প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোতে শাসনব্যবস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করে গণতন্ত্র। নগররাষ্ট্রের যুগ পেরিয়ে সাম্রাজ্যবাদের যুগে শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের পুনঃরুজ্জীবন ঘটে আটলান্টিক মহাসাগর পাঁড়ের দেশগুলোতে আটলান্টিক রেভ্যুলুশনের মাধ্যমে। শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় উনবিংশ শতাব্দী জুড়েই শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গেছে ইউরোপ, এশিয়াতে এই শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের ঢেউ লাগে বিংশ শতাব্দীতে, ইরান আর চীনের মাধ্যমে।
শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র সকল সমাজে ব্যবহার উপযোগী। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সকল পরিচয়ের মানুষের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা যায়, খাপ খাইয়ে নিতে পারে স্থানীয় রাজনৈতিক ঐতিহ্য আর রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথেও। শাসনতান্ত্রিক আদর্শ হিসবে এই সুবিধাগুলোকে সঙ্গী করেই, ১৯৮৯ সালের বার্লিন দেয়ালের পতন আর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে একক মতাদর্শ হিসেবে আবির্ভূত হয় গণতন্ত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যেখানে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা ছিলো ১৫টি, এই শতাব্দীর শুরুতে সেখানে গণতাত্রিক দেশের সংখ্যা হয় প্রায় দেড়শোটি। বর্তমানে, ১৬০ টিরও বেশি দেশে রয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসনকাঠামোতে ভিন্নতা রয়েছে, ভিন্নতা রয়েছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজেও। শাসনব্যবস্থা হিসেবে স্ক্যানডেনেভিয়ান দেশগুলোতে রয়েছে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, একইরকম কাঠামো রয়েছে ইংল্যান্ডেও। এই কাঠামো সরকারপ্রধান, জাতীয় আইনসভা আর স্থানীয় আইনসভার সদস্যরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও, রাষ্ট্রপ্রধান হন উত্তরাধিকার সূত্রে। আবার ফেডারেল কাঠামো প্রেসিডেন্ট একইসাথে দায়িত্ব পালন করেন সরকারপ্রধান আর রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে, নির্বাচিত হন জনগণের সরাসরি ভোটে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে প্রধানমন্ত্রী, নির্বাচিত হন জনগণের সরাসরি ভোটে। এসব দেশে সাধারণত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয় পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে। কিছু দেশে রয়েছে প্রিমিয়ার সিস্টেম, যেখানে প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি থাকেন প্রধানমন্ত্রীও।
এই ভিন্নতার মধ্যেও গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কিছু মৌলিক মিল রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে নির্দিষ্ট সময় পরপর নিয়মিত নির্বাচন আয়োজিত হয়, নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারে না, নিশ্চয়তা দিতে হয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের। তিনটি কারণে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অন্যান্য শাসনব্যবস্থাকে হারিয়ে আদর্শ শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিজয় লাভ করেছে।
প্রথমত, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের ক্ষমতার মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করে। আধুনিক যুগে রাষ্ট্রকাঠামোকে সাধারণত তিন অংশে ভাগ করা হয়, আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ আর বিচার বিভাগ। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আইন বিভাগের সদস্য হন, তাদের তৈরি করা আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রের মূল্যবোধ। সরকারপ্রধানের নেতৃত্বাধীন নির্বাহী বিভাগ সেই আইন প্রয়োগ করেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নিয়মিত কাজগুলোও পরিচালিত হয় এই অংশের মাধ্যমে। আইনি কাঠামো নাগরিকদের অধিকার হরণ করছে কিনা, এক নাগরিকের মাধ্যমে অন্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা, সেগুলোর ব্যাখ্যা দেয় বিচার বিভাগ, নির্দেশনা দেয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের।
নগররাষ্ট্রের যুগ কিংবা সাম্রাজ্যবাদের যুগে, যখন রাষ্ট্রকাঠামো ছিল রাজতান্ত্রিক, তখন রাজারা এই তিন বিভাগের সবগুলোর প্রধান থাকতেন। নিজের অসীম ক্ষমতার মাধ্যমে বিঘ্নিত করতেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। আইন বিভাগের কোনো অস্বিত্বই থাকতো না বেশিরভাগ সময়, নির্বাহী বিভাগেরও একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকতো রাজার হাতেই।
দ্বিতীয়ত, মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, মানুষ যখন তুলনামূলকভাবে কোনো ক্ষুদ্র গ্রুপের সদস্য হয়, তখন সে সহজেই সেই গ্রুপের নেতার কর্তৃত্ব আর নির্দেশ মেনে নেয়। কিন্তু, গ্রুপের আকার যতই বড় হতে থাকে, গ্রুপের সদস্য হিসেবে গ্রুপের নেতার সাথে মানসিক দূরত্ব বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে গ্রুপের নেতার নির্দেশ না মানার প্রবণতা। মানুষের এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে সামনে রেখেই, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ক্ষমতাকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার আর স্থানীয় সরকারের মধ্যেও। স্থানীয় আর কেন্দ্রীয়, প্রত্যেক পর্যায়েই সুযোগ রয়েছে ভোটের মাধ্যমে নিজের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচনের।
