ইউরোপের দেশগুলোর সাথে মুক্তবাণিজ্য ও অভিন্ন বাজারসুবিধা পাওয়ার জন্য ১৯৭৩ সালে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিতে নাম লেখায় ব্রিটেন। পরবর্তীতে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি (ইইসি)’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার ফলে ব্রিটেনে ইইউ ভুক্ত অন্যান্য দেশ থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা অনেক বাড়তে থাকে, যে বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি অনেক ব্রিটিশ।
ব্রিটেনের অনেক নাগরিক মনে করেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকার কারণে তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সেই সাথে অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোর নাগরিকরা যুক্তরাজ্যে ভীড় জমানোয় তাদের কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ কারণে যুক্তরাজ্যের অনেক রাজনৈতিক দল অভিবাসীর সংখ্যা কমানোর জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ক্যামেরন সরকার ইউরোপের বাইরে থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা কমাতে সক্ষম হলেও ইইউ ভুক্ত দেশের অভিবাসী সংখ্যা কমাতে ব্যর্থ হন। কারণ ইইউ ভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকরা ইউরোপের ২৮টি দেশে অবাধে বিচরণ করতে পারেন।
যেহেতু ইইউতে থাকলে ইউরোপের অভিবাসী সংখ্যা কমানো সম্ভব নয় সে কারণে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ডেভিড ক্যামেরনকে ইইউ থেকে বের হয়ে আসতে বলেন এবং তারা ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। এমনকি ক্যামেরনের নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টিরও অনেক পার্লামেন্ট সদস্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার বিষয়ে মত দেন। প্রথমে ক্যামেরন সরকার ইইউ ভুক্ত অভিবাসীদের চার বছরের জন্য সুবিধা ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু এই বিষয়টি ছিল ইইউর নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে তিনি ইইউতে থাকা না থাকা নিয়ে গণভোট আয়োজন করতে বাধ্য হন। যেটি সংবাদমাধ্যমে ‘ব্রেক্সিট’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের জনগণ বিভক্ত হয়ে যায়। ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের ২৩ জুন গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এবং ২০১৫ সালের যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের চেয়েও এই ভোটে অধিক সংখ্যক ভোট পড়ে। গণভোটে ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট পড়ে ৫২% এবং থাকার পক্ষে পড়ে ৪৮% ভোট। ক্যামেরন ছিলেন ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে। ফলে গণভোটে হারের পরের দিনই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন থেরেসা মে।
তবে গণভোটের সাথে সাথে ব্রেক্সিট কার্যকর হয়ে যায়নি। ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্যের ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্রেক্সিট কার্যকর করতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে যুক্তরাজ্য। মূলত তারা কীভাবে ইইউ ছাড়বে সেই বিষয়ে এখনও একমত হতে পারেনি। থেরেসা মে চাচ্ছেন বিশেষ কোনো চুক্তির মাধ্যমে ইইউ থেকে বের হয়ে যেতে। কিন্তু চুক্তির বিষয়ে তার আনা প্রতিটি প্রস্তাবই ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে- ব্রেক্সিট ইস্যুতে কি তবে থেরেসা মেরও বিদায় ঘটবে? এখনো সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি দেখা না গেলেও বিষয়টি একেবারেই অসম্ভব নয়। থেরেসা মের পদত্যাগের গুঞ্জন ওঠার সাথে সাথে একটি বড় প্রশ্ন সবার সামনে এসেছে। আর সেটি হলো তার বিদায় ঘটলে কে হবেন পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী? চলুন তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
মাইকেল গোভ
থেরেসা মে পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে বেশ এগিয়ে রয়েছেন বর্তমান সরকারের পরিবেশ ও খাদ্য বিষয়ক মন্ত্রী মাইকেল গোভ। ২০১৬ সালে গণভোটের সময় যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ দলের এই নেতা ব্রেক্সিটের পক্ষে বেশ জোরালো প্রচার চালান এবং থেরাসা মে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তাকে পেছন থেকে শক্তি জুগিয়েছেন গোভ। ৫১ বছর বয়সী এই নেতা এর আগে বিচার বিষয়ক এবং শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। গোভের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণেই অনেকে তাকে এগিয়ে রাখছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য মেইল’ এর মতে, থেরেসা মে যদি পদত্যাগ করেন তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে মাইকেল গোভের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
গোভকে নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে থাকলেও তিনি এখনো নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখছেন না। তিনি মনে করেন, থেরেসা মে পদে থেকে ব্রেক্সিট সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। মের পদত্যাগের বিষয়ে গোভ বলেন,
আমি মনে করি এটা জাহাজের নাবিক পরিবর্তনের সময় নয়। আমি মনে করি আমাদের এখন সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী (থেরেসা মে) সেই বিষয়কে মাথায় রেখেছেন এবং গণভোটের মতামতকে সম্মান জানানোর জন্য তিনি চুক্তিতে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোই তুলে ধরেছেন।
