“একতাই বল”, কিংবা “দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ” – বাক্যগুলো প্রকৃতপক্ষেই কতটা তাৎপর্যপূর্ণ, তা হয়তো আমরা গভীরভাবে ভেবে ভাবার সময় পাই না কিংবা উপলব্ধি করতে পারি না। তবে প্রাণীজগতে বিভিন্ন প্রাণীদের দলবদ্ধভাবে থেকে বা কাজ করে লাভবান হওয়ার কিছু নমুনা আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে এই কথাগুলোর সত্যতা দেখিয়ে দেয়। আজ আমরা এমনই কিছু প্রাণীদের কথা জানবো, যারা বিভিন্ন কারণে ও বিভিন্ন প্রয়োজনে দলবদ্ধভাবে বসবাস করে থাকে।
১. সিংহ
প্রথমের বনের রাজা সিংহের কথায় আসি। যদি আপনি বনে গিয়ে হঠাৎ কোনো সিংহের দেখা পান, তাহলে নিশ্চিত থাকুন, আশেপাশে তার সঙ্গীরা লুকিয়ে আছে। সিংহ অত্যন্ত সামাজিক প্রাণী। তারা সর্বদাই দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। তাদের দলের প্রত্যেক সদস্যের পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিকতাবোধ অবাক করার মতো। একটি অঞ্চলে যত সিংহ থাকে, তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত থাকে। একটি দলের সাথে অন্য দলের স্বভাবতই মধুর সম্পর্ক থাকে না। কেননা, দলগুলো একে অপরের খাদ্যে ভাগ বসাতে পারে এবং এলাকার দখল পর্যন্ত নিয়ে নিতে পারে।
একটি দলে যত সিংহ থাকে, তাদের প্রত্যেকের কাজ ভাগ করা থাকে। এদের কেউ শিকারকে তার ঝাঁক থেকে তাড়িয়ে আলাদা করে আনে, কেউ বা ওঁতপেতে শিকারের উপর হামলে পড়ার অপেক্ষায় থাকে আবার কেউ শিকারকে হত্যা করে। আদতে ‘সিংহ’কে বনের রাজা বলা হলেও দলের ‘সিংহী’রাই বেশী কর্মঠ ও চঞ্চল হয়। তারাই মূলত শিকার করাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে এবং দলের ভেতর শৃঙ্খলা বজায় রাখে।
সিংহদের মূল দায়িত্ব হলো শিকারকে কাবু করতে সহায়তা করা এবং দলকে বাইরের আক্রমণ বা অনুপ্রবেশকারীর হাত থেকে রক্ষা করা। সিংহরা দলবদ্ধভাবে শিকার করে এবং দলের কেউ বাইরের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সবাই মিলে লড়াই করে। একেকটি দলে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ সংখ্যক সদস্য থাকতে পারে।
২. নেকড়ে, হায়েনা, বন্য কুকুর
‘নেকড়ে’ শব্দটা যদি কোথাও শোনেন তাহলে সম্ভবত ‘নেকড়ের পাল’ কথাটাও শুনে থাকবেন। হ্যাঁ, নেকড়েরাও দল বেঁধে বসবাস করে। তাদের দলের গঠন সিংহের তুলনায় খানিকটা ভিন্ন। একটি সিংহ এককভাবে বেশ শক্তিশালী হলেও নেকড়েদের মূল শক্তি তাদের সংখ্যা। একপাল নেকড়ে অত্যন্ত ভয়াবহ শিকারী। নেকড়ের একটি পালে সাধারণত একটি পুরুষ নেকড়ে ও একটি স্ত্রী নেকড়ে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। এদেরকে ‘আলফা’ বলা হয়।
