ঈশপের ‘কাক ও কলসি’ গল্পের কথা কে না জানেন! সেই যে তৃষ্ণার্ত কাক, যে কি না কলসির তলানিতে পড়ে থাকা পানি পান করার জন্য বুদ্ধি করে কলসিতে একটির পর একটি নুড়ি পাথর ফেলেছিল। অনেক চেষ্টার পর কাকটি তার কাজে সফল হয়েছিল। গল্পটি পড়ে আমরা কিন্তু কাকের বুদ্ধির খুব প্রশংসা করেছিলাম। গল্পের কাকটি যে বুদ্ধিমান ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সেটি কি নিছক কোনো গল্প ছিল?
হতে পারে সেটি কেবলই একটি গল্প। তবে বাস্তবেও কাক কিন্তু যেনতেন পাখি নয়। সম্প্রতি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ক্রিস্টোফার বার্ডের নেতৃত্বে কাকের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে, যা ঈশপের ‘কাক ও কলসি’ গল্পের নায়ক কাকের বুদ্ধিমত্তার যে বর্ণনা আছে তার সাথে শতভাগ মিলে যায়।
কাক পৃথিবীর সর্বত্র দেখা যায়। আপনি যদি নিতান্তই জগতের মাত্র তিনটি পাখি চিনে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই এর মধ্যে একটি হলো কাক। আমাদের আশেপাশে হরহামেশাই দেখতে পাওয়া এই কাককে আমরা মূলত কুৎসিত ও কর্কশকণ্ঠী পাখি হিসেবেই জানি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, কাককে পাখি জগতের সর্বাপেক্ষা ‘বুদ্ধিমান পাখি’ বলে মনে করা হয়। শুধু তা-ই নয়, প্রাণীজগতের অন্যতম বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে এদের গণ্য করা হয়। কাকের মাথায় এমন এক নিউরন খুঁজে পাওয়া গেছে যা প্রমাণ করে যে, তারা খুব বুদ্ধিমান ও কৌশলী প্রাণী ।
পরিচিতি
উষ্ণমণ্ডলীয় সব মহাদেশে প্রায় ৪০ প্রজাতির কাক দেখা যায়। অধিকাংশ কাকের দেহ বর্ণ কালো রঙের। পক্ষিকুলে এরা ‘করভিড’ পরিবারের সদস্য। এদেরকে দলবদ্ধভাবে থাকতে দেখা যায়। কাক সর্বভূক পাখি। এরা সাধারণত ২০-৩০ বছর বাঁচে। কিছু কিছু উত্তর আমেরিকান কাক প্রায় ৫৯ বছর পর্যন্তও বাঁচে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম ‘Corvus Brachyrhynchos’ । নানা প্রজাতির কাক থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণত পাতি কাক, দাঁড় কাক ও পাহাড়ি কাক দেখতে পাওয়া যায়।
কাকের বুদ্ধিমত্তা
কাক খুবই ধূর্ত প্রাণী। এরা মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বেশ নজরে রাখে, যাতে প্রয়োজনে এরা নিজেদের পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করতে পারে। যখন কাক কোনো বাদাম বা শক্ত কোনো খাবার পায় তখন সেটি রাস্তায় ফেলে রাখে। এক্ষেত্রে তাদের হিসাব একদম নিখুঁত। কাকেরা ট্রাফিক সিগন্যাল মুখস্থ রাখে। সেই অনুযায়ী তারা সঠিক মুহূর্তে উপর থেকে বাদাম বা আখরোটটি ছেড়ে দেয় এবং অপেক্ষায় থাকে কখন একটি গাড়ি এসে পিষে দিবে ঐ শক্ত খোলকটিকে।
শুধু এখানেই শেষ নয়। গাড়ীর তলায় পিষে খাবারটা যখন পড়ে থাকে, তখন কাকেরা একদম তড়িঘড়ি করে না। অপেক্ষা করে ট্রাফিক সিগন্যালের। যখন লাল বাতি জ্বলে ওঠে, তখন লাফিয়ে এসে ঠোঁটে তুলে নেয় খাবারটা। আবার গাছের ফল খাওয়ার জন্য একেবারে সঠিক উচ্চতা থেকে নিচে ফেলে দেয়, যাতে ফলটা ফেটে গিয়ে তার খাওয়ার উপযোগী হয়। এমন বুদ্ধির প্রশংসা না করে উপায় আছে!
