যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরে থেকেই নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র উপভোগ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিংশ শতাব্দীতে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর সকল প্রান্তে। অনেকগুলো কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আর ক্ষমতার ভারসাম্যের নীতি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকর গণতন্ত্রগুলোর একটি, জনগণকে সুযোগ করে দিয়েছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার।
একটি দেশে কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হয়, জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি করতে হয়, তৈরি করতে হয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এ সবগুলো উপাদান আবর্তন করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নিয়মিত নির্বাচন একটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে শক্তিশালী করে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটায়, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করে নাগরিকদের ইচ্ছার প্রতিফলন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যাত্রায় নির্বাচন শুরু থেকেই হয়ে আছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, অনুষঙ্গ হয়েছে আমেরিকানদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরও। সাধারণত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় নভেম্বর মাসে, যেটি তীব্র শীত আর ফসল উৎপাদনের মাঝামাঝি সময়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরেকটি প্রথা যুক্তরাষ্ট্র লালন করে, ভোট হয় মঙ্গলবারে। গণতান্ত্রিক যাত্রার শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন রাজ্যে বাজার বসতো বুধবারে। সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে, তাই নির্বাচন হওয়ার বার নির্ধারিত হয় মঙ্গলবারে, যে প্রথা লালিত হচ্ছে এখনো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে। কিছুটা পরোক্ষ এ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয় ছোটবড় সকল রাজ্য যাতে সমান গুরুত্ব পায় বড় দলগুলোর কাছে, সেটি নিশ্চিত করতে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পপুলার ভোটে হেরে গিয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট, যার সামরিক বাহিনীতে কাজ করা অভিজ্ঞতা ছিল না, ছিল না আইনসভায় কাজ করার অভিজ্ঞতাও।
অ্যালান লিকম্যান: সফল নির্বাচনী পূর্বাভাস
অ্যালান লিকম্যান, ৭৩ বছর বয়সী ইতিহাসের অধ্যাপক, সফলভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বাভাস দিচ্ছেন ১৯৮৪ সালের রোনাল্ড রিগ্যানের রিইলেকশনের সময় থেকে। এরপর থেকে, প্রতিটি নির্বাচনে বিজয়ী সম্পর্কে সঠিক মতামত দিয়েছেন অ্যালান লিকম্যান, সবগুলো জনমত জরিপে পিছিয়ে থাকলেও, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে তিনি পূর্বাভাস দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের। পূর্বাভাস দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনেরও, হাউজ অভ রিপ্রেজেনটেটিভসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনের বছরখানেক আগে।
শুরুতে অ্যালান লিকম্যান নির্বাচনী পূর্বাভাস দিতেন পপুলার ভোটকে কেন্দ্র করে, যেটি প্রশ্নের মুখে এসে পড়ে ২০০০ সালের নির্বাচনে, যখন পপুলার ভোট পেয়েও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে রিপাবলিকান জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে হেরে যান ডেমোক্রেটিক প্রার্থী। তখন পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পপুলার ভোটে জিতে ইলেকটোরাল কলেজে হেরে যাওয়ার ঘটনা ছিলো মাত্র দু’টি। একটি ১৮৭৬ সালে, আরেকটি ১৮৮৮ সালে। ফলে, বিংশ শতাব্দীতে যে নির্বাচনে বিজয়ীর পূর্বাভাসগুলো দিয়েছিলেন অ্যালান লিকম্যান, সেগুলোতে পপুলার ভোটকে কেন্দ্র করে দিলেও, সেটি আসলে প্রেসিডেন্ট বিজয়ীকেই নির্দেশ করত।
২০০০ সালে ডেমোক্রেটিক প্রার্থীর পপুলার ভোটে জয়ী হওয়ার পরও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে হেরে যাওয়ার পর নিজের পূর্বাভাসের ধরনে পরিবর্তন আনেন অ্যালান লিকম্যান, এরপর থেকে সরাসরি পূর্বাভাস দেওয়া শুরু করেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর ব্যাপারে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে চতুর্থবারের মতো পপুলার ভোটে জয়ী হয়েও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে হেরে যাওয়ার ঘটনা ঘটে, তবে সঠিক ছিল অ্যালান লিকম্যানের পূর্বাভাস। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প অ্যালান লিকম্যানকে ধন্যবাদ জানিয়ে পত্র পাঠান, নির্বাচনী পূর্বাভাসের জন্য।
হোয়াইট হাউজের চাবি
পাঠকদের মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে, কীভাবে ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যালান লিকম্যান গত নয়টি নির্বাচন সম্পর্কে সঠিক পূর্বাভাস দিয়েছেন? তিনি কি জ্যোতিষী? ভবিষ্যত দেখতে পান?