সাধারণত এই ‘আলফা’ স্ত্রী-পুরুষ ও তাদের সন্তানদের নিয়েই নেকড়ের একেকটি পাল গঠিত হয়। তাই একপাল নেকড়ের পারস্পরিক বন্ধন হয় অত্যন্ত মজবুত। ‘আলফা’ যেকোনো প্রকার বিপদ-আপদ থেকে তার পালকে আগলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে। নেকড়েরা নিজের এলাকা রক্ষায় কোনো প্রকার ছাড় দিতে প্রস্তুত না। এরা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দেবে, তবুও নিজের এলাকায় শত্রুর অবস্থান মেনে নেবে না। গড়পড়তা একটি পালে কয়েকটি থেকে শুরু করে ৩০ বা ৪০টি পর্যন্ত নেকড়ে থাকতে পারে এবং এদের এলাকা ৪০ বর্গকিলোমিটার বা তারও বেশি অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত থাকতে পারে।
এককভাবে একটি নেকড়ে সিংহর মতো এত শক্তিশালী নয় বলে, শিকার করার ক্ষেত্রে তাদেরকে বাধ্য হয়েই ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। এরা শক্তি বাঁচানোর জন্য একঝাঁক শিকারকে পর্যবেক্ষণ করার পর তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল সদস্যকে শনাক্ত করে এবং সেটিকেই আক্রমণ করে। সিংহের মতো শক্তিশালী না হলেও এরা ভয়ানক রকমের ক্ষিপ্র।
স্বভাবগত ভাবে হায়েনা ও আফ্রিকান বন্য কুকুরদের চালচলনও কিছুটা নেকড়েদের মতোই, তবে বেশ কিছু পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। হায়েনারা সাধারণত অন্যের শিকার চুরি করায় অভ্যস্ত। কিন্তু যখন দলবদ্ধভাবে শিকার করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখন হায়েনারা অত্যন্ত হিংস্র হয়ে উঠে, তারা শিকার ধরার পর জীবন্ত অবস্থাতেই শিকারকে ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করে। তবে হায়েনারা বুদ্ধিমান। এরা পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। আর বন্য কুকুররা আকারে অনেকটা ছোট হলেও দলবদ্ধভাবে বেশ কার্যকরী শিকারী; যদিও তাদের শিকার ধরার পদ্ধতিটা অনেকটা এলোমেলো ও অগোছালো।
এই তিন শ্রেণীর শিকারীরা সিংহদের মতো এতটা সুশৃঙ্খল্ভাবে শিকার ধরতে পটু না। তবে এরা মূলত ক্ষিপ্রতা ও সংখ্যাধিক্যের কারণে শিকারকে সহজেই চারদিক থেকে ঘিরে ও আঁকড়ে ধরে ফেলে। দক্ষতার ক্রমে নেকড়ে সবার উপরে থাকবে, তারপর হায়েনা এবং স্বভাবতই বন্য কুকুর সবার শেষে।
৩. ডলফিন, ওরকা, ফলস কিলার হোয়েল
সামুদ্রিক এ প্রজাতিগুলো দল বেঁধে চলাচল করে। মানুষের পরই ডলফিনকে অন্যতম সেরা বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডলফিনরা তাদের কাজকর্মে এর প্রমাণ দিয়ে থাকে। এর একটি নিদর্শন তাদের মাছ শিকারের ধরন দেখলে বোঝা যায়। ডলফিনের একটি গ্রুপ অত্যন্ত সুচারুভাবে পরিকল্পনা করে একত্রে মাছ শিকার করতে নামে।