তৃতীয়ত, গণতান্ত্রিক কাঠামো একজন মানুষ হিসেবে যেসব অধিকার পাওয়া কথা, সেগুলোর নিশ্চয়তা দেয়, স্বীকার করে বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দল তৈরি করার মতো রাজনৈতিক অধিকারগুলোকে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, নিশ্চয়তা দেয় ব্যক্তিস্বাধীনতার।
গণতন্ত্রের উত্থান-পতন
বিংশ শতাব্দীতে আশির দশকের শেষদিকে পতন ঘটে বার্লিন দেয়ালের, নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই পূর্ব ইউরোপের গণতন্ত্রের উত্থানের সাথে সাথে পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের। শাসনব্যবস্থা হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র পরাজিত করে ফ্যাসিবাদকে, কমিউনিজমের পতনের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় গণতন্ত্রের। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির এই রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন আখ্যায়িত করেন গণতন্ত্রের ‘তৃতীয় ঢেউ’ হিসেবে, ফ্রান্সিস ফুকুয়ামো লিখে ফেলেন তার সাড়া জাগানো আর্টিকেল, ‘দ্য এন্ড অব হিস্টরি’।
স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পরবর্তী এক যুগের মধ্যে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দেড়শো ছাড়িয়ে যায়। বিভিন্ন দেশে বাড়তে থাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা। ফ্রিডম হাউজের রিপোর্ট অনুযায়ী, স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। পলিটিক্যাল পার্টিসিপেশন আর সিভিল লিবার্টিতে স্কোর বৃদ্ধি পায় ৩৬ শতাংশ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত।
২০০৫ সালের পরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের এই চিত্র বদলে যায়, শুরু হয় উল্টোদিকে পথচলা। এরপরে টানা ১৫ বছর ধরে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের সার্বিক অবস্থার পতন হচ্ছে। নব্বইয়ের পরবর্তী সময়ে যেসব দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেছিল, তার মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশে গত কয়েক বছরে পতন ঘটেছে গণতন্ত্রের মানে, সংকুচিত হয়েছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ। যেমন, নব্বইয়ের আগে ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরি ফ্রিডম হাউজের র্যাংকিংয়ে ‘আংশিক মুক্ত’ একটি দেশ ছিল। নব্বইয়ের দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সময়ে সেখানে বিকশিত হয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বৃদ্ধি পায় গণতন্ত্রের অধিকারগুলোর চর্চা, হাঙ্গেরি ফ্রিডম হাউজের রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত হয় ‘পূর্ণ মুক্ত’ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে হাঙ্গেরির গণতন্ত্রের মানের আবার পতন ঘটেছে, হাঙ্গেরি ফিরে গেছে তার ‘আংশিক মুক্ত’ রাষ্ট্রের স্ট্যাটাসে।
গণতন্ত্রের উত্থান-পতনের আঞ্চলিক প্রবণতা
ফ্রান্সিস ফুকুয়ামোর মতে, আধুনিক যুগে মানুষের কাছে গণতন্ত্র সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দুই কারণে। প্রথমত, গণতন্ত্র একটি স্বতঃস্ফুর্ত প্রক্রিয়া, সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা আছে। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র সকল মানুষকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সকল মানুষের বাকস্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো স্বীকার করেছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরও গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে গণতন্ত্রের মান, মহামারির মতো জরুরি অবস্থানে সেই পতন আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষের দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ সংকীর্ণ হয়েছে, রাষ্ট্র জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকেছে। গত এক যুগ ধরে যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পতন হচ্ছে, তার কিছু আঞ্চলিক প্রবণতা রয়েছে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া: রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর অযাচিত হস্তক্ষেপ
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা বড় অংশ স্বাধীনতা পেয়েছে গত শতাব্দীতে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার চর্চাও খুব একটা পুরোনো নয়। নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষার হার কম থাকায় এসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান নিম্ন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ কম। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তৈরি হয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অবতারবাদ। ফলে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসব দেশে নিজেকে অদ্বিতীয় অবস্থানে নিয়ে গেছে সামরিক বাহিনী, রাষ্ট্রীয় অস্ত্রের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানকে করেছে সুসংহত। ফলে, খুব সহজেই এসব দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সামরিক বাহিনী, পতন ঘটে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের।