না, ভবিষ্যত দেখার জন্য অ্যালান লিকম্যানের কাছে টাইম মেশিন নেই। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেন ‘The Keys to the White House‘ মডেল। এ মডেলে তিনি ব্যবহার করেন ১৩টি চাবির, যার মধ্যে ক্ষমতায় থাকা দলের প্রার্থী ছয় বা তারচেয়ে বেশি চাবিতে নেতিবাচক ফলাফল পেলে, অন্য দলের প্রার্থী জিতবে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে।
মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফল
অ্যালান লিকম্যানের মডেলে প্রথম চাবি হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা দলের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ফলাফল। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসা রিপাবলিকান পার্টি সিনেটে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখলেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে হাউজ অভ রিপ্রেজেনটেটিভসে। ১৯১৪ সালের নির্বাচনের পর সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতির এ নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি হাউজ অভ রিপ্রেজেনটেটিভসে পেয়েছে ২৩৫ আসন, রিপাবলিক পার্টি ধরে রাখতে পেরেছে ১৯৯টি আসন। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়া ডেমোক্রেটিক পার্টি এই মধ্যবর্তী নির্বাচনে পপুলার ভোটে রিপাবলিকানদের চেয়ে এগিয়ে ছিলো ৮.৬ শতাংশ।
অর্থাৎ, মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফল ২০২০ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে যাচ্ছে।
দলীয় মনোনয়ন
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির দলীয় মনোনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন জন ক্যাশিচ, মার্কো রুবিও, বেন কার্সনের মতো হেভিওয়েট রিপাবলিকান নেতাদের সাথে। তবে, রিপাবলিকান পার্টির প্রাইমারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রোজ, প্রাইমারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাওয়া ১৪৪১ ভোটের বিপরীতে টেড ক্রুজ পেয়েছিলেন ৫৫১ ভোট।
২০২০ সালের প্রাইমারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীতে বেশ কিছু প্রার্থী নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা করলেও, রিপাবলিকান পার্টির ন্যাশনাল কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একীভূত সমর্থন দেওয়ার। ফলে, অনেক রাজ্যেই হয়নি প্রাইমারি, দলীয় মনোনয়নের ২,৫৫০ ভোটের সবগুলোই পান ডোনাল্ড ট্রাম্প।
অর্থাৎ, এই চাবিটি কাজ করবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে।
ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হওয়া
তৃতীয় বিশ্বের অনেকগুলো দেশেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থিতা পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে নেতিবাচক দিক হিসেবে কাজ করে, ভোটাররা নিয়মিত ক্ষমতাসীন বদল দেখতে চায়। কিন্তু, অ্যালান লিকম্যানের তৈরী মডেলে এই উপাদানটি কাজ করে ইতিবাচক হিসেবে।
অর্থাৎ, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে বিরোধী দলের চেয়ে এগিয়ে থাকেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিপক্ষে পপুলার ভোটে হেরে গেলেও জয়ী হন ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে, পরের বছর দায়িত্ব নেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনেও ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় প্রার্থী হয়েছেন। ফলে, মডেলের এই চাবিটি কাজ করবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে।
তৃতীয় দলের প্রভাব
আড়াই শতাব্দীর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে, জর্জ ওয়াশিংটন ছাড়া কেউই নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হননি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ওয়াশিংটনের পরে প্রতিটি নির্বাচনেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বড় দুই দল থেকে, হাতি প্রতীকধারী রিপাবলিকান আর গাধা প্রতীকধারী ডেমোক্রেটিকদের মধ্যে থেকে। এরপরও, যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে হাজারো মতের প্রকাশ ঘটেছে, সম্মিলন ঘটেছে হাজারো মতাদর্শের। ফলে, তৈরি হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। ফেডারেলিস্ট পার্টি, রিফর্ম পার্টি, হুয়িগ পার্টি- এরকমই কিছু ছোট ছোট দল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে কখনো এসব দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হলেও, দু’বার ডেমোক্রেটিক কিংবা রিপাবলিকানদের ছাড়িয়ে এরা উঠে আসে দ্বিতীয় স্থানে। প্রথমটি হয় ১৮৬০ সালে, সর্বশেষটি হয় ১৯৯২ সালে, রিফর্ম পার্টির কল্যাণে।