গভীর পানিতে এদের দলের দুয়েকটি ডলফিন আলাদা হয়ে একটি মাছের ঝাঁককে তাড়িয়ে একটি নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে আসে। কিন্তু সেই দিকটাতে আগে থেকেই দলের অন্য ডলফিনরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করে দেয়ালের মতো বাধা সৃষ্টি করে রাখে। ফলে মাছের ঝাঁকটি উপায় না দেখে পানির উপর লাফিয়ে উঠে অন্যদিকে সরে যেতে চায়। আর এটাই ডলফিনদের চাওয়া। কারণ তারা শূন্য থেকে মাছ বা অন্য কোনো খাদ্য লুফে নিতে খুবই পারদর্শী।
এমনকি অগভীর পানিতেও, যেখানে মাছ থাকে, সেখানে এরা প্রথম পানিকে ঘোলা করে ফেলে। তারপর সেই ঘোলা পানিকে কয়েকটি ডলফিন ঘিরে ধরলে মাঝখান থেকে কিছু সংখ্যক ডলফিন লেজ ঝাঁপটে মাছদেরকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। আর সে উদভ্রান্ত মাছেরা পানির উপর লাফিয়ে উঠলেই ডলফিনদের ভূরিভোজন শুরু হয়ে যায়। এদের গড়পড়তা একটি দলে ১০-৩০ সদস্য থাকতে পারে। তবে ডলফিনদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এদের কয়েকটি গ্রুপ প্রয়োজনের তাগিদে সহজেই একীভূত হয়ে যেতে পারে। ফলে বৃহত্তর দলটির সদস্য সংখ্যা হাজারে গিয়েও ঠেকতে পারে।
ডলফিনদের মতো ওরকা এবং ফলস কিলার হোয়েলরাও বুদ্ধিমান। ক্ষেত্রবিশেষে ফলস কিনার হোয়েলরা ডলফিনদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে ও শিকার করে থাকে। এতে উভয়েই লাভবান হয়। আর ওরকা বা কিলার হোয়েলরা সুবিধাজনক শিকারকে হাতের নাগালে পেলে তাদের দলের কনিষ্ঠ সদস্যদেরকে শিকার করার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, যেন তারাও শিকারী হয়ে উঠতে পারে।
৪. হাতি
হাতির বুদ্ধিমত্তা প্রশংসনীয় পর্যায়ের। মানুষের পরই যেসব প্রাণী সবচেয়ে বেশি সামাজিক ও ঐক্যবদ্ধ বলে অনুধাবন করা যায়, তার মধ্যে হাতির অবস্থান সবার উপরে। হাতিদের সমাজের অদ্ভুত কিছু নিয়ম রয়েছে। যেমন হাতিদের সমাজ স্ত্রী-শাসিত। হাতিদের একটি পালে পুরুষ হাতিরা একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত অবস্থান করতে পারে। এরপর তাদের দল ছেড়ে চলে গিয়ে একলা বসবাস করতে হয়।
তবে যেহেতু তারা সামাজিক, কিছু পুরুষ হাতি একা না থেকে অন্য কয়েকটি দলহারা পুরুষ হাতির সাথে মিশে একটি পৃথক দল তৈরী করে এবং একসাথে চলাফেরা করে। হাতির একটি দলে ৫-১৫ বা তার চেয়েও বেশি সদস্য থাকতে পারে। হাতির স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর বলে জানা যায়। বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি হাতি কোনো একজন মানুষের চেহারা বহু বছর মনে রাখে এবং সে অনুসারে আচরণ করতে পারে।
৫. কাক
কাক অত্যন্ত বুদ্ধিমান একটি প্রাণী। কিছু সংখ্যক কাক নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করলেও বেশিরভাগ কাকই বিশাল দল গঠন করে থাকে। কাকদের বহু বিশেষত্বের মধ্যে একটি হলো এরা কখনো মানুষের চেহারা ভোলে না। আপনি যদি কখনো একটি কাককে ধাওয়া করে থাকেন, কিংবা খাবার দিয়ে সাহায্য করে থাকেন, কাকটি সারাজীবন আপনার চেহারা মনে রাখবে।