তবে, আমরা যতটা ভাবছি তার চেয়েও কাক আর করভিড পরিবারের সদস্যরা অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তারা এমন বোধশক্তি সম্পন্ন, যার সঙ্গে কেবল শিম্পাঞ্জি ও গরিলার তুলনা করা চলে।
নাথান জে এমারি ও নিকোলা এস ক্লেটন নামক দুই গবেষক তখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাণীর আচরণ ও ব্যবহারিক মনোবিজ্ঞান’ বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। ২০০৪ সাল। কাক নিয়ে তাদের গবেষণা উঠে এলো ‘জার্নাল সায়েন্স’ এ, ডিসেম্বর ‘১০ (২০০৪) সংখ্যায়। প্রবন্ধের শিরোনাম-‘The Mentality Of Crows: Convergent evolution Of Intelligence in Corvid and Apes’।
কী বোঝাতে চেয়েছিলেন নাথান এবং ক্লেটন?
কাক এবং বানর বা বনমানুষের মস্তিষ্কের গঠন ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে তারা একই রকম বুদ্ধি খাটায়। কাকের কল্পনাশক্তি হুবহু বানর বা বনমানুষের মতো। সমস্যা উতরে গেলে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার ব্যাপারেও কাক, গরিলা ও শিম্পাঞ্জিদের সমকক্ষ। প্রবন্ধে তারা লিখেছেন,
বুদ্ধির দিক থেকে কাক শুধু পাখিদের পেছনে ফেলেছে এমন নয়। জ্ঞান ও বুদ্ধির দৌড়ে মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাইমেটদের প্রতিদ্বন্দ্বী হলো কাক ও করভিড পরিবারের সদস্যরা।
কাক কৌশল অবলম্বন করে কার্যসিদ্ধি করে
দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে হলে প্রাণীদেরকে অনেক কিছু ‘ভাবতে’ হয়। এজন্যই ডলফিন, শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্ক অন্যান্য প্রাণীর মস্তিষ্কের তুলনায় বড়। নাথান ও ক্লেটনের মতে,
কাকের মস্তিষ্কও বানর বা শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কের মতো বড়।
বানর বা শিম্পাঞ্জি যেমন পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে জটিল হিসেব নিকাশ করে, তেমনি কাকও খুব দুর্দান্তভাবে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে যেকোনো পরিস্থিতিতে। খাদ্য সংগ্রহ করার জন্য কাক দু’ধরনের কৌশল অবলম্বন করে।
প্রথমত, এরা বাঁকানো ডালপালা সংগ্রহ করে। এরপর গাছের গায়ে গর্ত থাকলে ওই ডালপালা দিয়ে খোঁচায়। উদ্দেশ্য, গর্তের ভিতর শুঁয়োপোকা থাকলে তা বের করে আনা এবং খাবার হিসেবে তা গ্রহণ করা।
দ্বিতীয়ত, এরা শক্ত পাতাকে টুকরো টুকরো করে সেগুলো দিয়ে পোকা বা অমেরুদণ্ডী প্রাণী শিকার করে থাকে। এমনকি শিকার ধরতে এরা সোজা কোনো ধাতব তার বাঁকিয়ে হুক বানানোর কৌশলও আয়ত্ত্ব করতে সক্ষম।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো দুজন গবেষক অ্যালেক্স এস ওয়্যার ও জ্যাকি চ্যাপেল কাকের খাদ্য সংগ্রহের কৌশলের উপর গবেষণা চালান। তাদের এই গবেষণা ২০০২ সালের ৯ আগস্ট প্রকাশিত হয় সায়েন্স জার্নালে। মূলত তারা গবেষণা করেছিলেন একজোড়া কাকের উপর, একটি নারী কাক আর একটি পুরুষ কাকের উপর। নারী কাকটির নাম ‘বেটি’ আর পুরুষ কাকটির নাম ‘অ্যাবেল’। ২০০০ সালে ফ্রান্সের নিউ ক্যালেডনিয়ার ইয়েট অঞ্চল থেকে বেটিকে খাঁচাবন্দী করা হয়েছিল। এরপর অক্সফোর্ডের একটি গবেষণাগারে পক্ষীশালার ভেতর বড় একটি ঘরে তাকে রাখা হয়েছিল। সেই ঘরে আগে থেকেই বন্দী ছিল অ্যাবেল। খাঁচাবাসে আগে থেকেই অভ্যস্ত ছিল সে। এর আগে নিউ ক্যালেডনিয়ার একটি চিড়িয়াখানার খাঁচায় ১০ বছর কাটিয়েছে অ্যাবেল।
