Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে হাসপাতালে শুধু বাদুড়ের চিকিৎসা করা হয়!

আমরা সাধারণত বাদুড়কে ভয়াবহ প্রাণী হিসেবেই মনে করে থাকি। অনেকেই এদেরকে রাতের আঁধারে রক্তশোষক পিশাচের অবয়বও কল্পনা করে থাকি। তাছাড়াও আমাদের সমাজ জীবনে বাদুড় নিয়ে নানা প্রকার অজ্ঞতাও প্রচলিত আছে। পাশাপাশি অনেকেই বাদুড়ের উপকারীতার কথা জানি না।

বাদুড়কে পতঙ্গভোজী প্রাণী বলা হয়। এরা সাধারণত বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ খেয়ে জীবনধারণ করে। এরা গুবরে পোকা, মথ, মশা ইত্যাদি খায়। এরা ঘন্টায় ৫০০টি পর্যন্ত মশা শিকার করতে পারে। বাগানে বাগানে ঘুরে ফিরে খাবার সংগ্রহ করার সময় পরাগায়নের সহায়তা করে। এদের কিছু প্রজাতি আছে যারা ফলমূল খায়। তাই হয়তো এদেরকে ফলচাষীরা শত্রু মনে করতে পারেন। তবে এরা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের জন্য খুবই উপকারী প্রাণী।

বাদুড়ের দ্বারা ফুলের পরাগায়ন © Merlin D. Tuttle. BCI

উপরোক্ত কথাগুলো বলার পিছনে কিছু উদ্দেশ্য আছে। শিরোনাম দেখে অনেকেই ভাবতে পারেন, বাদুড়ের জন্য আবার হাসপাতাল হয় নাকি? যদি এমনটা ভাবেন তবে ভুল করবেন। তবে এই হাসপাতাল আমাদের দেশে নয়। আমাদের দেশে বাদুড়ের জন্য এমন বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। তবে প্রাণী হাসপাতাল আছে। এদেশের প্রাণী হাসপাতালগুলোতে সকল ধরনের প্রাণীর চিকিৎসা করা হয়। তাই বাদুড়ের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালটি দেখতে চাইলে যেতে হবে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের অ্যাথার্টন শহরে। হাসপাতালটির নাম Tolga Bat Hospital বা ‘টোলগা বাদুড় হাসপাতাল’। আজকের লেখায় এই টোলগা বাদুড় হাসপাতাল সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে।

এভাবেই কাঁটাতারে আহত হয় বাদুড়; Source: tolgabathospital.org

টোলগা বাদুড় হাসপাতালটির সূচনা হয়েছিল ১৯৯০ সালে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। সে সময় স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। পত্রিকায় লেখা হয় শত শত চশমা পরা বাদুড় প্রজাতির (Spectacled flying foxes (SFF)) এতিম হওয়ার কথা। মূলত সে সময় একধরনের পরজীবী আটুলির দ্বারা মা বাদুড়গুলো মারা যাচ্ছিল। তারপর সেখান থেকে বাচ্চা বাদুড়গুলো উদ্ধারের মধ্য দিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল টোলগা বাদুড় হাসপাতালের। উদ্ধারকৃত বাদুড়গুলো সাধারণত আঁটুলির দ্বারা পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে মারা যেত। এ আঁটুলির দ্বারা পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়াকে টিক প্যারালাইসিস বলা হয়। এই হাসপাতালে বর্তমানে কিছু বাদুড় উদ্ধার করে চিকিৎসা দেয়া হয় যেগুলো আবার কাঁটাতারের বেড়ার সাথে আটকে আহত হয়ে থাকে।

