স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমূল বদল আসে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে দ্বিমেরুর বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়া। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে এসে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ১৩০টি। কিন্তু, পরবর্তী দশকগুলোতেও কি বিশ্বব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর থাকবে? নব্বইয়ের দশকের এমন প্রেক্ষাপটে স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন নতুন বিশ্বব্যবস্থার স্বরূপ তুলে ধরতে চেয়েছেন তার ‘The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order‘ বইয়ে।
হান্টিংটনের দর্শনে বিশ্বব্যবস্থা
হান্টিংটনের মতে, স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা হবে বহুমেরুর, বহুসভ্যতার। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো মূল ক্রীড়ানক হিসেবে ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু বিশ্বব্যবস্থা হবে সভ্যতাকেন্দ্রিক। সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্য থাকা সমাজগুলো একে অপরকে সহযোগিতা করবে, পাশ্চাত্যপন্থী বিশ্বব্যবস্থা মূলত বাধাগ্রস্ত হবে ইসলামিক ও চৈনিক সভ্যতার কাছে। এর মধ্যেই বৈশ্বিক শক্তিসাম্য ক্রমাগত পাশ্চাত্যের দিক থেকে ক্রমাগত ঝুঁকবে এশিয়ার দিকে, পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব কমবে, অর্থনৈতিক সক্ষমতার সাথে বাড়বে এশিয়ার সভ্যতাগুলোর প্রভাব।
মানবসভ্যতার একটি বড় সময় জুড়েই সভ্যতাগুলোর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ ছিল কম, সাংস্কৃতিক সংঘাতও হয়েছে কম। সভ্যতাগুলোর বিকাশও হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে একইসাথে অনেকগুলো সভ্যতার অস্তিত্ব রয়েছে বিশ্বব্যবস্থায়, বিশ্বব্যবস্থা হয়েছে বহুমেরুর।
সভ্যতার প্রকৃতি
সভ্যতা ও সংস্কৃতি- দুটোই আসলে জীবনধারণের পদ্ধতি নির্দেশ করে। জীবনধারণের পদ্ধতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে সামাজিক প্রথা ও নৈতিক মূল্যবোধ। এই প্রক্রিয়ার সাথে অন্তর্ভুক্ত থাকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দর্শন, অর্থনৈতিক কাঠামো, আর মানুষের চিন্তার ধরনও। সাংস্কৃতিক এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রবাহিত হয়, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে টিকে থাকে মূল্যবোধগুলো।
ব্রুডেলের মতে, সভ্যতা হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়, যেটি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আর ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। ওয়ালিস্টেইনের দর্শনে, সভ্যতা হচ্ছে একটি ওয়ার্ল্ড ভিউ, যা প্রথা, কাঠামো আর সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। সামগ্রিকভাবে, কালচারের সাথে ম্যাটেরিয়াল কালচার যুক্ত হয়, একইসাথে যুক্ত হয় হাই কালচারও। ডসনের দর্শনে সভ্যতা একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেটি সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে মানুষের জীবন ধারণের অভ্যাসকে কেন্দ্র করে।
সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাথে তাই যুক্ত থাকে ভাষার ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস আর রক্তদানের অতীতও। বড় বড় সভ্যতাগুলো আবার গড়ে উঠেছে ধর্মের উপর ভিত্তি করে, ধর্মীয় জীবনাচারই এসব সভ্যতায় বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একত্রে নিয়ে আসে। ফলে, একই জাতিভুক্ত মানুষ একে অপরের সাথে সংঘাতে যুক্ত হতে পারে, সংঘাতে যুক্ত হতে পারে একই ভাষাভাষীর মানুষ, কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন হওয়ার কারণে। সামগ্রিকভাবে, সভ্যতা নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আর সামাজিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সভ্যতার উত্থানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির শারীরিক আকার, মাথার আকৃতি, শরীরের রঙ, অর্থনৈতিক কাঠামো তুলনামূলকভাবে কম ভূমিকা রাখে।
সভ্যতার বিকাশ
আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো নির্দিষ্ট সীমানা নিয়ে তৈরি হলেও সভ্যতার সাধারণত কোনো পরিষ্কার সীমারেখা থাকে না। বরং, সভ্যতাগুলো অনেকগুলো জাতিরাষ্ট্র নিয়ে তৈরি হয়, তৈরি হয় অনেকগুলো জাতিরাষ্ট্রের ক্ষুদ্র বা বৃহৎ অংশ নিয়েও। সভ্যতার কোনো নির্দিষ্ট শুরু থাকে না, থাকে না নির্দিষ্ট সমাপ্তি। অনেকগুলো স্বতন্ত্র জীবনবোধ আর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সভ্যতা, আবার কালের প্রবাহে অনেক সময় হারিয়ে যায় সভ্যতা। প্রতিটি সভ্যতা অস্তিত্বের বিভিন্ন সময়ে উত্থান-পতন থাকে, পরিবর্তিত হয় সভ্যতার বিকাশ আর বিস্তৃতির গতিপ্রকৃতি। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে সভ্যতার আকারের পরিবর্তন হয়, কালের আবর্তে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সভ্যতার মাধ্যমেই মানুষ তার পরিচয়কে নতুন করে সন্ধান করছে, নিজেকে পরিচিত করছে নতুন পরিচয়ে। ফলে, বর্তমানে সভ্যতার মাধ্যমেই মানুষ সবচেয়ে বিস্তৃত সাংস্কৃতিক পরিচয় ধারণ করছে, সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য সামনে রেখে তৈরি করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সভ্যতাকেন্দ্রিক পরিচয়ের মাধ্যমেই একজন মানুষ বাকি সকল মানুষ থেকে নিজের পরিচয়কে আলাদা করছে, আলাদা করছে নিজের বিশ্বস্ত মানুষের পরিধি। ফলে, সভ্যতা হচ্ছে একটি সর্বাত্মবাদী পরিচয়, সবচেয়ে বিস্তৃত সাংস্কৃতিক পরিচয়, যেটি মানুষকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীভুক্ত করে।
