
৭. জায়ান্ট ওয়েটা
ঝিঁঝিঁ পোকার মতো দেখতে জায়ান্ট ওয়েটা নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় একটি পোকা। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী পোকার মধ্যে অন্যতম এই জায়ান্ট ওয়েটার ওজন প্রায় ৭০ গ্রামের মতো হয়। এত ভারী হওয়ার কারণে এরা উড়তেও পারে না। পা ও এন্টেনা ছাড়া লম্বায় এরা হয় প্রায় ৪ ইঞ্চির মতো।
মাওরি শব্দ ‘ওয়েটাপুঙ্গা’ থেকে এই পোকার নামকরণ করা হয়েছে। ‘ওয়েটাপুঙ্গা‘ অর্থ ‘কুৎসিত জিনিসের দেবতা’। ভয়ানক চেহারার জন্যই পোকাটিকে দেওয়া হয়েছে এমন নাম।
৬. দানবীয় পানির পোকা
বিশাল আকৃতির দানবীয় পানির পোকাগুলো সাধারণত ‘টো-বাইটার’ বা ‘এলিগেটর টিক’ নামে বেশি পরিচিত। আকারের দিক দিয়ে এরা পৃথিবী অন্য যেকোনো বড় পোকাকে টেক্কা দিতে পারে। লম্বায় প্রায় ৪ ইঞ্চির মতো বড় হয় এরা।
জলের স্রোত ও পুকুরে বাস করা এই পোকাগুলো খুবই ক্ষুধার্ত স্বভাবের হয়। এদের মুখের সামনের দিকে রয়েছে বিশাল আকারের সাঁড়াশি। এই সাঁড়াশি দিয়ে এরা যন্ত্রণাদায়ক কামড় দিতে পারে। এরা শিকার ধরে ধারালো ঠোটের সাহায্যে বিষাক্ত পাচকরস শিকারের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। ফলে কয়েক মিনিট পরই শিকার পরিণত হয় খাদ্যে।
দেখতে বিদঘুটে হলেও থাইল্যান্ডে এই বিশাল পানির পোকাগুলো মজাদার খাদ্য হিসাবে প্রচলিত। বিশেষ ভাবে চাষ করা হয় এদের।
৫. টাইটান বিটল
নানা বিশাল বিশাল পোকার বাসস্থান আমাজনের রেইন ফরেস্টের সবচেয়ে বড় পোকা হলো টাইটান বিটল। এদের বৈজ্ঞানিক নাম টাইটেনাস জাইগানটিয়াস (Titanus giganteus)। আকারে এরা প্রায় ৬.৬ ইঞ্চির কাছাকাছি হয়ে থাকে।
বিশাল আকৃতির এই পোকার রয়েছে বিশাল আকারের একটি চোয়াল বা ম্যান্ডিবল, যা দিয়ে এরা একটা আস্ত পেন্সিলকে দুই ভাগে ভেঙ্গে ফেলতে পারে! রেগে গেলে এরা জোরে হিসহিস করে আওয়াজ করে। এছাড়াও কামড়ে মানুষের মাংসও তুলে নিতে ওস্তাদ এরা।
অবিশ্বাস্য হলেও বিকট চেহারার এই পোকাগুলো আকৃষ্ট করে দুঃসাহসী পর্যটকদের। অনেক পর্যটক এই পোকাগুলো দেখতে আসেন। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বহু পর্যটন সংস্থার লিফলেটে ব্যবহার করা হয় এই পোকার ছবি।
৪. এটলাস মথ
পাখির মতো আকৃতির বিশাল এই মথগুলোকে দেখতে পাওয়া যায় মালয় দ্বীপপুঞ্জে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মথ হিসাবে পরিচিত এরা। এদের আকার এতই বড় হয় যে তাইওয়ানে এদের গুটি টাকার থলি হিসাবে ব্যবহার করা হয়! ভারতের বহু অঞ্চলে রেশমের জন্য চাষ করা হয় এদের।
ডানা গোটানো অবস্থায় এদের আকার হয় প্রায় ৬০ বর্গ ইঞ্চি এবং ডানা মেলা অবস্থায় এদের দৈর্ঘ্য কমপক্ষে এক ফুট পরিমাণ হয়ে থাকে। শুঁয়োপোকা অবস্থায় এরা প্রায় এক ইঞ্চি চওড়া হয়। বলা হয়ে থাকে, গ্রীক পুরানের ‘এটলাসের’ নাম অনুসারে এই পোকার নামকরণ করা হয়েছে। এটলাস ছিল একজন টাইটান। গ্রীক দেবতা জিউসের অভিশাপে এটলাসের দুই কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল গোটা আকাশটাকে। এটলাস মথের বিশাল আকারের কারণের এই নামে ডাকা হয় একে।
