এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত মহাদেশ অস্ট্রেলিয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দ্বীপ মহাদেশ এটি। অস্ট্রেলিয়ার ছয়টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে একটি কুইন্সল্যান্ড। এখানে আছে একটি রেইন ফরেস্ট। রেইন ফরেস্ট বলতে মূলত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার এক ধরনের বুনো জঙ্গলকে বোঝায়, যেখানে থাকে হরেক রকম বন্য পশু-পাখি। একে অনেকে আবার চিরহরিৎ বনও বলে থাকে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই বনে সাধারণত শীতের দেখা মেলে না বললেই চলে।
প্রাকৃতিকভাবে বসবাসের উপযোগী বলে, এই বনে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এবং পশু-পাখি লক্ষ্য করা যায়। সবুজের সমারোহে অসম্ভব সুন্দর এই বন। তবে একটি নির্দিষ্ট গাছের জন্যে এই বনের বেশ কুখ্যাতি রয়েছে। গাছ বলা হলেও, এটি মূলত কোনো গাছ নয়। এটি আসলে এক ধরনের গুল্ম বা ঝাড়। গাছটির মূল নাম ‘ডেনড্রোনাইড মোরোইডস’। তবে অনেকে একে যন্ত্রণাদায়ক গাছ বা আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী গাছ বলে থাকে। স্থানীয়ভাবে গাছটি ‘গিম্পি গিম্পি’ নামেই অধিক পরিচিত।
প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, একবার ঘোড়ায় চড়ে শিকারের খোঁজে এক লোক প্রবেশ করে এই বনে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তেমন কোনো শিকার না পেয়ে খুব বিরক্ত হয়ে পড়ে সে। ধীরে ধীরে বনের অনেক ভেতরে চলে যায়। জঙ্গলের ভেতরে অনেক জায়গাতেই ঝোপ-ঝাড়ে ভর্তি। যতটা সম্ভব সেসব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিল সেই শিকারি। কিন্তু হঠাৎ তার ঘোড়াটি কেমন যেন লাফাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ঘোড়াটির ছটফটানি বাড়তে থাকে। শিকারি তখনও কিছু বুঝতে পারে না। অনেক চেষ্টা করেও ঘোড়াটিকে শান্ত করতে পারে না সে। ঘোড়াটি একসময় এমনভাবে লাফাতে থাকে যে, শিকারি ঘোড়ার পিঠের উপর থেকে পড়ে যায়।
শিকারি অনেকটাই হতভম্ভ হয়ে ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে তার প্রশ্ন, কী এমন হলো যে, হঠাৎ এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল ঘোড়াটি? শিকারি ভাবলো, আশেপাশে হয়তো কোনো হিংস্র জন্তু লুকিয়ে আছে। ফলে সে সতর্ক হয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল। এদিকে ঘোড়াটি এতটাই ছটফট করতে লাগল যে, একসময় দড়ির বাঁধন ছিড়ে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। শিকারি ঘোড়াটির পিছু পিছু কিছুদূর যাওয়ার পর যা দেখল তা নিজের চোখে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। একটু দূরেই, জঙ্গলের এক প্রান্তে ছিল বিশাল এক খাদ। ঘোড়াটি দৌড়ে গিয়ে সরাসরি সেই খাদের উপর লাফিয়ে পড়ল। ব্যাপারটি ঠিক বোধগম্য হয়ে উঠল না শিকারির। সে ভাবলো, হয়তো খাদটি চোখে পড়েনি ঘোড়াটির।
ঘোড়া হারিয়ে শিকারি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে পায়ে হেঁটেই রওনা দিল। কিছুদূর যাওয়ার পর শিকারির পেটে খুব চাপ উঠল। বনের একপাশে প্রাকৃতিক কাজ সেরে একটা গাছের পাতা টিস্যু হিসেবে ব্যবহার করল সে। হায়! তখনও সে জানতো না, কী আসতে চলেছে তার জীবনে। কিছুক্ষণ পর শিকারির শরীরে শুরু হলো তীব্র যন্ত্রণা। যন্ত্রণা কেবল বাড়তেই থাকে। একটা সময় শরীরে ব্যথা এতটাই বেড়ে গেল যে, জঙ্গলের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল সে। একটা সময় শিকারি আর সহ্য করতে না পেরে, শিকারের বন্দুকটি দিয়েই নিজেকে নিজে গুলি করল। স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত এই ঘটনার ঘোড়া আর শিকারি উভয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী একটি গাছ, সেটিই হলো ডেনড্রোনাইড মেরোইডস।
