
জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগে আমরা যতই পণ্ডিত হই না কেন, অবাক করা এই বিস্ময়কর পৃথিবীর অজানা জট খুলতে খুলতেই কিন্তু আমাদের জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়। সত্যিই এ ধরণী বড়ই অদ্ভুত। অদ্ভুত চারপাশের প্রকৃতি, যার ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানো আর তার সৃষ্টির খেলা হয়তবা আমরা অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক বেশি বেশি জানতে পারব। এমনও হতে পারে যে তার মাঝেই এমন অনেক কিছু থেকে যাবে অজানা রহস্যের বেড়াজালে।
জালের কথা এসেছে যখন, আসুন জেনে আসি প্রকৃতির এক বিস্ময়কর জীবের তৈরি জালের শক্তি সম্পর্কে। এ নিয়ে কত শত অজানা তথ্যে আরও অবাক হতে ক্ষতি কী বলুন?

ইস্পাতের চেয়েও শক্ত পোক্ত মাকড়শার তৈরি এই জাল; Image Source: animalia-life.club
প্রকৃতির খুঁটিনাটি বের করা বিজ্ঞানের কাজ, আর বিজ্ঞানকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করে প্রকৌশলবিদ্যা। আমার মতো উৎসুক মনের অধিকারী যারা, তারা নিশ্চয়ই প্রকৌশল বিদ্যার দ্বারস্থ না হয়ে টোকা দিয়ে বসেন অবাক করার মতো বস্তুর উপরেই। সে যাই হোক। মানবসৃষ্ট জাল সম্পর্কে বেশি কিছু বলার মতো নেই। আমার দৃষ্টি আরেকটি প্রাণীর সৃষ্ট জালের উপরেই। কী? বুঝতে পারছেন নি এখনো? আমি মাকড়শার জালের কথাই বলছি।

মাকড়শার অদ্ভুতুড়ে জাল; Image Courtesy: Bruce Block/Getty Image
কোনো এক অজানা কারণে আমি মাকড়শার উপর চরম ক্ষ্যাপা। কারণ হলো, এটা আমাকে প্রচন্ড ভয় দেখায়। আসলে এটা ভয় দেখায় না, আমি নিজ থেকেই মাকড়শা ফোবিয়াগ্রস্থ। জানি না, হয়তো আমার মতো এমনটা আরও অনেকেই থাকতে পারেন। কেমন কিলবিল করা আটখানা পা! যতই সেটা আকারে ছোট হোক না কেন, ভয়টা যেন কোথা থেকেই উদয় হয় একে দেখেই।
অনেক ছোট্ট বেলায় কোনো এক বিকেলে, দাদুবাড়ির উঠোনে হঠাৎ করেই খেলার সাথী চিৎকার জুড়ে দিলো যে, আমার ঘাড়ে নাকি বড়ই গাছের ডগা থেকে ইয়া বড় এক মাকড়শা এসে বসেছে। সত্যিই কিন্তু বসেছিল। তারপর তো আমার ভয়ে প্রাণান্তকর অবস্থা! যেই শুনেছি আট পাওয়ালা সেই প্রাণীটি আমার ঘাড়ে, আমার তো তখন নড়াচড়া বন্ধ। বাকিটা ইতিহাস। কেবল ভয়ে আধমরা হওয়ার স্মৃতিটুকুনই স্মরণ আছে। তারপর কী হয়েছিল তা আর মনে নেই।