তাদের উপর পরীক্ষা চালানোর জন্য প্রথমে তাদেরকে খাঁচা থেকে বের করা হয়। একটি ঘরের মধ্যে অ্যাবেল আর বেটিকে রাখা হয়, স্বচ্ছ কাঁচের একটি টিউবের মধ্যে কয়েক টুকরা মাংস রাখা হয়। টিউবের পাশে পড়ে ছিল একটি হুক আর এক হাত লম্বা সোজা একটি তার। দেখা গেল অ্যাবেল হুক দিয়ে টিউবের ভিতর থেকে মাংস তুলে খেলো।
এবার বেটি কিভাবে মাংস তুলে খাবে তা দেখার পালা।
হুকটি সরিয়ে দেয়া হলো। শুধু লম্বা কয়েকটি তার রেখে দেওয়া হলো। এরপর অপেক্ষা। কী দেখলেন ওয়্যার এবং চ্যাপেল? বেটি মোট ১০ বার মাংসের টুকরা সফলভাবে টিউব তুলে গিলতে পেরেছে। প্রতিবারই সে প্রথমে সোজা তার ঢুকিয়ে মাংস তুলতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু একবার মাত্র সফল হয়েছে। সোজা তারে মাংস উঠছে না দেখে বেটি বাধ্য হয়ে তারের এক প্রান্ত পা দিয়ে চেপে রেখে আরেক প্রান্ত ঠোঁট দিয়ে বাঁকিয়ে প্রথমে হুক তৈরি করলো। এরপর সেই হুক দিয়ে টিউবের ভেতর থেকে মাংস তুলে খেলো। এভাবে বেটি এমন এক কৌশল বের করলো যা সে আগে কখনো করেনি।
তার মানে নতুন সমস্যা, নতুন সমাধান!
অ্যালেক্স এস ওয়্যার ও জ্যাকি চ্যাপেল বলেছিলেন,
আমরা এখনও জানি না, ঠিক কখন থেকে বেটি ও বেটির মতো নিউ ক্যালেডনিয়ার কাকেরা এ ধরনের কৌশল রপ্ত করেছে। বিষয়টা খুবই চাঞ্চল্যকর। আমরাও খুব কৌতূহলী। রহস্যটা জানতেই হবে।
বিজ্ঞানে একক চেষ্টার চেয়ে সম্মিলিত এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টার গুরুত্ব অনেক বেশি। যেমনটি দেখা গেছে কাক গবেষণায়ও। ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের পর কাকদের তার ব্যবহারের পরীক্ষা নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা। অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চার মনোবিজ্ঞানী ৭টি কাক নিয়ে সেই পরীক্ষা করেছিলেন। তাদের গবেষণার খবর প্রবন্ধকারে প্রকাশিত হয়েছিল প্রসিডিংস অব দ্য রয়েল সোসাইটি বি-তে, ২০১০ সালের ১৬ এপ্রিল সংখ্যায়।
অকল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা যে ৭টি বন্য কাক গবেষণার জন্য ধরে এনেছিলেন, বেটি ও অ্যাবেলের মতো তাদের ভাগ্যেও একটি করে ডাকনাম জুটেছিল। স্যাম, ক্যাসপার, মায়া, জিন এই চার কাককে একদলে রাখা হয়। অন্য দলে ছিল লাজলো, কোকো ও করবন। এদেরকে রাখা হয়েছিল পক্ষীশালায়, ঠিক যেমনটি রাখা হয়েছিল বেটি ও অ্যাবেল জুটিকে। তবে বেটি ও অ্যাবেলের চেয়ে কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হয়েছিল স্যাম ও কোকোদের। কী রকম?