গাছটির পাতাই মূলত বিষের মূল কারণ। পাতাগুলো দেখতে অনেকটা হৃদয়াকৃতির, যা আমাদের দেশের পান পাতার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। পাতাটির চারপাশ ঘিরে থাকে ছোট ছোট হুল বা কাঁটা। ছোট পাতার হুলগুলো সাদা চুলের মতো হয়, যা অনেক সময় খালি চোখে দেখা যায় না। এর সব জারিজুরি কিন্তু এই হুলের মধ্যেই। এ সকল সুঁইয়ের মতো কাঁটা বেশ শক্তিশালী নিউরোটক্সিন ধারণ করে। এই নিউরোটক্সিন হুলের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে অসম্ভব ব্যাথার উদ্রেক ঘটাতে পারে। ব্যথা ধীরে ধীরে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রথমে মাংসপেশীতে এবং পরবর্তীতে অস্থিমজ্জায় ছড়িয়ে যায়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির এমন ব্যথা সহ্য করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এই ব্যথা যেকোনো পশুকে মৃত্যুর দিকেও নিয়ে যেতে পারে। মানুষের ক্ষেত্রে ব্যথার পরিমাণ এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, আক্রান্ত ব্যক্তিটি আত্মহত্যাই একমাত্র মুক্তির উপায় হিসেবে ধরে নেয়। তবে এই ধরনের অনুভূতি একমাত্র চরম পর্যায়ে হয়ে থাকে।
অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও পরিবেশবিদ মারিনা হার্লে অনেক বছর ধরেই অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন গাছের উপর গবেষণা করে আসছেন। তার মতে, গাছটির পাতাগুলো এতটাই সংবেদনশীল যে নিঃশ্বাসের সাথেও যদি কোনো কারণে এর হুল নাকের ভেতর ঢুকে যায়, তবে সর্দি, র্যাশ, এমনকি নাক থেকে রক্ত পর্যন্ত পড়তে পারে। হার্লে এ ধরনের শরীরের যন্ত্রণাকে এসিডদগ্ধ বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বনের প্রচুর পশু-পাখি এই গাছের সংস্পর্শে এসে মারা যায়। তবে বর্তমানে এই বনে মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। তিনি এই গাছ নিয়ে গবেষণার সময় একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন, যার নাম দেন ‘প্ল্যান্ট সিরিজ’।
গবেষণার জন্যে হার্লে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করেছিলেন, যেমন- হাতে দস্তানা এবং মুখে মাস্ক পরে গাছের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বন ফিরে আসার পর হারলে একধরণের যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকেন। ঠাণ্ডা পানিতে বেশ ভালোভাবে শরীর ধুয়ে ফেলার পরেও তার শরীরে হালকা লাল লাল র্যাশ উঠতে থাকে। ফলে তাকে কিছুদিন হাসপাতালে পরিচর্যার জন্যে পাঠানো হয়।
উপযুক্ত পরিবেশে গাছগুলো লম্বায় প্রায় চল্লিশ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে অধিকাংশ গাছই দেড় মিটারের বেশি হতে দেখা যায় না। এই গাছে ফুল হয় এবং ফুল থেকে ফলও হয়। ফলগুলো বেশ ছোট আকৃতির হয়। ফলের রং অনেকটাই গোলাপী ধাঁচের হয়ে থাকে। তবে মজার ব্যাপার হলো, ফলগুলো কিন্তু খাওয়া যায়। ফলগুলো কিছুটা মিষ্টি এবং বেশ রসালো । প্রতিটি ফলে একটি মাত্র বিচি থাকে, এই বিচি থেকেই আবার গাছ হয়।
তবে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিকার যে একেবারেই নেই, তা কিন্তু নয়। প্রয়োজনীয় সতর্কতার সাথে দক্ষ হাতে হুলগুলো শরীর থেকে বের করে আনার চেষ্টা করতে হবে। হুল যাতে ভেঙে না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যদি হুলের কিছু অংশ শরীরে রয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ব্যথা কমার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। হুল যতদিন শরীরে থাকবে, ততদিন ব্যথা হতে থাকবে। এমনকি হুল যদি শুকিয়েও যায়, তবুও ব্যথার প্রকোপ কমবে না।
অস্ট্রেলিয়ান জিওগ্রাফি নামক একটি অনলাইন পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ‘ন্যাচারাল রিসার্চ সেন্টার ইন এনভাইরনমেন্ট টক্সিকোলজি’র গবেষক এলান সি রাইট জানান, অস্ট্রেলিয়া বায়লোজিক্যাল অস্ত্র তৈরিতে এই গাছ ব্যবহার করার জন্য অনেক বছর ধরে গবেষণা করছে। তবে এ গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে জানাতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। অস্ট্রেলিয়ার বাইরে এই গাছের তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্ট্রেলিয়ার অন্য কোথাও এই গাছ চাষের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহও কারো নেই। তাই এই প্রজাতির গাছগুলো ধীরে ধীরে বিপন্ন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ছে।