প্রভাবশালী কোনো তৃতীয় দলের উত্থান নেতিবাচক হিসেবে কাজ করে ক্ষমতাসীন দলের জন্য, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। এবারের নির্বাচনে তৃতীয় কোনো দল থেকে এমন প্রভাবশালী প্রার্থীর উপস্থিতি এখনো দেখা যায়নি, ফলে মডেলের এই চাবিটিও কাজ করবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে।
স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক অবস্থা
আবাসন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছেন, বেফাঁস মন্তব্য করে হয়েছেন হাসির খোরাক। কিন্তু, ধনী এই ব্যবসায়ী অসাধারণভাবে ঘুরে দাঁড় করিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে, বেকারত্ব নিয়ে এসেছিলেন স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। তার এ অর্জনের ফলাফল খুব ভালোভাবেই পড়ার কথা ছিল ২০২০ সালের নির্বাচনে।
কিন্তু, এ বছরের বৈশ্বিক মহামারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই অর্জনগুলোকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে, চাকরি হারিয়েছেন প্রায় চার কোটি আমেরিকান। মহামারির কারণে বন্ধ ছিলো রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, ধস নেমেছে আবাসন খাতের ব্যবসায়, আমদানি-রপ্তানি কমেছে ২০ শতাংশেরও বেশি। বন্ধ আছে আন্তঃমহাদেশীয় বিমান ব্যবসা, যার ফলে অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রেরও বাধাগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন খাত। এসবের ফলাফল সরাসরি পড়েছে আমেরিকানদের উপর, ক্রয়ক্ষমতা কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে আমেরিকানরা রাষ্ট্র থেকে যেরকম সহযোগিতা আশা করছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটিও করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থাৎ, স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সুখবর নেই ট্রাম্পের জন্য।
দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক অবস্থা
মহামারির ফলে সব দেশেরই অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে, প্রভাব পড়েছে জিডিপি, মাথাপিছু আয়, ক্রয়ক্ষমতার মতো অর্থনৈতিক নির্দেশকগুলোতে। স্বল্পমেয়াদে বিশ্বের সবচে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও পড়েছে এ প্রভাব, যার প্রভাব থাকবে দীর্ঘমেয়াদেও। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে কমেছে প্রবৃদ্ধি, কমে গেছে আমেরিকানদের ক্রয়ক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়েছে আবাসন খাতের উপর। প্রায় চার কোটি আমেরিকান চাকরি হারিয়েছেন, যা কাটিয়ে উঠতে হয়তো কয়েক দশক লেগে যেতে পারে।
আবার, বৈশ্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উত্থান ঘটছে চীনের, দখল করে নিচ্ছে সাপ্লাই চেইনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই সংকটগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য যে কূটনৈতিক এবং প্রশাসনিক সক্ষমতা প্রয়োজন, প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প তা দেখাতে সমর্থ হননি। ফলে, মডেলের এ জায়গাতেও সুখবর নেই ট্রাম্পের জন্য।
পূর্ববর্তী রেজিমের পলিসি পরিবর্তন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই আন্তর্জাতিক পলিসিতে র্যাডিকাল কোনো পরিবর্তন আসে না। সাম্রাজ্যবাদী চেতনা যে বিস্তার, বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেওয়ার যে প্রবণতা, তা সবসময়ই এক থাকে। তবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ প্রভাবের কারণে প্রায়ই এ পলিসি পরিবর্তন হয়। পলিসি পরিবর্তন ইতিবাচকভাবে কাজ করে ক্ষমতাসীন দলের জন্য।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই চেষ্টা করেছেন ওবামার লিগ্যাসি মুছে দিতে, ওবামার থেকে ভিন্ন পথে হাঁটার জন্য। বারাক ওবামার সবচেয়ে বড় যে অর্জন- প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, সেটি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বের করে এনেছেন যুক্তরাষ্ট্রকে, বেরিয়ে এসেছেন ইরানের সাথে ছয় জাতির পরমাণু চুক্তি থেকেও। ওবামাকেয়ারের বদলে চালু করার চেষ্টা করেছেন ট্রাম্পকেয়ার, যে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের হস্তক্ষেপে। তবুও, মডেলের এই জায়গাটি সুখবর দিচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।
সামাজিক অস্থিরতা
জনতুষ্টিবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই বিভাজন তৈরি করেছেন আমেরিকান সমাজে, রক্ষণশীল শ্বেত আমেরিকানদের সাথে আফ্রিকান-আমেরিকানদের বিভাজন তুলেছেন তুঙ্গে। বিভাজন তৈরি করেছেন নেটিভ আমেরিকানদের সাথে অভিবাসী হয়ে আসা আমেরিকানদের, বিভাজন তৈরি করেছেন ধর্মকে কেন্দ্র করে। এর প্রভাব পড়েছে সামাজিক কাঠামোতে, বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতা।