শুধু তাই নয়, সে আপনার সম্পর্কে তার দলের অন্যান্য কাকদেরকেও জানিয়ে দেবে এবং অন্যান্য কাকেরাও আপনার সাথে সেই অনুযায়ী আচরণ করবে। যখন একটি দলের কোনো কাক মারা যায়, সকল কাকে সেই এলাকা ঘিরে রাখে। গবেষকরা অনুমান করেন, কাকগুলো তখন খুঁজতে থাকে, কে তাদের সঙ্গীকে হত্যা করলো। যদি হত্যাকারীকে পাওয়া যায়, তাহলে সকল কাকেরা মিলে সেটিকে ধাওয়া করে।
৬. মাছেদের ঝাঁক
ব্লু স্ট্রিপ স্ন্যাপার, ব্যারাকুডা, সার্জন ফিশ, স্কাডফিশ ও হেরিং সহ কয়েক প্রজাতির মাছ বিশাল বড় ঝাঁক গঠন করে চলে। এতে তারা কিছুটা সুবিধা পায়। এদের ঝাঁক শিকার করার জন্য নয় বরং শিকারীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গঠিত। যদিও শিকারীরা কিছু কৌশল অবলম্বল করে এদেরকে শিকার করে ফেলতে পারে। তবুও ঝাঁক বেঁধে চলার ফলে সামগ্রিকভাবে তারা খাদ্য অনুসন্ধান, প্রজনন ও শিকারীকে বিভ্রান্ত করার ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পায়। এজন্য ঝাঁকের প্রতিটা সদস্যের গতিবিধির সাথে তাদের তাল মিলিয়ে চলতে হয়। একটি ঝাঁকে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ পর্যন্ত মাছ থাকতে পারে।
৭. জলহস্তী
জলহস্তীরা দল বেঁধে লেক, ছোট নদীর ধারে বা কোনো আবদ্ধ জলাশয়ে বসবাস করে। এরা সাধারণত তৃণভোজী প্রাণী, তবে ভয়ানক আক্রমণাত্মক। নিজের এলাকায় এরা অন্য কাউকে সহ্য করে না। অনাকাঙ্খিত কোনো অনুপ্রবেশকারী এলে এরা দল বেঁধে এদের ভয়াবহ দাঁতগুলোর ক্ষমতা টের পাইয়ে দেয়। চোয়াল ও দাঁতের গঠনগত কারণে এরা প্রতিপক্ষকে আক্ষরিক অর্থেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে পারে।
৮. পঙ্গপাল
পঙ্গপালের কথা শুনেছেন নিশ্চয়ই। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রজাতি, যেটি মরু অঞ্চলের আশেপাশে বেশি দেখা যায়, সেটির বৈজ্ঞানিক নাম Schistocerca gregaria। তবে অনেকেই জানেন না, পঙ্গপাল বলতে যে পোকাটির ঝাঁক বোঝানো হয়, সেটি এক প্রকার ঘাসফড়িং ছাড়া আর কিছুই না! তবে এ জাতের ঘাসফড়িংগুলো সাধারণত একাকী জীবনযাপন করে অভ্যস্ত। তবে পরিস্থিতি যখন প্রতিকূলে থাকে, বিশেষ করে যখন খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, তখন এই একাকী ঘাসফড়িংগুলো খাদ্যের খোঁজ করতে গিয়ে পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে।
আর তখনই অত্যন্ত আশ্চর্যজনক এক ঘটনা ঘটে। ঘাসফড়িংগুলো তখন দেহের গড়ন, রঙ, অভ্যাস ও চালচলন অনেকটাই বদলে যায়। তারা তখন ক্ষিপ্র ও আগ্রাসী হয়ে উঠে। সূচকীয় হারে বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা। পঙ্গপালের বড়সড় একটি ঝাঁক বেশ কয়েকশো বর্গ কিলোমিটার এলাকার আকাশ-বাতাস পুরোপুরি ছেয়ে ফেলতে পারে। আর এরকম একেকটা ঝাঁকে তাদের সংখ্যা সর্বোচ্চ কয়েক বিলিয়ন পর্যন্ত হতে পারে!