বর্তমানে যে বাদুড়গুলো হাসপাতালে আনা হয় সেগুলোকে তিনটি প্রধান বিষয় পরিকল্পনায় রেখে চিকিৎসা ও পরিচর্যা করা হয়। সেগুলো হচ্ছে উদ্ধার, পুনর্বাসন ও অবমুক্তকরণ। প্রতিবছর এক হাজারের মতো বাদুড়কে সেবাশুশ্রুষা করা হয়, যাদের মধ্যে অধিকাংশগুলোই পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। সুস্থ হওয়ার পর বনে উড়ে যাওয়ার উপযোগী হলে সেগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয়। এই তিনটি বিষয় ছাড়াও হাসপাতালটির আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। সেগুলো লেখার শেষের দিকে তুলে ধরা হবে।

বাদুড় ছানাকে উষ্ণ করতে কম্বল দিয়ে ঢাকা হয়েছে © Juergen Freund/Caters News Agency

প্রতিবছর যে এক হাজারের মতো বাদুড় উদ্ধার করে চিকিৎসা করা হয় তন্মধ্যে প্রায় ৩০০টি থাকে বাদুড় ছানা। এই ছানাগুলোর শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ উষ্ণ করতে কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়। তাছাড়াও বোতল দিয়ে তরল দুধ প্রদান করা হয়। বাচ্চাগুলোর মা মারা যাওয়ার কারণে দুধ পান করার উপায় থাকে না। তাই উদ্ধার না করলে ছানাগুলোও মারা যাবে। কিন্তু টোলগা হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা পেয়ে একদিন সুস্থ হয়ে পুনরায় বনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবে।

বাদুড়কে খাওয়ানো হয় ফলমূল; Source: sarahonthesunshinecost.com

বাদুড় ছানাগুলোকে দুধ খাওয়ানো হলেও উদ্ধারকৃত বৃহৎ বাদুড়গুলোকে প্রজাতি ও খাবার ধরনভেদে নানা ধরনের ফলমূল, সবুজ শাক-সবজি, নেক্টার ইত্যাদি খাওয়ানো হয়। ফলমূলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তরমুজ, আম, আপেল লিচু, কলা ইত্যাদি। অনেক সময় কলার সাথে দই, মধু, উচ্চমান সম্পন্ন সম্পূরক প্রোটিনযুক্ত খাবার প্রদান করা হয়ে থাকে। এভাবেই যথাযথ খাবার, চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাদুড়গুলোকে সুস্থ করে তোলে হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবকগণ।

চিকিৎসার পরও উড়তে অক্ষম হওয়ায় অভয়াশ্রমে পাওয়া বাদুড়; Source: tolgabathospital.org

চিকিৎসার পর যে সকল বাদুড় পুনরায় উড়ে যেতে সক্ষম হয় সেগুলোকে ছেড়ে দেয়া হলেও যেগুলো পুনরায় উড়তে পারে না কিংবা যেগুলো বন-জঙ্গলে ছেড়ে দিলে বাঁচতে পারবে না সেগুলোকে কিন্তু আর ছেড়ে দেয়া হয় না। এমনই একটি উদ্ধারকৃত বাদুড়ের দেখা মিলবে হাসপাতালটিতে যেটিকে দর্শনার্থীদের বাদুড় সম্পর্কিত শিক্ষাদানের জন্য রাখা হয়েছে। Leaf Nosed Bat বা পাতার মতো নাকওয়ালা বাদুড়টির আঙ্গুলের হাড় ও পর্দা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে তাকে পুনরায় জঙ্গলে ছাড়া সম্ভব হয়নি।

চশমা পরা বাদুড় প্রজাতি; Source: wikimedia.org

হাসপাতালটিতে মূলত চশমা পরা বাদুড় নিয়ে কাজ করা হয়। এছাড়াও লাল বাদুড়ও হাসপাতালটিতে পুনর্বাসনের জন্য আনা হয়। পুনর্বাসনের পর সেগুলোকে আবার গবেষণার জন্যও অনুমতি দেয়া হয়। যারা বাদুড় নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করতে চান এমন আগ্রহী পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, প্রাণী চিকিৎসকদের অনুমতি দেয়া হয়। গবেষণা কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাদুড় গবেষণাকারী বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্ব করে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে এসকল প্রকল্পের আওতায় কাউকে হাসপাতাল থেকে অর্থ প্রদান করা হয় না। বরং শিক্ষার্থীদেরই অর্থ সহায়তা দিতে হবে।