হান্টিংটনের এই ধারণা অনেকটা পরিচয় চাপিয়ে দেওয়ার মতো। একজন ইরানি নাগরিক সুন্নি হতে পারেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হতে পারেন, নারী অধিকারের একজন সমর্থক হতে পারেন। অবস্থা আর প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে একেক সময় একেক পরিচয় ব্যক্তির কাছে প্রাধান্য পেতে পারে, ব্যক্তি নিজেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত করতে পছন্দ করতে পারেন। পরিচয়ের এই বৈচিত্র্য স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের দর্শন স্বীকার করে না, বরং, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নিরিখে একটি পরিচয় চাপিয়ে দেওয়ার ধারণায় বিশ্বাস করে। ফলে, একজন লিবিয়ান নাগরিক কেবলই ইসলামিক সভ্যতার অংশ, অন্য কোনো পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার সুযোগ তার কাছে নেই।
সভ্যতার উত্থান-পতন
রাজনৈতিক সক্ষমতা আর সংঘাতের উৎপাদনের ক্ষমতা ব্যবহার করে সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়, এই উপাদানগুলো ব্যবহার করেই সভ্যতার বিকাশ ঘটে। সময়ের সাথে সভ্যতার বিস্তৃত ঘটে, সভ্যতার মৌলিক মূল্যবোধগুলোতে রূপান্তর ঘটে, পরিবর্তন হয় সভ্যতার সীমা আর জনসংখ্যাও। আবার, সময়ের সাথে সাথে সভ্যতা নতুন নতুন উপাদান গ্রহণ করে, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে সভ্যতা নিজেকে পরিবর্তিত করে।
রাজাদের যুদ্ধনীতি আর রাজনৈতিক কৌশলকে সঙ্গে নিয়ে সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে, সময়ের সাথে ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যগুলোর পতন ঘটে। সরকার আসে, মেয়াদ শেষে আবার সরকারের বদল ঘটে। সভ্যতা এই উত্থান-পতনের মাঝে টিকে থাকে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতাগুলো সঙ্গে নিয়ে, রাজনৈতিক দর্শনে ভিন্নমত নিয়ে। সভ্যতা রাজনৈতিক আর সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ দিন টিকে থাকলেও, একসময় সভ্যতার মৃত্যু ঘটে, কালের আবর্তে হারিয়ে যায় সভ্যতা। ধর্মকেন্দ্রিক সভ্যতাগুলো তুলনামূলকভাবে দীর্ঘজীবী হয়।
লিবিয়াতে পরাক্রমশালী মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন ঘটেছে, মিশরে পতন ঘটেছে হোসনি মোবারক আর মুহাম্মদ মুরসির সরকারের। কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে অটোমান সাম্রাজ্য, ইতিহাসের পাতাতে বন্দি হয়ে গেছে মোগল সাম্রাজ্য। রাজনৈতিক এই উত্থান-পতনের মাঝেও টিকে থাকে ইসলামিক সভ্যতা, এখনও ঘটছে এই সভ্যতার বিস্তৃতি। একইভাবে বিকশিত হচ্ছে খ্রিস্টান সভ্যতা, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি করছে নতুন নতুন জাতিরাষ্ট্র।
সভ্যতা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না
সভ্যতাগুলো সাধারণত বিস্তৃত হয় অনেকগুলো জাতিরাষ্ট্রে, বিভিন্ন সংকটকালে এই জাতিরাষ্ট্রগুলো সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্যতা সামনে রেখে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু, সভ্যতা কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা কাঠামো না। সভ্যতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রশিক্ষিত বাহিনী তৈরি করে না, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সভ্যতা নিজের কাঁধে তুলে নেয় না। সভ্যতা কর সংগ্রহ করে না, বিভিন্ন চুক্তিতে সমঝোতার ভূমিকা নেয় না। বর্তমানে সভ্যতাকেন্দ্রিক কাঠামোগুলো একসাথে যুদ্ধও করে না।
তবে, একটি সভ্যতার মধ্যে সকল ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে, থাকে সকল ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান। একই সভ্যতার মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ থাকতে পারে, থাকতে পারে বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক মূল্যবোধের চর্চা। সভ্যতার মধ্যে থাকবে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দর্শন, থাকবে স্বার্থের বিরোধ। থাকবে সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্য, যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে সভ্যতা।
তবে, চীনের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। চীনের ক্ষেত্রে সভ্যতা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান একবিন্দুতে মিলে গেছে, চীনা সভ্যতা একটি রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাচ্ছে। অনেকগুলো জাতিরাষ্ট্র নিয়ে অন্য সভ্যতাগুলো তৈরি হলেও চীন কেবলই একটি রাষ্ট্র নিয়ে তৈরি। বিশাল এই রাষ্ট্রকে একসাথে টিকিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে চীনা জাতীয়তাবাদ, রাজনীতিবিদরা সামনে নিয়ে আসছেন চীনা মূল্যবোধগুলো, সেগুলো ছড়িয়ে দেবার পাশাপাশি জোর দিচ্ছেন চীনা মূল্যবোধগুলোর চর্চার উপর।