এই পঙ্গপাল তার যাত্রাপথে খাবার উপযোগী যা পায়, তাই খেয়ে ফেলে; এমনকি কখনো কখনো কাঠ পর্যন্ত! মাইলের পর মাইল জুড়ে খাদ্য-শস্যের ফসলী জমি উজাড় করে ফেলতে পারে এরা। ফলস্বরূপ দেখা দিতে পারে দুর্ভিক্ষ। তবে আফ্রিকার কিছু দেশসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলের মানুষ পঙ্গপালকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।
প্রাণীরা সাধারণত খাবারের স্বাদ মনে রাখতে পারে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, ঘাসফড়িংগুলো রূপান্তরিত পঙ্গপালে রূপান্তরিত হওয়ার পর এদের মস্তিষ্ক খাবারের স্বাদ খুব একটা মনে রাখতে পারে না। অর্থাৎ, কোনো খাবারের প্রতিই তাদের সহজে বিতৃষ্ণা জন্মায় না। এরা রূপান্তরিত হয় ক্ষুদে রাক্ষুসে প্রাণীতে! কোনো একটি বিশেষ প্রাণী, তা আকারে যত ছোটই হোক, দলবদ্ধভাবে কী করতে পারে- তার নিদর্শন এই পঙ্গপাল।
৯. পিরানহা
পিরানহার যেসব প্রজাতিগুলো রাক্ষুসে, তাদেরকে হাঙরের মতোই ভয় করে চলা উচিত। একটি পিরানহা আকারে খুব বেশি বড় না হলেও এক ঝাঁক পিরানহা রীতিমতো তান্ডব ঘটাতে পারে! যেকোনো বড় শিকারকেও সম্মিলিতভাবে তারা মুহূর্তের মাঝেই খাবারে পরিণত করতে পারে। এদের ভয়ানক ও ধারালো দাঁতের আক্রমণে শিকারের দেহের কোনো অংশই সম্ভবত আস্ত থাকবে না।
১০. বুনো মহিষ
বুনো মহিষেরা বিশাল বড় দল বেঁধে চলে। এরা শিকারী নয়, কিন্তু বন্য পরিবেশে এরা মাংসাশী শিকারীদের, বিশেষ করে সিংহের শিকারে পরিণত হয়ে থাকে। তবে বুনো মহিষেরা বেশ সবল প্রাণী এবং একতা এদের শক্তি। এককভাবে একটি সিংহ সাধারণত একটি প্রাপ্তবয়স্ক বুনো মহিষকে শিকার করার সাহস করে না। যদিও বা দল বেঁধে একটি বুনো মহিষ শিকার করার চেষ্টা করে, তাহলে সিংহদের প্রধান চ্যালেঞ্জ থাকে কোনোভাবে বুনো মহিষটাকে তার পাল থেকে বের করে আনা। কেননা, যতক্ষণ মহিষটি তার পালের সাথে থাকে, তখন সেটাকে ধরতে যাওয়ার মানেই আত্মঘাতী অভিযানে যাওয়া। আবার, এমন নিদর্শনও আছে যে, শিকারীরা একটি বুনো মহিষকে প্রায় কাবু করে ফেলার পরও তার পালের সঙ্গীরা জোট বেঁধে তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে আনে।
১১. মৌমাছি
“মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি,
দাঁড়াও না একবার ভাই।
ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে,
দাঁড়াবার সময় তো নাই।”
নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘কাজের লোক’ কবিতাটি শৈশবে আমরা সকলেই পড়েছি। কবিতার উপরিউক্ত লাইনগুলো মোটেই অতিরঞ্জন নয়। মৌমাছিরা সত্যিই প্রকৃতিতে দলবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করা ও একতার অনন্য এক নিদর্শন। এরা অত্যন্ত পরিশ্রমীই বটে। আকারে ছোট হলেও এরা অত্যন্ত স্মার্ট প্রাণী। মৌমাছিরা কলোনিতে বসবাস করে, এবং সে কলোনিটি স্বভাবতই একটি মৌচাক। কলোনির প্রতিটি মৌমাছির কাজ ভাগ করা থাকে। এরা মৌচাক গঠন, খাদ্য অনুসন্ধান ও মৌচাকের সুরক্ষায় একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে।
এদের জোট বেঁধে কাজ করার একটি সুন্দর নিদর্শন হলো, বোলতা বা ভীমরুলকে প্রতিহত করা। প্রাকৃতিকভাবে ভীমরুলদের সাথে মৌমাছিদের শত্রুতার সম্পর্ক রয়েছে। কারণ ভীমরুল মৌমাছিদের হত্যা করে। একপ্রকার জাপানী বৃহদাকার ভীমরুল রয়েছে, মৌমাছিদের জন্য এরা এক প্রকার যম। এরকম কিছু সংখ্যক ভীমরুল মিলে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৌমাছিদের গোটা একটা কলোনিকে লাশের স্তুপে পরিণত করতে পারে।
কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে বাঁচার জন্য মৌমাছিরা সুন্দর একটি উপায় অবলম্বন করে। যদি ভীমরুলের সংখ্যা খুব কম হয়, তাহলে গোটা কলোনির মৌমাছিরা মিলে একেকটি ভীমরুলকে নিশ্ছিদ্রভাবে ঘিরে ধরে। কিন্তু এরা ভীমরুলটিকে কামড়ায় না, বরং আবদ্ধ করে সে আবদ্ধ অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়; মৌমাছিরা ক্ষেত্রবিশেষে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এভাবে তাপমাত্রা বাড়িয়ে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় তারা, যাতে ভীমরুলটি আর সহ্য করতে না পেরে মারা যায়। এভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রায়শই তারা কলোনিকে রক্ষা করে থাকে।
১২. গরিলা, ওরাং-ওটান, শিম্পাঞ্জি
এ তিন প্রজাতির প্রাণীদের জীবনযাপনের ধরন খুব কাছাকাছি প্রকারের। এদের মধ্যে শিম্পাঞ্জি জিনগতভাবে মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রজাতি। এরা সবাই মানুষের মতোই সামাজিক প্রাণী। আবার, মানুষের ন্যায় এদের সমাজেও রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন, যা প্রত্যেক সদস্যকে মেনে চলতে হয়। তা নাহলে সংঘাত অবধারিত।
শিম্পঞ্জিরা সাধারণত মাংসাশী না হলেও কখনো কখনো এদেরকে বানর শিকার করে খেতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে তারা দল বেঁধে বানরের দলের উপর হামলে পড়ে। অপরদিকে গরিলা আর ওরাং-ওটান মাংসাশী নয়। এরা গাছের বিভিন্ন অংশ খেয়ে বাঁচে। ওরাং-ওটানরা নিজেদের এলাকার ফল গাছগুলো দখলে রাখার চেষ্টা করে এবং সেগুলোর দখল বজায় রাখার জন্য দলবেঁধে অপর কোনো গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে।
১৩. মিয়ারক্যাট
মিয়ারক্যাট হলো বেজি গোত্রের এক ধরনের প্রাণী এবং এরা দলবেঁধে চলে। বেজিদের সাথে এদের বেশ সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এরা মূলত মাংসাশী; খাদ্যের জন্য ছোটখাটো গিরগিটির মতো শিকার ধরে খেয়ে থাকে। তবে মাঝে মধ্যে অনাকাঙ্খিত কিছু শত্রু যেমন সাপের মুখোমুখি হতে হয় এদেরকে। তখন এদের দলের সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের একটি মজার বৈশিষ্ট্য হলো, এরা শিকার করতে যাক, শত্রুর মোকাবেলা করতে যাক বা যেকোনো ধরনের কাজ করতে যাক, এদের দলের দুয়েকজন সদস্য সর্বদাই পুরো গ্রুপটাকে পাহারা দেবে এবং আশেপাশের কোথাও থেকে শত্রুর আগমন ঘটছে কিনা তা খেয়াল রাখবে। একটি গ্রুপের মিয়ারক্যাটেরা সেই গ্রুপটির ছোট সদস্যদের প্রতি খুবই যত্নবান হয়ে থাকে এবং সর্বদা বাচ্চাদেরকে নজরে রাখে।
১৪. পিঁপড়া
দলবদ্ধ প্রাণী হিসেবে পিঁপড়াদের কথা বলাই বাহুল্য। এদের জীবনযাত্রার ধরনের সাথে মৌমাছিদের জীবনযাত্রার কিছুটা মিল রয়েছে। তবে মৌমাছিদের মতো এরা শুধু ফুলের মধুর উপর নির্ভরশীল নয়, পিঁপড়ারা প্রায় সকল ধরনের খাবারই সংগ্রহ করে থাকে। হ্যাঁ, এরা খাওয়ার চেয়ে সংগ্রহ করার দিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। এদের জীবনযাপন সম্পর্কে গভীরভাবে জানলে মনে হবে, শুধুমাত্র খাদ্যের গুদাম গড়ে তোলার জন্যই বুঝি পৃথিবীর বুকে এই প্রাণীগুলোর উদ্ভব হয়েছে!