বাদুড়ের হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবক দল; Source: tolgabathospital.org

টোলগা বাদুড়ের হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এই স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে বাদুড় সম্পর্কে অনেক কিছুই শেখার সুযোগ পেয়ে থাকেন স্বেচ্ছাসেবকরা। সর্বনিম্ন দুই সপ্তাহ থেকে তিন মাসের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হওয়া যায়। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে চাইলে অবশ্যই জলাতঙ্ক রোগের টিকা নেয়া থাকতে হবে। স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য রয়েছে আনন্দঘন পরিবেশে কাজের সুযোগ।

আমাদের দেশেও প্রাণীদের জন্য হাসপাতাল রয়েছে। সেগুলোরও কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে সেগুলো ছাড়াও যদি কেউ কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিক দিতে চান তবে টোলগা বাদুড় হাসপাতালের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে মাথায় রাখতে পারেন। এখন একনজরে হাসপাতালটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানাচ্ছি:

১. বাদুড় উদ্ধার, পুনর্বাসন ও উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে করে জঙ্গলে অবমুক্ত করা। অপরদিকে যেগুলো অবমুক্ত করা সম্ভব হবে না, সেগুলোকে অভয়াশ্রম প্রদান করা।

২. বাদুড় সম্পর্কে আগ্রহীদের শিক্ষাদান করা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

৩. প্রাণী, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, গবেষণা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন এমন সম্প্রদায়ের সাথে অংশদারিত্ব ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি করা।

৪. বাদুড়ের আবাসস্থল রক্ষার জন্য কাজ করা। বিশেষ করে টোলগা অঞ্চলের বাগান মালিক ও অধিবাসীদের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে আবাসস্থল রক্ষার কাজ করা।

৫. নৈতিক বা বৈধভাবে বাদুড়ের বাস্তুসংস্থান ও ব্যবস্থাপনার উপর গবেষণার সুযোগ প্রদান করা।

৬. বাদুড়ের গুরুত্ব ও তাদের আবাসস্থল রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে নানা ধরনের প্রচারণা চালানো।

৭. স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্ব ও অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা। এছাড়াও তাদের জন্য নিরাপদ ও সমন্বয়পূর্ণ কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করা।

৮. জনসাধারণের জন্য অর্থ তহবিল গঠন করা, যা বাদুড় গবেষণায় ব্যবহৃত হবে।

হাসপাতালে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড়গুলোকে দেখার জন্য দর্শনার্থীদের বিশেষ সুযোগও রাখা আছে। দর্শনার্থীরা বাদুড়গুলো সম্পর্কে নানা ধরনের জ্ঞানার্জন করতে পারেন। এছাড়াও পরিবেশ রক্ষায় বাদুড়ের ভূমিকা সম্পর্কেও নানা তথ্যও পেয়ে থাকেন। দর্শনার্থীদের জন্য বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে। এ সময় বাদুড়গুলো খাবার গ্রহণের জন্য রুস্ট (Roost, বাদুড়ের বাসাকে রুস্ট বলা হয়) থেকে দর্শনার্থীদের চোখ বরাবর উচ্চতায় নেমে আসে। হাসপাতালটিতে প্রবেশের জন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১৮ ডলার, শিশুদের জন্য ১০ ডলার, অবসরপ্রাপ্ত ও ৬ জনের অধিক দলবদ্ধ দর্শনার্থী হলে ১৫ ডলার করে গুণতে হয়। হাসপাতালটি সারা বছর ধরে খোলা থাকলেও অক্টোবর থেকে জুন মাস পর্যন্ত এবং সরকারি ছুটির দিন দর্শনের জন্য বুকিং দিতে হয়।

ফিচার ইমেজ – Juergen Freund/Caters News Agency

Related Articles