এর একটি বড় প্রকাশ দেখা যায় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের মাধ্যমে। ট্রাম্প প্রশাসনের শ্বেত প্রাধান্যের ধারণার উপর ভিত্তি করে সামাজিক এবং প্রশাসনিক বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এই আন্দোলন, যা পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। ফলে, কাঠামোর এই জায়গাটি কাজ করবে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের পক্ষে।
স্ক্যান্ডাল
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগ থেকেই বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, ছিলেন বেফাঁস মন্তব্য করেও। পুরো প্রেসিডেন্সির সময়টাতে একের পর এক নারী কেলেঙ্কারির খবর বেড়িয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে, সমালোচিত হয়েছেন একের পর এক মিথ্যা বলে। ক্ষমতার অপব্যবহার আর বিচার বিভাগের কাজে বাধা দিয়ে হাউজ অভ রিপ্রেজেনটেটিভসে হয়েছেন অভিশংসিত।
সামরিক ব্যর্থতা
ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন জায়গায় বিভাজন তৈরি করে, এমন কথা বলেছেন; সমালোচিত হয়েছে তার প্রশাসনের অদক্ষতাও। এই অদক্ষ প্রশাসনকে নিয়েই ট্রাম্পকে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে বিভিন্ন ফ্রন্টে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা মধ্য এশিয়া, কোথাও ব্যর্থ হননি ট্রাম্প। মডেলের এই জায়গাটি কাজ করছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে।
সামরিক সাফল্য
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে হয়তো কোনো সামরিক ব্যর্থতা নেই যুক্তরাষ্ট্রের, কিন্তু এটাও সত্য যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে কোনো সামরিক সাফল্যও নেই যুক্তরাষ্ট্রের। বরং, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত মিত্ররা যখন সামরিক হুমকির মুখোমুখি হয়েছে, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে হিমশিম খেয়েছে, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্বহীন কূটনীতি হতাশ করেছে মিত্রদের, হতাশ করেছে আমেরিকানদের। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে সবচেয়ে বড় সামরিক সাফল্য হিসেবে হয়তো ব্যাখ্যা করা হবে ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার ব্যাপারটি। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে, জেনারেল সোলাইমানি হত্যার শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত ৯৫ ভাগেরও বেশি আমেরিকান তার নামই শোনেনি। ফলে, এই সামরিক সাফল্য ওসামা বিন লাদেন হত্যার সাথে তুলনা করা সম্ভব না, ডোনাল্ড ট্রাম্পও বারাক ওবামার মতো সুবিধা পাবেন না এ সাফল্যে।
ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির আগের জীবনে টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো’র উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন বিউটি কম্পিটিশন হোস্টিংয়েরও। এর ফলাফল দেখা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন নির্বাচনী কর্মসূচিতে, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনে হয় শো-ম্যান। কিন্তু এই ব্যক্তিত্ব মডেলের চাহিদা অনুযায়ী আদর্শ নয়, অনুসরণীয় নয়; ক্যারিশমাটিক নয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিত্বও। অ্যালান লিকম্যানের বর্ণনা অনুযায়ী, ডোনাল্ড ট্রাম্প সমাজের শ্রেষ্ঠত্ববাদী একটি অংশের মনের কথা হয়তো বলেন, কিন্তু তিনি তার পূর্বসূরীর মতো অনুসরণীয় চরিত্র হতে পারেননি।
বিপক্ষ দলের প্রার্থীর ক্যারিশম্যাটিক ব্যাক্তিত্ব
প্রাইমারিতে বার্নি স্যান্ডার্স, ব্লুমবার্গ, এলিজাবেথের মতো হেভিওয়েট ডেমোক্রেটিক প্রার্থীদের হারিয়ে আসা ডেমোক্রেটিক ক্যান্ডিডেট জো বাইডেন একটা দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন সিনেটর হিসেবে, দুই মেয়াদের পালন করেছেন ওবামা প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও। কিন্তু, ব্যক্তি জো বাইডেনও ক্যারিশমাটিক না, অসাধারণ বাগ্মী হিসেবেও তেমন নামডাক তিনি কুড়াতে পারেননি। ফলে, মডেলের এই জায়গাটি কাজ করবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে।
প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন কে?
অ্যালান লিকম্যানের মডেলের ১৩টি পয়েন্ট বিশ্লেষণের পরে দেখা যাচ্ছে, সাতটি চাবিই কাজ করছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে। অর্থাৎ, এ মডেল অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে বিজয়ী হবেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন। তবে লিকম্যানের শঙ্কা, রাশিয়ান হ্যাকারদের হস্তক্ষেপ তার পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণ করতে পারে, ভুল প্রমাণ করতে পারে অক্টোবর সারপ্রাইজও। তবে, সেরকম অপ্রত্যাশিত কিছু না হলে, হোয়াইট হাউজের চাবি উঠছে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেনের হাতেই।
[“ডোনাল্ড ট্রাম্প” বইটি পড়ুন এবং তার সম্পর্কে আরো জানুন।]