নাগালের বাইরে রাখা হলো মাংসের টুকরা। একটি বড় লাঠি রাখা হলো যেটা ব্যবহার করলে মাংসের নাগাল পাওয়া যাবে। কিন্তু লাঠিটি রাখা হলো নাগালের বাইরে, একটি বক্সের সঙ্গে এঁটে। সেই লাঠিও চাইলে স্যামরা তাদের নাগালে নিতে পারবে। সেজন্য তাকে দেওয়া হলো আরেকটি ছোট লাঠি। কিন্তু না, সেটাও পেতে বেগ পোহাতে হবে কাকদের। কারণ ছোট লাঠিটা ঝুলন্ত একটি সুতায় বাঁধা।
দেখা গেছে, এ পরীক্ষায় সফলভাবে উতরে গেছে সবগুলো কাক। তবে এজন্য মাথা ঘামাতে হয়েছিলো প্রত্যেককে। তারা ছোট লাঠিটিকে ছুটিয়ে নিয়ে বাক্সের ভিতর থেকে বড় লাঠি বের করে আনে। এরপর তারা বড় লাঠির সাহায্যে মাংস তুলে নেয়। প্রথম চেষ্টাতেই খাবার সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় ক্যাসপার, কিন্তু সুতাটা থেকে লাঠি ছোটাতে তাকে বেশ কষ্ট করতে হয়। কোনো ধরনের ভুল ছাড়াই সফল হয় স্যাম। তবে কোনটার পর কোনটা ব্যবহার করে খাবার কুড়াবে সেই কৌশল ঠিক করতে ১ মিনিট ৫০ সেকেন্ড সময় নেয় সে। এই দলের অন্য দুই সদস্য মায়া ও জিন তৃতীয় এবং চতুর্থ চেষ্টায় সফল হয়।
এমন সমস্যাও ওরা সমাধান করে ফেলল!
বিস্মিত হয়েছিলেন টেইলর, যিনি এই গবেষণাদলেরই একজন। মন্তব্য করেছিলেন,
এটা অবিশ্বাস্য রকম বিস্ময়কর। আমাদের এই পরীক্ষা প্রমাণ করে যে, কাকের বুদ্ধি নিয়ে আমরা যা ভেবেছি তার চেয়ে অধিক উদ্ভাবনী শক্তি আছে ওদের।
জীববিজ্ঞানীরা এদেরকে ‘পাখাওয়ালা প্রাইমেট’ বলেন, কারণ এই পাখিরা ছোটখাট টুলস (যন্ত্রপাতি) তৈরি করতে জানে। এদের উদ্ভাবনী শক্তি আছে, কারণ এরা কৌতূহলী ও সংগ্রামী।
কাক পরিকল্পনা করে কাজ করে
কোনো কাজ করার আগে আমরা যেমন পরিকল্পনা করি, তেমনভাবে কাকও পরিকল্পনা করে থাকে। যেহেতু কাক খুব চতুর এবং সুযোগসন্ধানী, তাই কাকের ‘চোর’ হিসেবে বদনাম আছে। কাক এই বদনাম লুকানোর চেষ্টাও করে না। মজার ব্যাপার হলো, কাক প্রায়ই গর্ত করে খাবার লুকিয়ে রাখে। আরেকদিকে চোখ রাখে, অন্য কাক এই লুকানোর ব্যাপারটি দেখে ফেলল কি না! যখন দেখে অন্য কাক দেখে ফেলেছে, তখন সে গর্তে খাবার লুকানোর ভান করে।
আসলে সে খাবারটি নিয়ে দ্রুতগতিতে উড়ে গিয়ে অন্য কোথাও গর্ত করে রাখে। কিন্তু যে কাকটি এই লুকানোর ঘটনা দেখেছিলো সে-ও আড়াল থেকে কাকটিকে অনুসরণ করে এবং লুকানোর আসল জায়গা দেখে ফেলে। কিন্তু এরা দুজনই জানে এরপর দ্বিতীয় কাকটি গর্ত থেকে খাবার নিলে প্রথম কাকটিও আড়াল থেকে তাকে লক্ষ্য রাখবে। এভাবে তাদের মধ্যে ক্রমাগত চোর-পুলিশের খেলা চলতেই থাকে।
কখন কী খাবার খাবে, কোথায় খাবার পাবে, সে তার সঙ্গীকে খাবার থেকে কতটুকু দিবে এগুলো সে আগেই পরিকল্পনা করে রাখে। কাক সুযোগসন্ধানী প্রাণী। এদের মধ্যে চৌর্যবৃত্তির অভ্যাস আছে এবং অধিকাংশই বেশ পরিকল্পিত চুরির ঘটনা। এমনকি একই দলের অন্যান্য সদস্যরা কোন পরিস্থিতিতে কেমন আচরণ করছে তা দেখে নিজের স্বভাব-চরিত্র ঠিক রাখার পরিকল্পনাও করে এরা। আপনার এলাকার ময়লাওয়ালাদের আসার সময়, ময়লা ফেলার স্থান, তাদের চলাচলের রাস্তা আপনার না-ও জানা থাকতে পারে। কিন্তু কাকেরা সবসময় জানে ময়লা কখন কোনদিক দিয়ে, কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর কাকেরা সেখান থেকে তাদের পছন্দমতো জিনিসগুলো বেছে নেয়।
মস্তিষ্কের স্মৃতিধারণ ক্ষমতা