স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে বার বার হস্তক্ষেপ করেছে সামরিক বাহিনী, নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দখল করেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে না থাকলেও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই। আবার, ফেব্রুয়ারির শুরুতে মায়ানমারের পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করে দিয়েছে সামরিক বাহিনী তাতমাদৌ, বন্দী করেছে বিজয়ী ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির নেতা অং সান সুচিকে। রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর এসব হস্তক্ষেপ অবধারিতভাবেই বাঁধাগ্রস্ত করে গণতান্ত্রিক বিকাশকে, সংকুচিত করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগকে।
লাতিন আমেরিকা: জনতুষ্টিবাদের উত্থান আর অভিবাসন সংকট
অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন আটলান্টিক পাঁড়ের দেশগুলো গণতন্ত্রের ঢেউ লাগে, তখন রেনেসাঁর ঢেউ লাগে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও। ইউরোপে ফ্রান্সের রাজনৈতিক উত্থান স্বাধীনতা অর্জনের সুযোগ এনে দেয় লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সামনে, উনবিংশ শতাব্দীতেই বেশিরভাগ দেশ অর্জন করে স্বাধীনতা। তবে, স্বাধীনতা অর্জনের দুইশো বছর পরেও এসব দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হয়নি, উত্থান ঘটছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অবতারবাদের। সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৈতিক সংকটগুলোকে কেন্দ্র করে লাতিন আমেরিকাতে উত্থান ঘটছে জনতুষ্টিবাদের। সাম্প্রতিক সমইয়ে ব্রাজিলে জনতুষ্টিবাদের উত্থান ঘতেছে, জনতুষ্টিবাদের উত্থান ঘটছে মেক্সিকো, নিকাগুয়ারার মতো দেশগুলোতে। এর পাশাপাশি আছে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের দীর্ঘ ইতিহাস, ভেলিজুয়েলার মতো দেশগুলর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এখনো সামরিক বাহিনীর কাছে।
ইউরোপ: গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন
নগররাষ্ট্রের যুগ পেরিয়ে সাম্রাজ্যবাদের যুগে হারিয়ে যাওয়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনরুত্থান ঘটে ইউরোপে, রেনেসাঁর মাধ্যমে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে রাজতন্ত্রকে হটিয়ে রিপাবলিকান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে প্রবেশ করতে থাকে ইউরোপ, সীমিত হতে থাকে রাজার ক্ষমতা। উনবিংশ শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন আর বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে ইউরোপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে আবার উল্টোদিকে হাঁটছে ইউরোপ, শুরু হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবমূল্যায়নের প্রক্রিয়া।
অস্ট্রিয়া উত্থান ঘটেছে জনতুষ্টিবাদী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের। ক্ষমতায় এসেই ভিক্টর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সমালোচকদের দমনের চেষ্টা করছেন, ধ্বংস করে দিচ্ছেন সিভিল সোসাইটির কার্যক্রমকে। একইরকম ঘটনা ঘটছে ফ্রান্সেও, একটা দীর্ঘ সময় হার্ড সেক্যুলারিজম চর্চা করা ফ্রান্স এখন ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত, বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের প্রতি।
ইউরোপের আরেক দেশ পোল্যান্ডেও ঘটছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। ল এন্ড জাস্টিস পার্টি ক্ষমতায় এসেই অযাচিত হস্তক্ষেপ শুরু করেছে বিচার বিভাগের উপর, হরণ করেছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শুরু হয়েছে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিচার বিভাগের ব্যবহার।
আফ্রিকা: গণতন্ত্রের উত্থান
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পতন ঘটছে, সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটছে আফ্রিকা মহাদেশে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক সংস্কার শুরু হয়েছে ইথিওপিয়াতে। ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবে আহমেদ পেয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। আফ্রিকার আরেক দেশ এঙ্গোলোতে শুরু হয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ, সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে উৎখাত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক। লিবিয়া আর মিশরে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দাবি ভয়াবহ বিপর্যয় ঢেকে আনলেও, সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হয়েছে সংকট সমাধানের সম্ভাবনা। যদিও, আফ্রিকার গণতন্ত্রায়ন আর মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি পরক্রিয়া, পুরোটাই নির্ভর করবে পরাশক্তিদের ইচ্ছার উপর।
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পতন ঘটছে, ধ্বংস হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এরমধ্যেও, আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এখন গণতন্ত্রকে ধারণ করে। তরুণরা একত্রিত হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে। এই শতাব্দীর শুরু হয়েছে রঙিন বিপ্লবের মাধ্যমে, পরবর্তী সময়ে বড়ে ঘটনা হিসেবে হাজির হয়েছে আরব বসন্ত। এই ‘প্রায় ব্যর্থ’ বিপ্লবগুলো আমাদেরকে আরো কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে নিতে পারে, আবার উন্মুক্ত করে দিতে পারে আরো বড় পরিসরে গণতন্ত্রের বিকাশের। আমাদের যাত্রা কোনদিকে হবে, তার উত্তর সময় দেবে।