ভয়ংকর সুন্দর কিছু ফুলের গল্প

ফুল পছন্দ করে না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। ফুলের সৌন্দর্য যাকে বিমোহিত করে না, তার নাকি মনই নেই। কিন্তু চোখজোড়ানো স্নিগ্ধ ফুলই যদি হয় প্রাণ নাশের কারণ, তখন সেটা হয় ভয়ংকর সুন্দর!

ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যদি সেই ফুলের ঘ্রাণ নেওয়া অথবা কোনো অংশ স্পর্শ বা খাওয়া হয়, তাতে হতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। এমনকি কোনো পশুপাখিও যদি গাছের পাতা বা ফুল খেয়ে ফেলে, তাতেও বিষক্রিয়ায় মারা যাবার আশংকা থাকে। এসব বিষাক্ত ফুল মানুষ, পশুপাখি সবার জন্যই হুমকিস্বরূপ।

(POISON HEMLOCK)

বিষ হেমলক কুখ্যাতি অর্জন করে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সক্রেটিসের মৃত্যুর পর। সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছিল এক পেয়ালা হেমলকের রস পান করে। ‘Devil’s bread’ বা ‘শয়তানের পাউরুটি’ নামে হেমলক আইরিশদের কাছে পরিচিত। 
হেমলক উদ্ভিদ দেখতে ঘন সবুজ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Conium maculatum। গুল্মজাতীয় এই উদ্ভিদটি সর্বোচ্চ ৪ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। দেখতে প্রায় একইরকম বলে হেমলককে প্রায় সময়ই বন্য গাজরের গাছের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়।

হেমলকের বৃদ্ধির সময় মূলত বসন্তকাল। বসন্তকালে এই উদ্ভিদ বৃদ্ধি পায় এবং ওই সময়েই হেমলক ফুল ফুটে থাকে। হেমলক ফুল দেখতে ছোট ছোট, সাদা বর্ণের। ফুলগুলো অনেকটা জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে গাছে।
হেমলক গাছের পাতা, ফুলসহ সব অংশই মারাত্মক বিষাক্ত। এমনকি গাছটা মারা গেলেও অনেকদিন পর্যন্ত বিষ সক্রিয় থাকে। উদ্ভিদে বিষের পরিমাণ এলাকাভিত্তিক হয়ে থাকে। রৌদ্রময় এলাকায় উদ্ভিদে বিষের পরিমাণ সবথেকে বেশি থাকে। হেমলকের গাছের পাতা-ফুল-আঠা তীব্র বিষাক্ত। এতটাই বিষাক্ত যে এদের খালি হাতে স্পর্শ করা যায় না। অবশ্যই হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক পরে নিতে হয়।

প্রাণী বা মানুষের শরীরে হেমলক বিষ প্রবেশের ২০ মিনিটের মধ্যে বিষক্রিয়ার উপসর্গ দেখা দেয় এবং ৩ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হতে পারে।
হেমলক দ্বারা আক্রান্ত মানুষের উপসর্গের মধ্যে মূলত দেখা যায়- হার্টবিট কমে যাওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট, পেশী দুর্বল বা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া এবং কখনো কখনো মৃত্যুও হতে পারে।
প্রাণীর ক্ষেত্রে উপসর্গের মধ্যে দেখা যায়- দ্রুত পেশী অচল হয়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট, বিপাকীয় কাজের বিঘ্ন ঘটা, প্যারালাইজড হওয়া এবং মৃত্যুও। 

সুন্দর কিন্তু বিষাক্ত হেমলক ©ravensroots.com

অলিয়েন্ডার (NERIUM AKA OLEANDER)

