জম্বি শব্দটির সাথে আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিত। এরা মূলত মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর সচল মৃতদেহ, যাদের নিজেদের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এরা নিজেদের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিক্ষিপ্ত রুপে চলাফেরা করে এবং এদেরকে নিয়ন্ত্রণকারী সত্ত্বার উদ্দেশ্য অনুযায়ী স্বজাতীয় প্রাণীর উপর আক্রমণ করে তাদেরকেও জম্বিতে পরিণত করে।
মূলত ভৌতিক এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রেই জম্বির প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। চলচ্চিত্রে জম্বিদেরকে বাস্তবে দেখা না গেলেও বিচিত্র প্রাণীজগতে এমন কিছু প্রাণীর অস্তিত্ব আছে, যারা জীবনচক্রের বিভিন্ন সময় অনেকটা জম্বির মতোই আচরণ করে। এরা নিজেদের বংশবৃদ্ধির স্বার্থে অন্য কোনো প্রাণীর উপর আক্রমণ করে তাদের মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং তাদেরকে এমন আচরণ করতে বাধ্য করে, যা সাধারণভাবে তাদের করার কথা না। চলুন জেনে নেওয়া যাক এরকম বিচিত্র কিছু জম্বি প্রাণীর পরিচয়।
১) মাকড়শাকে জম্বিতে পরিণত করা বোলতা
Hymenoepimecis argyraphaga নামক এই বিশেষ ধরনের পরজীবি বোলতার বাস কোস্টারিকা এবং পুয়ের্তোরিকায়। এদের প্রধান শিকার Plesiometa argyra নামক মাকড়শা। এরা মাকড়শাগুলোকে আক্রমণ করে তাদের জাল বোনার পদ্ধতি এমনভাবে পরিবর্তিত করে দেয় যে, মাকড়শাগুলো তাদের অভ্যাসের বিপরীতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী শক্ত সুতার জাল বুনতে শুরু করে বোলতাগুলোকে রক্ষার জন্যই।
পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী বোলতা মাকড়শার উপর আক্রমণ করে এদেরকে অবশ করে দেয় এবং এদের পেটের উপরে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বোলতার শূককীট বের হয় এবং সেটি মাকড়শার শরীর থেকে রক্ত ও পুষ্টি শোষণ করে জীবন ধারণ করতে থাকে। সে অবস্থাতেই দুই সপ্তাহ পর্যন্ত মাকড়শাটি স্বাভাবিকভাবে তার জাল বুনে যেতে থাকে এবং পোকামাকড় শিকার করে খেতে থাকে। দুই সপ্তাহ পরে যখন শূককীট থেকে মূককীটে পরিণত হওয়ার সময় আসে, তখন এটি আশ্রয়দাতা মাকড়শাটির শরীরে হুল ফুটিয়ে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ প্রবেশ করিয়ে দেয়। এই রাসায়নিক পদার্থটির প্রভাবে মাকড়শাটি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং এমন এক ধরনের জাল বুনতে শুরু করে, যা এর আগে কখনো বোনেনি।
অত্যন্ত শক্ত এবং ভিন্ন নকশার এই জাল বোনা শেষ করে মাকড়শাটি জালের মাঝখানে গিয়ে স্থির হয়ে বসে পড়ে। শূককীটটি তখন মাকড়শাটির শরীর থেকে ঝরে পড়ে, বিষাক্ত হুল ফুটিয়ে একে হত্যা করে এবং এর শরীর সম্পূর্ণ শুষে নিঃশেষ করে ফেলে। এরপর এটি গুটি নির্মাণ করতে শুরু করে, যা সদ্য নির্মিত বিশেষ ধরনের জালটি থেকে ঝুলতে থাকে। জম্বি মাকড়শার দ্বারা তৈরি জালের ভেতরে নির্মিত এই গুটির ভেতরে নিরাপদে থেকেই শূককীট থেকে মূককীটে এবং পূর্ণাঙ্গ বোলতায় রূপান্তরের কাজটি সম্পন্ন হয়।
২) পিঁপড়াকে জম্বিতে পরিণত করা চ্যাপ্টা কৃমি