একই সাথে তিনি থেরেসা মের অনুপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচন করতে খুব বেশি ইচ্ছুক নন বলে জানান। কারণ হিসেবে তিনি নিজের কিছু সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেন। ২০১৬ সালে ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগের পরও মাইকেল গোভের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে গুঞ্জন উঠে। তখনো তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য উপযুক্ত নন বলে জানান। তবে এবার শেষ পর্যন্ত থেরেসা মে যদি পদত্যাগ করেন তাহলে তিনি তার মতামত পরিবর্তন করবেন বলেই সবার ধারণা।
বরিস জনসন
৫৪ বছর বয়সী বরিস জনসন ব্রেক্সিটের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালান এবং গণভোটের ফলাফল যখন তাদের পক্ষে যায় তখন তিনি থেরেসা মের সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর আগে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লন্ডনের মেয়র হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময়ই তিনি স্পষ্টভাষী রাজনীতিবিদের তকমা পান। তবে কখনো কখনো তার দেওয়া অনেক বক্তব্য বিতর্কেরও দৃষ্টি করেছে।
২০১৬ সালে বেক্সিটের পক্ষ শিবিরের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন বরিস জনসন। আর সে কারণেই তার সাথে থেরেসা মের বেশ সখ্য তৈরি হয়। কিন্তু বেক্সিটের কঠোর এই সমর্থক ২০১৮ সালে মের ইইউ ত্যাগের বিষয়ে নতুন পরিকল্পনার সাথে একমত হতে পারেননি। ফলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। বর্তমানে জনসনই থেরেসা মের বড় সমালোচক। তিনি সরাসরি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন, এমনকি মের দেওয়া প্রস্তাবটি যদি হাউস অব কমন্সে পাশও হয়।
জেরেমি হান্ট
বরিস জনসন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিলে তার স্থলাভিষিক্ত হন জেরেমি হান্ট। ৫২ বছর বয়সী হান্ট এর আগে ছয় বছর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একসময় তিনি ডেভিড ক্যামেরনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এবং ২০১৬ সালের গণভোটে তিনি ইইউতে থাকার পক্ষ মত দেন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে তিনিও বর্তমানে ব্রেক্সিটের পক্ষে। এই বিষয়ে তিনি প্রকাশ্যেই নিজের বক্তব্য পেশ করেছেন।
হান্ট বর্তমানে ব্রেক্সিটের পক্ষে থাকলেও ইইউ’র সাথে আলোচনা বা চুক্তি করে বের হওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এবং যারা কোনো প্রকার আলাপ আলোচনা ব্যতিরেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়ার কথা বলছেন তাদের কঠোর সমালোচনাও করেছেন তিনি। তার মতে, এই বিষয়টি একই সাথে উদ্ধত্যপূর্ণ ও হতাশাজনক। তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চুক্তির প্রস্তাবের পক্ষেই মত দিয়েছেন।
সাজিদ জাভিদ
পাকিস্তানের বংশোদ্ভূত সাজিদ জাভিদ বর্তমানে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ৫২ বছর বয়সী এই নেতা রাজনীতিতে প্রবেশের আগে সফল ব্যাংকার ছিলেন। তার বাবা-মা পাকিস্তান থেকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান এবং সেখানেই তার জন্ম হয়। জেরেমি হান্টের মতো তিনিও একসময় ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তার মত পরিবর্তন করেন এবং ইইউ ত্যাগের পক্ষে সম্মতি দেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পরপরও বিশ্বজুড়ে তার খুব বেশি পরিচিতি ছিল না। মূলত কয়েক মাস আগে তিনি আলোচনায় আসেন। তিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিক এবং আইএস জঙ্গীর স্ত্রী শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব কেড়ে নেন। তার এই সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। যুক্তরাজ্যের অনেকে তার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও, বিশ্বনেতারা বিষয়টিকে অমানবিক বলেছেন।
ডেভিড ডেভিস
থেরেসা মের জায়গায় যে কয়েকজন ব্যক্তির আসার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে তার মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছেন ডেভিড ডেভিস। ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট বিষয়ে গণভোটের সময় তিনি ইইউ ছাড়ার পক্ষ শিবিরের প্রধান ছিলেন। ৭০ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ যুক্তরাজ্য সরকারের বড় কোনো মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেননি। তবে ২০১৬ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছায়া মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এই বর্ষীয়ান নেতা।
থেরেসা মে পরবর্তী যে কয়েকজন কনজারভেটিভ নেতার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে তার মধ্যে ডেভিড ডেভিস সবচেয়ে অভিজ্ঞ। চার থেকে পাঁচজনের নাম শোনা গেলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বরিস জনসন ও ডেভিসের মাঝে। তবে কনজারভেটিভ এমপিরা জনসনকে মেনে নেবেন কি না বা তাকে সমর্থন করবেন কি না সেটাই বড় প্রশ্ন। কারণ তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকলেও তিনি বেশ বিতর্কিত। এই কারণে তাকে প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে অনেকে দেখতে চাইবেন না বলেই ধরে নেওয়া যায়।