জাল বুননের কারিগর মাকড়শা; Image Source: animalia-life.club
এই ভয় থেকেই হয়তো উৎসুক মন মাকড়শা ও তার জাল নিয়ে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে দিয়েছে। আজ আপনাদের সাথে তেমন সব তথ্যই শেয়ার করবো।
আপনি কি জানেন, মাকড়শার জাল ইস্পাতের তারের চেয়েও বেশি শক্ত হয়ে থাকে। জলের উপর যারা স্কেটিং করে থাকেন তাদের মাঝে স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় যে, এক স্কেটার আরেক স্কেটারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাদের গতি বাড়িয়ে-কমিয়ে চলতে থাকেন। যারা বিশেষ পটু তারা আবার জলের উপরেই অনেক কারসাজিও করে দেখান বটে। মাকড়শারাও কিন্তু ঠিক ঐ রকম কাজটাই করে থাকে। তারা টোকা দেয়, এমনকি ঢেউ তোলে জালের সুতোয়। জাল সে যেখানেই তৈরি করুক না কেন, আসল উদ্দেশ্য তার শিকার আক্রমণ। ঘাস ফড়িং, প্রজাপতি ইত্যাদি পতঙ্গ মাকড়শার প্রধান শিকার।

দুরন্ত উচ্চিংড়ে; Image Source: lawncareofcumming.com
আশেপাশে কোনো মাকড়শার জাল খেয়াল করলে দেখবেন, জালে এসব ছোট্ট পোকাই হয়তোবা আটকে পড়ে রয়েছে। একটা বোকা উচ্চিংড়ে হঠাৎ লাফিয়ে জালের উপর ল্যান্ড করলেই জাল তার বাহাদুরি খেলা দেখাতে শুরু করে দেয়। কেন ছোট্ট পোকা এই জাল থেকে ছুটতে পারে না, এমন চিন্তা নিশ্চয়ই আমার মতো আপনার মাথাতেও দোল দিয়ে যায়।

মাকড়শার জালে শিকার সুন্দরী প্রজাপতি; Image Source: wingedbeauty.com
প্রথম কথা হলো, জালের সুতোয় মাখানো থাকে আঠা। আটকে পড়া পোকা জালের আঠা থেকে ছুটে যেতে ঝাপটাঝাপটি করতে শুরু করে। তবে সব ক্ষেত্রেই বিশেষ একটা লাভ হয় না আটকে পড়া শিকারের। উচ্চিংড়ে বা ফড়িং জাতীয় পোকাদের গায়ে, পায়ে, ডানায় বেশ জোর থাকে। কখনও কখনও হয়তোবা কপাল ভালো থাকলে জাল ছিঁড়ে রেহাই পেয়েও যায়। কিন্তু সবসময় তা ঘটে না।

মাকড়শার লাঞ্চ চলছে তার শিকার উচ্চিংড়ে দিয়ে; Image Courtesy: Jeevan Jose/wikidata
মাকড়শার জালের সুতো এমনই এক মহা আশ্চর্যের জিনিস বলা চলে। সমান পুরুত্বের ইস্পাতের তারের চেয়েও মাকড়শার জাল কিন্তু অধিক পরিমানে শক্ত, মানে ছিঁড়তে বেশি শক্তি লাগে। সেই সাথে আরও অবাক করার বিষয় হলো এই জাল যতই টানাটানি করা হবে, তা ততই বাড়তেই থাকে। আর ঠিক এই গুণের দাপটেই কিন্তু উচ্চিংড়ে বা ফড়িং তার ডানার জারিজুরি খুব বেশি একটা খাটাতে পারে না। এসব কিন্তু আমার কথা নয়, নানা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফল, যা আমি জেনে শুধুমাত্র শেয়ার করার অধিকারের দাবিদার মাত্র।