এদের বৈজ্ঞানিক নাম Dicrocoelium dendriticum, তবে ইংরেজিতে এরা lancet liver fluke নামেই বেশি পরিচিত। এই বিশেষ ধরনের পরজীবির জীবনচক্র দুই ধাপে আবর্তিত হয়। পূর্ণবয়স্ক চ্যাপ্টাকৃমি গরু বা অন্য কোনো তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণীর যকৃতে বসবাস করে। এখানে এরা আশ্রয়দাতা প্রাণীটির মলের অভ্যন্তরে ডিম স্থাপন করে। কোনো শামুক যখন সেই মল ভক্ষণ করে, তখন তা কৃমির শূককীট দ্বারা আক্রান্ত হয়। শূককীট শামুকের অন্ত্রের আবরণ ভেদ করে পাচনতন্ত্রের ভেতর অবস্থান নেয়। সেখানে তারা কিশোর বয়স পর্যন্ত বৃদ্ধিলাভ করে। শামুক নিজেকে রক্ষা করার জন্য কৃমিগুলোকে পূঁজকোষ দ্বারা ঢেকে দিয়ে বমির সাথে শরীর থেকে বের করে দেয়।
এই পূঁজকোষ যখন কোনো পিপীলিকা মুখে দেয়, সাথে সাথে সে সেখানে থাকা শতশত কিশোর বয়সী কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হয়। পরজীবীগুলো পিঁপড়ার অন্ত্র সহ সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তারা পিপীলিকার মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বেলা পড়ে আসতে থাকলে কৃমিগুলো পিপীলিকার স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে তাকে দল থেকে দূরে সরিয়ে নিতে থাকে এবং চারণভূমিতে নিয়ে ঘাষের ডগার উপ উঠিয়ে সেখানে স্থিরভাবে বসিয়ে রাখে। সূর্যের তাপেও যদি দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে, তাহলে প্রচন্ড তাপে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। তাই ভোর পর্যন্ত এভাবে বসিয়ে রাখার পর কৃমিগুলো পিপীলিকার শরীরের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয় এবং সেটি দলের কাছে ফিরে যায়।
পরদিন বিকেলে আবার একই ঘটনা ঘটে। দিনের পর দিন ধরে নিজের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণহীন জম্বি পিপীলিকা বিকেল থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত ঘাসের ডগার উপর বসে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো তৃণভোজী প্রাণী ঘাস খেতে গিয়ে তাকে খেয়ে ফেলে। তৃণভোজী প্রাণীর পাকস্থলীতে প্রবেশ করামাত্রই কৃমিগুলো পূর্বের ন্যায় তার যকৃতে প্রবেশ করে জীবনচক্র সম্পূর্ণ করতে পারে।
৩) ফড়িংকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা সুতাকৃমি
এই বিশেষ ধরনের সুতাকৃমির বৈজ্ঞানিক নাম Spinochordodes tellinii। এরা বেড়ে ওঠে শরীরের অভ্যন্তরে, কিন্তু বংশবিস্তারের জন্য এদেরকে পানিতে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। তাই পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পরে এরা দুটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন উৎপন্ন করে এবং সেগুলো এদের আশ্রয়দাতা প্রাণীর মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়ে তাদের স্নায়ুতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই প্রোটিনের প্রভাবে প্রাণীগুলো আলোর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। যেহেতু বিভিন্ন পুকুর, নদী, ডোবা সহ বিভিন্ন জলাধারে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়, তাই সেগুলোর কাছাকাছি যাওয়া মাত্র কৃমিগুলো জম্বিতে পরিণত হওয়া ফড়িং বা ঝিঁঝিঁ পোকাকে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করাতে বাধ্য করে।