গুল্মজাতীয় মাঝারি আকারের ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দেয়া থোকা থোকা লাল অথবা গোলাপি বর্ণের নেরিয়ামকে দেখলে কেউ ভুল করেও ভাববে না যে এর মধ্যে লুকানো আছে প্রাণনাশের মারাত্মক বিষ! এর বৈজ্ঞানিক নাম Neriumoleanderগুল্মজাতীয় এই উদ্ভিদটি লম্বায় প্রায় ৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাতাগুলো সাধারণত দলাকারে একসাথে থাকে। পাঁচটি ফুল একসাথে দল বেঁধে থাকে। ফুল সাধারণত লাল, বেগুনি, সাদা, হলুদ ও কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণের হয়ে থাকে। ফুলে হালকা সুগন্ধ থাকে। নেরিয়াম দ্বারা মানুষ ও পশু-পাখি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। উপসর্গের মধ্যে বমি বমি ভাব, নিম্ন রক্তচাপ দেখা যায়। এটি শুধু যে প্রাণনাশের কারণ, তা কিন্তু নয়। প্রাণ বাঁচানোর কাজও করে থাকে এই উদ্ভিদটি। যেসব হৃদরোগী ডিজিটালাইজড চিকিৎসাপদ্ধতি সহ্য করতে পারেন না, তাদের ক্ষেত্রে ওলন্দ্রিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আগে অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে এই উদ্ভিদের পাতা ডায়াবেটিস, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবে এমনি সাপে কাটা অংশে ব্যবহার করতো। এমনকি আলসার, কুষ্ঠ রোগেও এই উদ্ভিদ ব্যবহার হতো।

গাছে দোদুল্যমান গোলাপি নেরিয়াম © wikimedia commons

এ্যাকোনিটাম (ACONITUM)

মানুষ তো মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়, কিন্তু কখনো কি শুনেছেন গাছ গাছের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়? তাও আবার বিষের জন্য!
এ্যাকোনিটাম উদ্ভিদটিকে হেমলকের প্রতিদ্বন্দ্বী বলা হয়। ‘শয়তানের হেলমেট’, ‘নীল রকেট; ছাড়াও আরো নানা নামে পরিচিত এই উদ্ভিদটি।
Buttercup পরিবারের (Ranunculaceae) এর অধিভুক্ত ২৫০ প্রজাতি ফুলের একটি হলো এই উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Aconitum L.; ইউরোপের সবথেকে বিপদজনক উদ্ভিদ এটি।
এই উদ্ভিদ দ্বারা আক্রান্ত হবার এক ঘণ্টার মধ্যেই উপসর্গগুলো দেখা যায় এবং ২ থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু হতে পারে।
উপসর্গের মধ্যে গলা ব্যথা, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া, মুখের ভেতরে এবং বাইরে জ্বালাপোড়া ভাব, পেট ব্যথা দেখা দেয়। হৃদক্রিয়ার পক্ষাঘাত এবং শ্বাসযন্ত্রে ক্ষতি বেশি হলে আক্রান্ত ব্যক্তি মারাও যায়। বিষক্রিয়া থেকে বেঁচে যাওয়া লোকেরা বলে থাকে, তাদের ত্বকের ভেতরে পিঁপড়া কামড়ানোর মতো ভয়ংকর সংবেদন বোধ হয়।
খালি হাতে এই গাছ স্পর্শ করা উচিত নয়। অবশ্যই হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক পরে নিতে হবে।

 

সুন্দর এই বেগুনী ফুলকে খালি হাতে স্পর্শ করা যাবেনা © penlanperennials.co.uk

ব্রগম্যানস (BRUGMANSIA ARBOREA)

উদ্ভিদের দেওয়া নাম যদি কাল হয়ে দাঁড়ায় তার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের জন্য, তখন রীতিমতো গোলকধাঁধায় পড়তে হয়। ব্রগম্যানস এমনই এক উদ্ভিদ। ‘Angel’s Trumpet’ নাম হলেও এর কর্মকাণ্ডে একে ‘Devil’s Trumpet’ বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম B. arborea.; গুল্মজাতীয় মাঝারি আকারের গাছে ফুলগুলো যখন ঝুলে থাকে, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সাদা, গোলাপি, হলুদ, কমলা সহ বেশ কয়েকটি রংয়ের হয়ে থাকে ফুলগুলো। গাছ সাধারণত ১২-১৫ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। এই উদ্ভিদের অর্ধ ডজন প্রজাতি দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণ জলবায়ুতে জন্মে থাকে।
এই উদ্ভিদটিতে মারাত্মক বিষ থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে এটা উপকার করে থাকে।
পাইলট এবং মহাকাশচারীদেরকে এটি দেয়া হয়। এমনকি প্রায়শই জীবন বাঁচানোর কাজও করে থাকে।
কিন্তু এটি যেহেতু প্রাকৃতিক, তাই পরিবেশ ও জায়গা বুঝে সঠিক অনুপাতে দেয়া হয়ে থাকে। নয়ত ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা! 

