আপনি কি বারবার হাত ধুতে অভ্যস্ত? একটু ময়লা হাতে লাগলেই কিংবা না লাগলেও জীবাণুর ভয়ে বারবার হাত না ধুয়ে থাকতে পারেন না? যেকোনো কাজ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বার করেন? ঘরের দরজাটা লাগিয়েছেন কিনা বা গ্যাসের চুলাটা বন্ধ করা আছে কিনা বারবার পরীক্ষা করে দেখেন? কোনো কাজই কি আপনার মনমতো হয় না? আরেকটু নিখুঁত বা আরেকটু সুবিন্যস্ত করার চেষ্টায় আপনি বিড়ম্বিত? না চাইলেও বা অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও একই কাজ বারবার করতে করতে আপনি বিরক্ত? যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি OCD তে আক্রান্ত।
OCD বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার ( Obsessive Compulsive Disorder) এক ধরনের মানসিক সমস্যা। বাংলায় একে শুচিবাই বলা হয়ে থাকে। স্বভাবসুলভভাবে মানসিক সমস্যার নাম শুনেই নাক সিটকানোর কিছু নেই। শারীরিক সমস্যাগুলো যেমন শরীরের অংশ, তেমনি মানসিক সমস্যাগুলোও শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাথা থাকলে যেমন ব্যথা হবেই, মস্তিষ্ক থাকলেও তেমনি কোনো না কোনো মানসিক সমস্যা অবধারিত। তাই বলে কোনো জিনিস বারবার পরীক্ষা করে দেখা বা এক কাজ বারবার করলেই OCD আছে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।
OCD আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে কাজ করে দুটি ব্যাপার। অবসেশন (Obsession) ও কম্পালশন (Compulsion)। আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের অবসেশন বা আচ্ছন্নতা কাজ করে। সে বুঝতে পারে না, সে যা করছে তা কেন করছে। শুধু জানে যে তাকে করতে হবে। একটা ঘোরের মধ্যে সে তার কাজকর্ম পরিচালনা করে। আর তার চাইতে বড় বিষয় কম্পালশন বা বাধ্যবাধকতা। কোনো অদৃশ্য শক্তি আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট অনুভূতিতে সাড়া দিতে বাধ্য করতে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেকোনো কাজ ৩, ৬ বা ৯ সংখ্যক বার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত ৩৫ বছরের বেশি ও ২০ বছরের কম বয়সী মানুষদের মাঝে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। তবে জীবনের যেকোনো সময়ই একজন শুচিবাইগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন।
মানব মস্তিষ্কের গঠন বড়ই জটিল। এতে রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন স্নায়ুকোষ বা নিউরন। দেহের কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্যে এসব নিউরনের মিলিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করা অতি জরুরী। নিউরোট্রান্সমিটার নামক রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য এক নিউরন থেকে আরেক নিউরনে প্রবাহিত হওয়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে। এক সময় মনে করা হতো সেরাটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার এর স্তর কমে যাবার কারণে OCD উদ্ভুত হয়। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মস্তিষ্কের যে অংশটি বিচার-বিবেচনা ও বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ করে এবং যে অংশটি শরীরের বিভিন্ন অংশ নড়াচড়া করার নির্দেশ প্রদান করে, তাদের মধ্যে যোগাযোগের সমস্যার কারণে OCD সৃষ্টি হয়।
পারিপার্শ্বিকতাও অনেক সময় OCD তৈরিতে ভূমিকা রাখে। বাল্যকালে শারীরিক বা যৌন লাঞ্ছনার শিকার হলে অনেক সময় পরবর্তীতে মানুষ এই সমস্যায় পতিত হয়। ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণও অনেকের বাল্যকালেই OCD’র বীজ বুনে দেয়। সন্তান জন্মদানের পরবর্তী সময়ে অনেক ক্ষেত্রে মায়ের OCD আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।
