মৃত্যু; নশ্বর মানবজীবনের অনিবার্য পরিণতি। আমরা যতই একে ভয় পেয়ে পাশ কাটিয়ে চলতে চাই, যতই দিনক্ষণ পিছিয়ে দিতে চাই না কেন, নির্ধারিত সময়মতো মৃত্যু ঠিকই আমাদের জীবনে এসে কড়া নাড়বে। চলে যেতে হবে চেনা পৃথিবী ছেড়ে এমন এক জগতে, যার বিষয়ে জীবিত কারোরই প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আর তাই মৃত্যু ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীকে সবসময়ই ঘিরে থাকে রহস্যময়তা। মানুষের কৌতূহলী, কল্পনাপ্রবণ মনে জন্ম নেয় যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানান রকমের ধারণা, কুসংস্কার আর বিশ্বাস। এরকমই কিছু ধারণার সত্য-মিথ্যা উন্মোচন করা হবে আজকের এই লেখায়।
মৃত্যুর পর কি মানুষের নখ ও চুল বৃদ্ধি পায়?
এটি আসলে একটি ভুল ধারণা। নখের গোড়ায় থাকে একপ্রকার কলা বা টিস্যু, যার নাম জার্মিনাল ম্যাট্রিক্স। গোড়ার দিকের এই কোষগুলো বিভাজনের ফলে নখের নতুন অংশ তৈরি হয় এবং নখের অগ্রভাগ বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে। জীবিতাবস্থায় এভাবেই মানুষের নখের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। মাথার চুলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। প্রতিটি চুলের গোড়া একেকটি ফলিকলের মধ্যে থাকে, আর এই ফলিকলের তলদেশে থাকে হেয়ার ম্যাট্রিক্স, যার কোষগুলো বিভাজিত হয়ে চুলের বৃদ্ধি ঘটায়।
চুল বা নখের এই বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার জন্যে দরকার হয় শক্তির। অক্সিজেনের উপস্থিতিতে গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়ে এই শক্তি উৎপন্ন হয়। কিন্তু মৃত্যুর পর হৃদস্পন্দন থেমে যায় বলে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শরীরের কোষগুলোতে আর অক্সিজেন পৌঁছতে পারে না। সুতরাং মৃত্যুর পর চুল বা নখ বড় হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
তবে অনেক সময় মৃত্যুর পর চুল বা নখ বড় হচ্ছে বলে মনে হয়। এর কারণ হচ্ছে, মৃতদেহের চামড়ার আর্দ্রতা হারানো। এর ফলে নখের চারপাশের চামড়া ভেতরের দিকে গুটিয়ে যায়। ফলে নখের আকার আগের চেয়ে বড় বলে মনে হয়। একইভাবে চেহারা ও মাথার চামড়া খুলির হাড়ের দিকে সরে যাওয়ার কারণে চুলের দৈর্ঘ্যও আগের চেয়ে বেশি বলে মনে হয়।
মৃত্যুর পর কি শরীরের লোম খাড়া হয়?
এর উত্তর হলো, জীবিত অবস্থায় যেভাবে মানুষের শরীরের লোম খাড়া হয়, মৃত্যুর পর আসলে সে ব্যাপারটি ঘটে না। মানুষের শরীরের প্রতিটি লোমের গোড়ায় অ্যারেক্টর পাইলি নামের ছোট একটি পেশী সংযুক্ত থাকে। জীবিতাবস্থায় কোনো ঠাণ্ডা বা আবেগঘন পরিবেশে অবস্থানকালে স্নায়বিক উদ্দীপনা সিম্প্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে এই পেশীর সংকোচন ঘটায়। ফলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সাধারণত ঠাণ্ডা পরিবেশে এবং ভয়, আনন্দ, বা পুরনো কোনো স্মৃতি মনে পড়ার মতো আবেগময় পরিস্থিতিতে মানুষের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যেতে দেখা যায়। কিন্তু মৃত মানুষের তো ঠাণ্ডা অনুভব করা বা আবেগাপ্লুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তাহলে তাদের শরীরের লোম কেন দাঁড়ায়?
বস্তুত এটি মৃতদেহের পচন প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। পচন প্রক্রিয়ার একটি ধাপ হচ্ছে রিগর মর্টিস, যেখানে মৃতদেহের মাংসপেশীগুলো সংকুচিত হয়ে শরীর শক্ত হয়ে যায়। মৃত্যুর চার ঘণ্টা পর এই প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং প্রথমে চেহারা ও পরে শরীরের ছোটছোট মাংসপেশীগুলো সংকুচিত হতে শুরু করে। আর যেহেতু শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া মাংসপেশীর সংকোচনেরই ফলাফল, তাই এই ধাপে মৃতদেহের লোম খাড়া হতে দেখা যায়।
অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যুর পর কি শিশু বেরিয়ে আসে?