স্নিগ্ধ এই ফুলকে দেখে কখনো মনে হবেনা
  শয়তানের ডঙ্কা © flickr.com

ডাইফ্যানবাচিয়া সেগুইন (DIEFFENBACHIA SEGUINE)

উদ্ভিদটি মেক্সিকো থেকে নিউ ওয়ার্ল্ড ট্রিপক্স এবং আর্জেন্টিনার দক্ষিণে ওয়েস্ট ইন্ডিজে জন্মে থাকে। এটা শোভাময় উদ্ভিদ।
প্রায়শই মানুষের ঘরে এই গাছটা শোভা পায়। পাতার মধ্যে সাদা সাদা দাগ দেখা যায়, যেটা পাতাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। এর বৈজ্ঞানিক নাম D. seguine.
যদি কেউ ভুল করে এর পাতা চিবুতে থাকে, তাহলে মুখ-গলা জ্বালা করবে, এমনকি জিহ্বাও পুড়ে যেতে পারে। অত্যধিক পরিমাণে এর রস সেবন করলে প্রাণনাশের আশংকা থাকে।

ভুল করে এর পাতা চিবিয়ে খেয়ে ফেললে শোভাবর্ধক গাছ তখন ভয়ঙ্করী হয় ©flickr.com

আব্রুস প্রেক্যাটরিয়াস (ABRUS PRECATORIUS)

ফ্লোরিডা, ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ যুক্তরাজ্যে পাওয়া যায়। একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়, যেমন- জাভাট শিম, রজারি মটর, কাঁকড়ার চোখ এবং love bean। এর বৈজ্ঞানিক নাম A. precatorius.; বীজ ডিম্বাকৃতির। বীজের রং পরিবর্তিত হয়ে লাল, কালো, কমলা ও সাদা হয়ে থাকে। উদ্ভিদের বিষাক্ত অংশ হলো বীজ এবং শেকড়। বীজগুলো গয়না, অলংকার তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। 
ভুলে এই বীজ বা বীজের পাউডার খেয়ে ফেললে ডায়রিয়া, বমি, গর্ভপাত সহ মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

টকটকে রসালো ফলগুলো দেখলে খাওয়ার লোভ করা যাবে না ভুলেও © keyserver.lucidcentral.org

(HIPPOMANE MANCINELLA)

ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, সেন্ট্রাল আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর প্রান্ত এবং দক্ষিণ ফ্লোরিডার উপকূল জুড়ে সাজানো এই গাছটি বিচের মতো সাজানো থাকে, যা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু সেই সবুজ বিচ মনে হওয়া গাছকে ভুলেও স্পর্শ করা যাবে না। কারণ এর ভয়ঙ্কর বিষাক্ততা।
এটি এতটাই বিষাক্ত যে গাছে সর্তকবাণী ঝুলিয়ে দেয়া হয়, যাতে কেউ এই গাছের পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদি স্পর্শ না করে। 

গাছে টানিয়ে দেয়া সতর্কবাণী ©pinterest.com

গাছের ফল খেতে প্রলুব্ধ বা গাছের নিচে বসে যাতে কেউ বিশ্রাম পর্যন্ত না নেয়, তাই এই সর্তকবাণী দেয়া। যদি আপনি এখান থেকে সুস্থ ফিরে যেতে চান, তাহলে ভুলেও এখানে বসবেন, এর ফল খাবেন না বা এর কোনো অংশ স্পর্শ করবেন না। স্প্যানিশদের কাছে এই গাছ ‘মৃত্যুর গাছ’ হিসাবে পরিচিত। 

দেখতে নিরীহ হলেও এই ফল জীবনের জন্য হুমকি © ilovehomoeopathy.com

এর বৈজ্ঞানিক  নাম H. mancinella.; ফল অনেক সুস্বাদু এবং মিষ্টি কিন্তু ভয়ংকর বিষাক্ত। এই গাছের ফল খেয়ে অনেক মানুষই মারা গেছে। এই ফল খেলে তীব্র পেটে ব্যথা এবং অন্ত্রের সমস্যা, শ্বাসক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দেয়।
এর স্যুপের মত সাদা আঠা যদি ত্বকের কোনো জায়গায় লেগে যায়, তাহলে সেখানে ফোস্কা পড়ে যায়। ভুল করে যদি চোখে যায়, তাহলে অন্ধ হয়ে যাবারও সম্ভাবনা থাকে। 

ফিচার ইমেজ – io9.gizmodo.com

Related Articles

Exit mobile version