OCD আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হয়। সব সময় ভেতর থেকে কিছু নির্দিষ্ট অপ্রয়োজনীয় কাজের তাড়না আসা যথেষ্ট বিড়ম্বনাকর। আক্রান্ত ব্যক্তি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সহজে যোগদান করতে পারে না, মানুষের সাথে মুক্তভাবে সাক্ষাৎ করতে পারে না। মানুষের তাকে ভুল বুঝা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এক সময় সকলের থেকে আলাদা হয়ে OCD আক্রান্ত ব্যক্তি একা ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। একদিকে একাকীত্ব, আরেকদিকে সার্বক্ষণিক শুচিতা-সম্পর্কিত উদ্বিগ্নতা মানসিক স্তর ছাড়িয়ে একসময় ব্যক্তির শারীরিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
OCD নিয়ে অনেকেরই অনেক ভুল ধারণা আছে। বেশিরভাগ মানুষ মনে করে যে আক্রান্ত ব্যক্তি আসলে পরিচ্ছন্নতার প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগী। ব্যাপারটা তা নয়। সাধারণত কোনো আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে মস্তিষ্ক আমাদের সংকেত দিতে থাকে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে। মস্তিষ্কের অঙ্গপরিচালনাকারী অংশটি নির্দিষ্ট অঙ্গ নাড়িয়ে সেই সংকেতকে কাজে রুপান্তরিত করে।
OCD আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক ভুল সংকেত প্রেরণ করতে থাকে। যেখানে বিপদের কিছু নেই, সেখানেও বিপদ সম্পর্কিত সংকেত পাঠাতে থাকে। এক ধরনের ভয় বা খারাপ চিন্তা ব্যক্তিকে গ্রাস করে রাখে। কোনো নির্দিষ্ট কাজ বারবার করতে সে তখন বাধ্য হয়ে পড়ে। কাজটি করলে যে তার ভয়ের কারণ চলে যাবে এমনটি নয়, কিন্তু কাজটি না করলে যেন আরও বেশি তার উপরে চাপ তৈরি হতে থাকে। একটা অদৃশ্য চোরাবালিতে যেনো ব্যক্তি ডুবতে থাকে। যতই চেষ্টা করুক বের হয়ে আসতে পারে না।
OCD সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে মজা করা একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। OCD আর মজা যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু বন্ধু-বান্ধব ও কাছের মানুষদের এমন প্রহসনমূলক আচরণ সমস্যাটি সমাধানের দিকে না নিয়ে গিয়ে বরং আরও বিব্রতকর করে তোলে। অসুস্থ ব্যক্তি যখন চাপের মধ্যে থাকে তখন তার সাহায্য আর সমর্থনের দরকার।
বর্তমানে এই জটিল সমস্যার যথেষ্ট ভালো চিকিৎসার সুযোগ আছে। ওষুধ প্রয়োগ আর মনঃসমীক্ষণ, দুই উপায়েই OCD’র চিকিৎসা সম্ভব। এই সমস্যা জীবনকে পূর্ণরুপে গ্রাস করে ফেলার আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ জরুরী। বিভিন্ন ধরনের মনঃসমীক্ষণ প্রণালী বা সাইকোথেরাপি OCD’র বর্ধিঞ্চুতা থামাতে সমর্থ। এর মধ্যে Cognitive Behavioral Therapy (CBT) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তবে OCD’র বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় লড়াই হলো নিজের লড়াই। মনসম্পর্কিত যেকোনো সমস্যায় সবচেয়ে কার্যকরী হলো মনের সাথে বোঝাপড়া। যে কাজগুলো না করে শরীর থাকতে পারে না, সে কাজগুলোতে নিজেকেই বাধা প্রদান করতে হবে। নিজের যুক্তি দিয়ে লড়তে হবে অযৌক্তিক কর্মোদ্দীপনার সাথে। এভাবেই মস্তিষ্কের যুক্তিভিত্তিক অংশটির কার্যকারিতাও বৃদ্ধি পাবে। পরিবার ও বন্ধুদের করণীয় এসময় সমস্যায় পতিত ব্যক্তির পাশে থাকা, তাকে অনুপ্রেরণা দেওয়া, তাকে যুক্তিভিত্তিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলা।
কোনো অসুস্থতাই ব্যক্তির সাহস ও সুস্থ হয়ে ওঠার বাসনার চেয়ে কখনোই বড় হতে পারে না। বলা হয়, নিজেকে আর নিজের শত্রুকে চেনা থাকলে একটিও না হেরে একশটি যুদ্ধ জেতা যায়। যুদ্ধটা যখন নিজের সাথে, তখন নিশ্চয় এই যুদ্ধে জয় আওতার বাইরে নয়। শরীরের সাথে সমান গুরুত্ব পাক প্রতিটি মানুষের মন। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, সামগ্রিক সুস্থ্যতা প্রত্যেকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করুক।