এ ধরনের ঘটনার নজির অত্যন্ত বিরল, তবে এটি অসম্ভব নয়। কোনো নারী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে মৃত্যুর ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যে তার দেহে পচন ধরার সময় গর্ভস্থ সন্তান তার জরায়ু থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক জন্মদান প্রক্রিয়ার মতোই শিশুটি মায়ের শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। মায়ের মৃত্যুর সময় গর্ভের শিশুর মাথা জরায়ুর নিচের দিকে (cephalic presentation) থাকলে এটি ঘটার সম্ভাবনা থাকে। জার্মানির চিকিৎসকরা সর্বপ্রথম এরকম ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন এবং এর নাম দেন ‘কফিন বার্থ’। যখন মৃতদেহকে কফিনে শুইয়ে সমাহিত করে ফেলার পরে আইনী প্রক্রিয়া বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনে মৃতদেহ আবার উত্তোলন করা হয়, তখন ঘটনাটি জানা যায়। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বেশ কিছু কফিন বার্থের প্রমাণ পাওয়া যায়।
জীবিত অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের সময় তাদের জরায়ু বারবার সংকোচনের ফলে শিশুটি মায়ের শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। এখানে হরমোনের ভূমিকাও কম নয়। কিন্তু মৃত্যুর পর যেহেতু শরীরের সকল অঙ্গ ও তন্ত্র নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, তাই মৃত মায়ের জরায়ুর সংকোচনের ফলে শিশুর জন্ম হওয়া সম্ভব নয়।
তাহলে কফিন বার্থের ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটছে? আসলে মৃতদেহে যখন পচন শুরু হয়, তখন পাকস্থলী ও অন্ত্রের ভেতরে বাসকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো গ্যাস উৎপন্ন করে। এই গ্যাসের প্রভাবে মৃতদেহ ফুলে ওঠে এবং তার পেটের ভেতরে গ্যাসের চাপ বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে এই চাপ বাড়তে বাড়তে একসময় তা জরায়ুর ওপর চাপ দেয়, ফলে ভেতরে থাকা শিশুটি মৃত মায়ের দেহ থেকে বেরিয়ে আসে। যেহেতু এসব ক্ষেত্রে মা ও শিশু উভয়েই মৃত অবস্থায় থাকে এবং প্রকৃতপক্ষে এটি কোন ‘জন্মদান প্রক্রিয়া’ নয়, বরং পচনক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে শিশুর বের হয়ে আসার ঘটনা মাত্র, তাই এটিকে ‘কফিন বার্থ’ এর বদলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘পোস্টমর্টেম ফিটাল এক্সট্রুশান’ নামে আখ্যায়িত করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের অনুসন্ধানে এমন কিছু কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে পোস্টমর্টেম ফিটাল এক্সট্রুশানের আলামত পাওয়া যায়। তাদের মতে, কেবল পূর্ণবয়স্ক নারীর কঙ্কালের সঙ্গে সদ্যোজাত শিশুর কঙ্কাল পাওয়া গেলেই সেটিকে পোস্টমর্টেম ফিটাল এক্সট্রুশান হিসেবে গণ্য করা যাবে না। বরং এসব ক্ষেত্রে কঙ্কালগুলো আবিষ্কারের সময় নারী ও শিশু কঙ্কালটির পরস্পরের সাপেক্ষে অবস্থান কেমন ছিল, সেটি বিবেচনায় আনা হয়। যেসব নারী কঙ্কালের দু’পায়ের মধ্যবর্তী অংশে, শ্রোণীর হাড়ের কাছেই মাথা নিচের দিকে এবং পা ওপরের দিকে থাকা কোনো সদ্যোজাত শিশুর কঙ্কাল পাওয়া যায়, সেগুলোকে প্রাথমিকভাবে পোস্টমর্টেম ফিটাল এক্সট্রুশান বলে ধরে নেওয়া হয়।
মৃত ব্যক্তির কণ্ঠস্বর কি শোনা যায়?
জীবিত অবস্থার মতো করে একজন মৃতব্যক্তির কণ্ঠ শোনা যাওয়া অসম্ভব, তবে একটি বিশেষ কারণে ঘটনাটি ঘটতে পারে। মৃত একজন মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাওয়া আতংকের ব্যাপারই বটে, যদিও এটি হরহামেশা ঘটে না। মৃতদেহের ফুসফুসের ভেতর যদি বাতাস রয়ে যায়, তাহলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। রিগোর মর্টিসের কারণে যখন মৃত ব্যক্তির দেহের মাংসপেশীগুলো শক্ত এবং অনমনীয় হয়ে পড়ে, তখন তার ভোকাল কর্ড বা স্বরতন্ত্রী নিয়ন্ত্রণকারী মাংসপেশীগুলোও সংকুচিত হয়। যার ফলস্বরূপ মৃতদেহের কণ্ঠে গোঙানি বা আর্তনাদের মত শব্দ শোনা যেতে পারে।
মৃতদেহ থেকে কি রোগজীবাণু বিস্তারের ঝুঁকি থাকে?
মৃত এবং পচনশীল একটি দেহ শুধুমাত্র তাতে প্রাণ না থাকার কারণে বিপজ্জনক বা ক্ষতিকর হয়ে উঠবে, এমন ধারণার পেছনে কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ পাওয়া যায় না। কারণ যেসব ব্যাকটেরিয়া মৃতদেহের পচনকার্যে অংশ নেয়, তারা মানবদেহে কোনো রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। আর যেসব ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস রোগ সৃষ্টি করে, সেগুলো মৃতদেহে বড়জোর কয়েক ঘণ্টাই টিকতে পারে। তাই মৃতদেহ থেকে রোগবালাই ছড়ানোর আশংকা নেই বললেই চলে। তবে এর কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তার দেহে এই ভাইরাসের মাত্রা অনেক বেশি থাকে। তাই এই মৃতদেহগুলোকে নাড়াচাড়া করার পূর্বে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং দ্রুততম সময়ে মৃতদেহ সমাহিত করে ফেলা উচিত।
এছাড়া হিমাগারে সংরক্ষিত মৃতদেহে এইচ আই ভি ভাইরাস ষোল দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। হেপাটাইটিস, যক্ষ্মা ও অন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃতদেহও জীবিতদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এই ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সাধারণ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা এবং স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়মাবলী মেনে চলাই যথেষ্ট।
ফিচার ইমেজ: DNA India