একটি কাকের দিকে যত সময় নিয়েই তাকিয়ে থাকেন না কেন, পরে অন্য কাক থেকে সেই কাককে আপনি ঠিক আলাদা করতে পারবেন না। তবে সেই কাকটি কিন্তু ঠিকই অন্য মানুষ থেকে আপনাকে আলাদা করে চিনতে পারবে। এটা আন্দাজে বলা কথা না। ওয়াশিংটনের সিয়াটলে গবেষকরা কাকদের পর্যবেক্ষণ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। তারা ৭টি কাককে নিয়ে এই পরীক্ষা চালান। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ৭টি কাক ধরে চিহ্নিত করে ছেড়ে দেন। এ সময় গবেষকরা মুখোশ পরেছিলেন।
পর্যবেক্ষণের বিষয় ছিল, কাকেরা মানুষর মুখ মনে রাখতে পারে কি না। দেখা গেছে, কাক যে শুধু মুখ মনে রাখতে পারে তা নয়, বরং কাক কারো বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুষে রাখতে সক্ষম। তাই কখনো কোনো কাককে ভুলেও আঘাত করবেন না। কারণ বেঁচে থাকলে এরা শত্রুর চেহারা ৫ বছর পর্যন্ত মনে রাখতে পারে! এমনকি দলের অন্য কাকদেরও চিনিয়ে রাখে আঘাতকারীর চেহারা। গবেষকরা যখন মুখোশ পরিহিত অবস্থায় ক্যাম্পাসে বের হয়েছেন, তখন কাকেরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করেছে। কেবল ৭টি কাকই নয়, ক্যাম্পাসের প্রায় সব কাক তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু যে কাকদের গবেষণাগারে আটকানো হয়নি তারা কীভাবে মুখোশ চিনতে পারলো? গবেষকরা ধারণা করেছেন যে, মুখোশের কথা সেই ৭ কাক তাদের বাকি সঙ্গীদের জানিয়েছে।
কাক কেবল কা কা ধ্বনির মাধ্যমে ডাকাডাকিই করে না। একে অন্যের সাথে যোগাযোগও করে থাকে। অবাক করার ব্যাপার হলো, কাকেদের শুধু ভাষাই নয়, আছে অঞ্চলভেদে আলাদা আলাদা উচ্চারণ রুপ। কাকেরা শুধু দৃষ্টিসীমার জিনিসকেই শনাক্ত করতে পারে তা নয়, বরং তারা বিস্তারিতসহ মনে রাখতে পারে। মুখোশগুলোকে চিনে নিয়েছিল ৭টি কাক এবং সেই মুখোশগুলোর বর্ণনা তাদের দলের অন্য কাকদের জানিয়ে দেয়। তাই যেসব কাকেরা মুখোশ দেখতে পায়নি তারা সেই ৭টি কাক থেকে বর্ণনা শুনে মুখোশগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন ছিল। তা তাদের হামলার ব্যাপার থেকেই বোঝা যায়। তাছাড়া কোথায় কোন চারণভূমি আছে তা তারা হুবহু মনে রাখতে পারে।
কাক বিতর্ক
একটি কাক অন্য কাকের সাথে কথা বলে এবং তারা নির্দিষ্ট বস্তুকে আক্রমণ করার ব্যাপারে শলাপরামর্শ করে থাকে। তাদের এই কর্কশ কথোপকথনকে বিজ্ঞানীরা ‘কাক বিতর্ক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।
আল-কুরআন ও তাওরাতে কাকের বুদ্ধি প্রসঙ্গ
পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ) এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিল। তাওরাতের জেনেসিস অধ্যায়ে এসেছে, হাবিল ও কাবিলের মধ্যে কাবিল ছিল হিংসুক প্রকৃতির। হিংসার বশীভূত হয়ে সে তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে। কাবিল হাবিলকে হত্যা করলে আল্লাহ তা’য়ালা একটি কাক প্রেরণ করলেন তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। কাক তাকে দেখিয়ে দেয় কীভাবে দাফন করতে হয়। আল্লাহ তা’য়ালা সূরা মায়েদার ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১ আয়াতগুলোতে এই ঘটনা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন।
আমাদের আশেপাশ দেখতে পাওয়া এই পাখিটির উপর আমাদের বিরক্তির শেষ নেই। তবে যা-ই হোক, কাক যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিচার ইমেজ – voice.gardenbird.co.uk