পানিতে প্রবেশ করার পরপরই কৃমিগুলো আশ্রয়দাতা প্রাণীদের শরীর ভেদ করে বেরিয়ে আসে এবং বিপরীত লিঙ্গের কৃমির সাথে মিলিত হয়ে বংশবৃদ্ধি করে। পানিতে জন্ম হলেও এদের শূককীটগুলো পানিতে পূর্ণাঙ্গভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে না, বরং তারা মশার খাদ্যে পরিণত হয়। সেই মশাকেই যখন ঘাসফড়িং বা ঝিঁঝিঁ পোকা ভক্ষণ করে, তখন তাদের দেহের অভ্যন্তরে কৃমির শূককীট বৃদ্ধি পায় এবং তাদের জীবনচক্র পূর্ণতা পায়। ফড়িং কিংবা ঝিঁঝিঁ পোকার শরীরের অভ্যন্তরে পেঁচানো সুতাকৃমিগুলো দৈর্ঘ্যে তাদের তিনগুণ পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
৪) তেলাপোকাকে জম্বিতে পরিণত করা বোলতা
Ampulex comressa হচ্ছে বিশেষ ধরনের বোলতা, যারা পান্না বোলতা নামেই অধিক পরিচিত। সাধারণত দক্ষিণ আফ্রিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোতে এদের দেখা পাওয়া যায়। এরা বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তেলাপোকাকে আক্রমণ করে। প্রথমবার তেলাপোকার শরীরে নির্দিষ্ট স্থানে হুল ফুটিয়ে তাদের সম্মুখ পাগুলোকে অবশ করে দেয়। ফলে এটি নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এরপর অবশ তেলাপোকার মাথার বিশেষ স্থানে দ্বিতীয়বার বিষাক্ত হুল ফুটিয়ে এর অনুভূতিকে দুর্বল করে দেয়।
বোলতাগুলো অনুভূতিহীন দুর্বল তেলাপোকাকে তার শুঁড়ের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের গর্তে নিয়ে আসে, যেখানে এর পেটের উপর ডিম পাড়ে। কয়েক সপ্তাহ ধরে সেই ডিম প্রথমে শূককীটে, সেখান থেকে মূককীটে এবং সর্বশেষে পূর্ণ বোলতায় পরিণত হয়। পুরো সময়টা জুড়ে নিজের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণহীন তেলাপোকাটি অলসভাবে বোলতার বাসায় বসে থাকে এবং বোলতার সন্তানের বৃদ্ধির জন্য নিজের শরীরকে নিয়োজিত করে রাখে।
৫) ইঁদুরকে বিড়ালের প্রতি আকৃষ্টকারী পরজীবী
Toxoplasma gondii হচ্ছে একধরনের এককোষী পরজীবী, যারা প্রায় সব ধরনের উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণীর শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু একমাত্র বিড়ালের শরীরেই এরা প্রজনন এবং বংশবৃদ্ধি করতে পারে। আর সেকারণেই টিকে থাকার এবং বংশবৃদ্ধির জন্য এরা আক্রান্ত ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর বৈশিষ্ট্যকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে, ইঁদুরগুলো আর বিড়ালকে ভয় পায় না। তারা শুধু যে বিড়ালের আশেপাশে নির্ভয়ে চলাচল করে, তা-ই না, বরং তারা বিড়ালের মূত্রের গন্ধের প্রতি আকৃষ্টও হতে শুরু করে। ইঁদুরের এই অদ্ভুত আচরণগত বৈশিষ্ট্যকে ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন সিন্ড্রোম বলা হয়।
পরজীবীটি দ্বারা আক্রান্ত জম্বি ইঁদুরগুলোর এ ধরনের বেপরোয়া আচরণের ফলে তারা বিড়াল দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হয়। পরজীবীগুলো ইঁদুরের প্রতিক্রিয়াকেও ধীর করে দেয়, ফলে বিড়ালের আক্রমণ থেকে এরা নিজেদেরকে বাঁচানোর তেমন চেষ্টা করতে পারে না। আক্রান্ত ইঁদুরগুলোকে খাওয়ামাত্রই পরজীবীগুলো বিড়ালের শরীরে সংক্রমিত হয় এবং সেখানে বংশবৃদ্ধি করে। এ ধরনের পরজীবী মানুষের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। এবং এদের প্রভাবে মানুষের মধ্যেও ধীরগতির প্রতিক্রিয়া এবং বিড়ালের মূত্র সহ্য করার ক্ষমতা লক্ষ্য করা গেছে।
ফিচার ইমেজ- Wikimedia Commons