মাকড়শার জালে আটকে পড়া প্রজাপতি; Image Source: wingedbeauty.com
শিকার যতই পা ছুড়ুক, জালের সুতোর টানে তা আরও বেশি পোক্ত হয়ে শিকারকে আটকিয়ে রাখে। উল্টো দাপাদাপি করতে করতে একসময় পোকাগুলোয় হাঁপিয়ে উঠে। এমন আরও অনেক গুণ রয়েছে মাকড়শার জালের সুতোয়। আর সে কারণেই পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানীরা উঠে পড়ে লেগেছেন কারখানায় কী করে একই ফর্মুলায় এই জালের সুতো তৈরি করা যায়। সে নিয়ে বিজ্ঞানীরা হয়ে উঠেছেন মহাব্যস্ত। সেই পথ খুঁজতে ব্যয় হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
যে কথা হচ্ছিল, জাল বেয়ে আসা শিকারের কম্পন থেকেই কিন্তু মাকড়শারা ‘খবর পড়ে’। তারা জালের কম্পন থেকেই বুঝতে পারে সেটা বাতাসের দোলা, নাকি বন্দী পোকার ছটফটানি, নাকি আপনার-আমার মতন কেউ কাঠি দিয়ে জাল নাড়িয়ে দেখতে চাইছে মাকড়শারা বুদ্ধিমান নাকি বোকা প্রকৃতির।

মাকড়শার শিকার আটকে রয়েছে তারই পাতা জালে; Image Source: videoblocks.com
আবার এখানে অন্য ব্যাপারও আছে বৈকি। কোনো পুরুষ মাকড়শা যদি কোনো স্ত্রী মাকড়শার সাথে ভাব করতে চায়, তবে জালের ধারে এসে তার ভাষায় একটা মিহি টোকা দিয়ে যায়। ঠিক তখন জালের সুতোয় ঢেউ খেলে যায়। স্ত্রী মাকড়শা সে ভাষা বুঝে নিয়ে উল্টো তার দিক থেকেও পাঠিয়ে দেয় দোল তরঙ্গ। তারা এই ঢেউ থেকেই পড়ে নেয় তাদের মনের কথোপকথন। একেকটা মাকড়শা তাদের নিজ নিজ ভাষায় জালে টোকা দেয়। অন্য কোনো প্রজাতির সে ভাষা বুঝতে পারার কথা নয়। কিন্তু এর মাঝেই ঘটনার ক্লাইম্যাক্স তৈরি হয়ে যায় অন্যভাবে। ঠিক সিনেমার ভিলেনদের মতোই উপস্থিত হয় মাঝে মাঝে ‘পোর্শিয়া’ নামের অন্য এক প্রজাতির মাকড়শা।

অতি চালাক ভিলেন মাকড়শা পোর্শিয়া; Image Source: picswalls.com
এই পোর্শিয়া প্রজাতির মাকড়শারা অন্য বেশ কিছু মাকড়শার জালের ভাষা রপ্ত করে নিয়েছে। তার মতলব কিন্তু ভিন্ন। সে শুধু অন্যের ভাষা বুঝতেই পারে না কেবল, তা নকল করে হুবহু প্রয়োগও করতে পারে। সুযোগ বুঝে কোনো মাকড়শার জালের সুতোয় ঠিক তার ভাষার পাল্টা প্রতিক্রিয়াতেই টোকা দেয়। তারপর ধোঁকা দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে আসে সেই জালবাসি বোকা মাকড়শাটিকে। তারপরেই বেজে যায় তার বিদায় ঘণ্টা। বোকা মাকড়শাটিকে কাবু করতে খুব বেশি একটা সময় লাগে না পোর্শিয়া মাকড়শার। কাবু করা শেষেই মনের আনন্দে সেরে নেয় তার লাঞ্চ বা ডিনার।

পোর্শিয়া মাকড়শার চোখের গভীর চাহনি; Image Courtesy: BBC
বাঁচা- মরা প্রকৃতির খেলা। কে কতদিন বেঁচে থাকবে তা কেউ আগে থেকে বলে দিতে পারে না। প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই এই ভাঙা গড়ার খেলা চালিয়ে যায় নিজ মহিমায়। এ তো গেলো মাকড়শাকে নিয়ে কিছু অজানা তথ্য। পরবর্তীতে এমন আরও ভিন্ন কিছু নিয়ে মজার মজার তথ্যের ডালি সাজিয়ে আসার আশা রইল অন্য মাত্রায়।