এরা সাধারণত ঢিবি গঠন করে থাকে এবং একেকটা ঢিবিতে এমনকি মিলিয়ন সংখ্যক পর্যন্ত পিঁপড়াও থাকতে পারে! এরা বিভিন্ন দলে ভাগ করা থাকে এবং একেকটি দলের কাজ ভিন্ন হয়। সংখ্যায় শ্রমিক পিঁপড়ার সংখ্যাই বেশি হয়। এত এত সংখ্যক পিঁপড়ার একটি ঢিবির ভিতরে ও বাইরে সাধারণত কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা যায় না; অত্যন্ত সুচারু ও সুশৃঙ্খল্ভাবে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ কাজ করে যায়। এমনকি কাজ করতে বেরিয়ে পথিমধ্যে অনাকাঙ্খিত কোনো সমস্যা দেখা দিলে সবাই জোটবদ্ধভাবে সেটা সমাধান করার প্রবণতাও পিঁপড়াদের মাঝে রয়েছে।
১৫. পেঙ্গুইন
পেঙ্গুইনদের দেখা সাধারণত এন্টার্কটিকাতেই পাওয়া যায়। তবে মেরুর শীতল আবহাওয়াতে জীবনটা একটু কঠিনই বলা চলে। তবে পেঙ্গুইনরা দলবদ্ধভাবে থেকে বিপদ-আপদ মোকাবেলা করার চেষ্টা করে থাকে। এরা সাধারণত ঝাঁক বেঁধে চলে এবং একসাথে শিকার করে থাকে। শীতল পরিবেশে বসবাসের জন্য এদের দেহ বিশেষ উপযোগী হলেও, তাপমাত্রা যখন হিমাংকের খুব বেশি নিচে নেমে যায়, তখন তাদের জন্য, বিশেষ করে বাচ্চা পেঙ্গুইনদের বেঁচে থাকাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠে।
এমতাবস্থায় পেঙ্গুইনের একটি বিশাল ঝাঁক খুব কাছাকাছি এসে পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকে তাপমাত্রা রক্ষা করার চেষ্টা করে। এদের কেন্দ্রে অবস্থান করে শিশুসহ মা পেঙ্গুইনগুলো, যেন বাইরের তুষার ঝড় বা ঠান্ডা বাতাস তাদেরকে সহজে স্পর্শ করতে না পারে। তারা শুধু দাঁড়িয়েই থাকে না, বরং একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে পুরো দলের প্রত্যেকটি পেঙ্গুইন একটি নির্দিষ্ট তালে শরীর খানিকটা নাচাতে থাকে। এরকম নড়াচড়ার ফলে তাদের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং দেহ তাপ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ এভাবে তারা বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের মধ্যে উষ্ণতা বিনিময় করছে।
১৬. পরিযায়ী পাখি
মাঝেমধ্যে খেয়াল করে থাকবেন, একঝাঁক পাখি আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময় ইংরেজী ‘ভি’ চিহ্নের মতো আকৃতি গঠন করে উড়ে চলছে। বিজ্ঞানীরা এর কারণ বোঝার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এখন পর্যন্ত করা গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে, ঝাঁকে থাকা পেছনের দিকে পাখিরা ওড়ার ক্ষেত্রে সামান্য কিছুটা হলেও যান্ত্রিক সুবিধা পেয়ে থাকে।
এমন একটি ঝাঁকের সামনে থাকে দলটির দলনেতা। অবশ্য মাঝেমধ্যে দেখা যায়, দলনেতা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তার দায়িত্ব নিয়ে নেয় দলের অন্য আরেকটি পাখি। এভাবে তারা দায়িত্ব ভাগাভাগি করে বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিযায়ী পাখি, যারা ঋতু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য স্থান পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে লম্বা ভ্রমণ করে থাকে, তাদের ক্ষেত্রেই এই ‘ভি’ আকারে গঠন করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
বিভিন্ন প্রাণীর দলবদ্ধ আচরণ ও কর্মকান্ড আমাদেরকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাবতে শেখায়। প্রকৃতিতে ঐক্যবদ্ধতার এমন আরও অনেক নিদর্শন রয়েছে, যেগুলো সচরাচর আমাদের চোখে পড়ে না, কিংবা যেগুলোর দেখা মেলা ভার। তবে, একটু চেষ্টা করলেই প্রকৃতির আরও খানিকটা গহীনে এদের খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। সেসব প্রাণীদের নিয়ে গল্প নাহয় আরেকদিন করা যাবে।