৪ আগস্ট, শনিবার। সিরিয়ার হামা প্রদেশ। নিজ বাসা থেকে মাসিয়াফে অবস্থিত সিরিয়ার সায়েন্টিফিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ফ্যাসিলিটির (SSRC) উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন প্রকল্পটির একজন পরিচালক। রকেট বিজ্ঞানী ড. আজিজ আসবার। কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছার সৌভাগ্য আর হয়নি। তার আগেই এক গাড়িবোমা হামলায় প্রাণ দিতে হয় তাকে। তার মৃত্যুর দুই দিন পরে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্যপ্রাচ্যের এক গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ইসরায়েলি সাংবাদিক রোনেন বার্গম্যান দাবি করেন, ড. আজিজ আসবারকে হত্যা করেছে আর কেউ নয়, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা, মোসাদ।
ড. আজিজ আসবার ছিলেন সিরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রকেট বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন। তিনি গত বছর ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি অস্ত্রভাণ্ডার নতুন করে গড়ে তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের প্রাসাদে তার অবাধ যাতায়াত এবং ইরানি কুদস ফোর্সের কমাণ্ডার, মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানির সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন সিরিয়ার সায়েন্টিফিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ফ্যাসিলিটি, এসএসআরসির একটি টপ সিক্রেট ইউনিট, সেক্টর ফোরের প্রধান। এদের কাজ ছিল নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদে সক্ষম এরকম মধ্যম ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করা। ইসরায়েল তাকে নিয়ে ভীত ছিল, তারণ মাসিয়াফের রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে তার তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন এই মিসাইলগুলো ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও আক্রমণ করতে সক্ষম ছিল।
সিরিয়ার সায়েন্টিফিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ফ্যাসিলিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। এর উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক, জৈব, রাসায়নিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা। গৃহযুদ্ধের পূর্বে এটিই ছিল সিরিয়ার প্রধান রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র। এখানে অন্তত হাজার দশেক কর্মচারী নিয়োজিত ছিল। কিন্তু ২০০৫ সাল থেকেই প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের অবরোধের আওতায় পড়ে এই অভিযোগে যে, এটি গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের সাথে জড়িত। তবে মার্কিন অবরোধ থাকলেও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদান এবং যন্ত্রপাতি বিক্রি করে এসেছে।
তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করার পর থেকেই মূলত এসএসআরসি এবং এর বিভিন্ন ফ্যাসিলিটি যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। গত বছর সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে খান শায়খুনে বিদ্রোহীদের উপর রাসায়নিক সারিন গ্যাস প্রয়োগ করার অভিযোগ ওঠার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসএসআরসির ২৭১ জন কর্মকর্তার উপর অবরোধ আরোপ করেছিল। আসবার অবশ্য এই তালিকায় ছিলেন না। এর কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়, সম্ভবত তিনি সে সময় শুধুমাত্র মিসাইল প্রোগ্রামের দায়িত্বে ছিলেন, রাসায়নিক অস্ত্রের সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। এছাড়াও খান শায়খুনের ঘটনার পর মাসিয়াফে অবস্থিত কেন্দ্রটির উপর যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশও অবরোধ আরোপ করে।
অবরোধ ছাড়াও সিরিয়া জুড়ে এসএসআরসির বিভিন্ন কেন্দ্র একাধিকবার বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয়েছিল। সর্বপ্রথম ২০০৭ সালে ড. আসবারের তৎকালীন কর্মস্থল, আল-সাফিরের এসএসআরসির কেন্দ্রে সংঘটিত বিস্ফোরণে ১৫ জন সিরিয়ান এবং বেশ কিছু ইরানি কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। সে সময় ইরান ঐ হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে জামরায়া শহরের আরেকটি কেন্দ্রেও ইসরায়েলি বিমানবাহিনী হামলা চালায়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এবং এ বছরের এপ্রিলে ইসরায়েল মাসিয়াফের কেন্দ্রটির উপর বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পরিচালনা করে এবং কেন্দ্রটিকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। সর্বশেষ গত ২২ জুলাই ইসরায়েল যখন জানতে পারে সিরিয়া কেন্দ্রটিকে পুনরায় অস্ত্র নির্মাণের কাজে ব্যবহার করছে, তখন তারা আবারো এর উপর হামলা করে।
তবে এর আগে শুধু বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আক্রমণ করলেও সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ার ভূমিতে সরাসরি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করার অভিযোগ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই প্রথম। ২২ জুলাইয়ের হামলার পরেও তিনি বেঁচে যাওয়াতে সম্ভবত ইসরায়েল তাকে পরবর্তীতে গাড়িবোমার মাধ্যমে হত্যা করে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই ড. আসবারের উপর নজরদারি করে আসছিল। সিরিয়ার মিসাইল প্রোগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০১১ সালের যুদ্ধের আগে থেকেই মোসাদ তাকে হত্যার চেষ্টা করে আসছিল বলে মনে করেন সিরিয়ার এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এছাড়াও সিরিয়ার আল-ওয়াতান পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, মোসাদ এজেন্টরা এর আগেও অন্তত দুইবার ড. আসবারকে হত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল।
বিদেশের মাটিতে অস্ত্র নির্মাণের সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদেরকে হত্যা করা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের জন্য অনেকটা নিয়মিত ঘটনা। ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোসাদ অন্তত ছয়জন ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। এছাড়াও ২০০৮ সালে সিরিয়ার তারতুসে নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের সাথে জড়িত এক সিরিয়ান জেনারেলকে, ২০১০ সালে দুবাইয়ে ইরানের কাছ থেকে মিসাইল ক্রয়ের কাজে নিযুক্ত হামাসের এক কর্মকর্তাকে, ২০১৩ সালে বৈরুতে হেজবুল্লাহ্র রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধানকে, ২০১৬ সালে তিউনিসিয়ায় হামাসের দুইজন বিজ্ঞানীকে এবং এ বছর এপ্রিলে কুয়ালালামপুরে হামাসের এক রকেট বিজ্ঞানীকে হত্যা করার পেছনেও মোসাদ দায়ী ছিল।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে, যখন উভয় পক্ষই মোটামোটি সমান অবস্থায় ছিল, তখন ইসরায়েল প্রায় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে এসেছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সিরিয়াতে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকলে ইসরায়েলও সেখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। এর আগে শুধুমাত্র বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করলেও এবার অস্ত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত থাকা এক বিজ্ঞানীকে হত্যা করার মাধ্যমে ইসরায়েল সিরিয়ার যুদ্ধে সম্ভবত একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।
গৃহযুদ্ধের আগে দীর্ঘ প্রায় চার দশক পর্যন্ত ইসরায়েল এবং সিরিয়ার সম্পর্ক মোটামুটি একটি সাম্যাবস্থায় ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেটি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে।
ফিচার ইমেজ- AFP