৩. হারকিউলিস বিটল
রাইনোসরাস বিটল বা গন্ডারের মতো শিং ওয়ালা পোকাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও সবচেয়ে বড় আকারের পোকা হলো হারকিউলিস বিটল। আকারে ৬.৫ ইঞ্চির বেশি বড় হয় এরা। এদের দেহের অর্ধেক জুড়েই থাকে বিশাল আকৃতির শিং। তবে স্ত্রী পোকার দেহে এই শিং থাকে না।
এদের দেহের মোট ওজনের ৮৫০ গুন বেশি ওজনের জিনিস বহন করতে পারে এরা। এজন্যই গ্রীক বীর হারকিউলিসের নাম অনুসারে এদের এই নামকরণ করা হয়েছে। লার্ভা অবস্থায় এরা পঁচা কাঠ খেয়ে বড় হয়। এরপর প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এরা নানা রকম ফল খেয়ে বেঁচে থাকে।
দেখতে ভয়ঙ্কর হলেও এরা মোটামুটি শান্ত স্বভাবের হয়ে থাকে। রেইনফরেস্টের কিছু আদিবাসী শিশুরা কুকুর বিড়ালের মতো এই পোকাও পুষে থাকে।
২. কুইন আলেকজান্দ্রা’স বার্ডউইং
বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রজাপতি হলো কুইন ‘আলেকজান্দ্রা’স বার্ডউইং’ বা ‘রানী আলেকজান্দ্রার পাখির ডানা’। ডানা মেলা অবস্থায় এদের আকার হয় প্রায় এক ফুটের মতো।
পাপুয়ানিউগিনির প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখা মেলে এদের। এই প্রজাতির সর্বপ্রথম দেখতে পাওয়া প্রজাপতিটিকে পাখি ভেবে শটগানের সাহায্যে মেরে ফেলা হয়। ১৯০৬ সালে সর্বপ্রথম এরা আবিষ্কৃত হলেও ইতিমধ্যে এদেরকে একটি বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে IUCN। স্থানীয় অধিবাসীদের শুরু করা পাম ওয়েল চাষের ফলেই দিন দিন কমে যাচ্ছে এদের সংখ্যা। এছাড়াও প্রজাপতির সংগ্রাহকদের কাছে এই প্রজাতির প্রজাপতি অনেক মূল্যবান। এদের ধরে কালোবাজারে অনেক চড়া দামে বিক্রি করা হয়।
১. জায়ান্ট স্টিক ইনসেক্ট
এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোকা হল ‘জায়ান্ট স্টিক ইনসেক্ট’ বা বিশাল লাঠি আকৃতির পোকা। দেখতে গাছের ডালের মতো উদ্ভট এই পোকাগুলো খুব সহজেই গাছের ডালপালা, পাতার আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে। এরা সাধারণত নিশাচর হয়ে থাকে। দিনের বেলা গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে এরা। আর রাত হলেই বেরিয়ে পড়ে খাদ্যের সন্ধানে।
২০১৬ সালের চীনের দক্ষিণ অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোকা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই পোকাটিকে। ‘ফ্রিগানিস্ট্রিয়া চায়নেনসিস ঝাও’ নামে পরিচিত এই পোকাটির দৈর্ঘ্য ছিল ৬২.৩ সে.মি. (২৪.৬ ইঞ্চি) পশ্চিম চীন জাদুঘরের ‘ঝাও লি’ এর নাম অনুসারে এই পোকাটির নামকরণ করা হয়, যিনি বহু বছর ধরে এই পোকাটির খোঁজ করছিলেন। খুঁজে পাওয়া পর ঝাও এটিকে জাদুঘরে নিয়ে যান। সেখানে এর প্রজনন ঘটানো হয় এবং এটি ৬টি ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বের হওয়া সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটি আকারে ছিলো ২৬ সেন্টিমিটার!
ফিচার ইমেজ – কচকচ করে গাজর চিবিয়ে খাচ্ছে জায়ান্ট ওয়েটা; wired.com