ভারতের রাজনৈতিক জীবনে এখন একটি বেশ নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী শিবিরের মধ্যেই দেখা গেছে বেশ গভীর একটি বিভেদ। সম্প্রতি শিবসেনা দলের প্রধান উদ্ধভ ঠাকরে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় দুই দিনের সফরে গিয়ে বেশ আলোড়ন ফেলে দেন। তিনি সরাসরি শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টিকে চ্যালেঞ্জ জানান রাম মন্দির বানানোর প্রসঙ্গে। শিবসেনার পাশাপাশি আরেক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদও শামিল হয় এই ইস্যুতে; ডাক দেওয়া হয় ধর্মসভার। অযোধ্যায় উদ্বভ বিজেপিকে বলেন কবে সেখানে রাম মন্দির নির্মাণ হবে তার সঠিক দিনক্ষণ জানাতে; এমনকি এ-ও বলেন যে, সরকারেরও আগে গুরত্ব মন্দিরের এবং বিজেপি নেতৃত্বকে সাবধান করে বলেন যে, মন্দির না তৈরি করতে পারলে তারা ক্ষমতায় থাকার খোয়াব দেখাও যেন ভুলে যান।
হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী দুটি দলের মধ্যে এমন বিভেদ বেশ বেনজির, যদিও বর্তমান প্রেক্ষিতে যে দুই দলের মধ্যে (যদিও তারা একই জোটের অংশ) সম্পর্ক বেশ খারাপ সে কথাও সত্যি। আর সেই দুঃসম্পর্কের মধ্যেই যে এই মন্দিরের রাজনীতি লুকিয়ে রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
জোটসঙ্গী হয়েও বৈরী: শিবসেনা বিজেপিকে কোণঠাসা করতে কেন মরিয়া
শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা-নেতা বাল ঠাকরের মৃত্যুর পরে তার ছেলে উদ্ধভ সেই একইরকমের ধারালো নেতৃত্ব দিতে পারেনি দলকে, এমন মত অনেকেরই। যেই বিজেপি একসময় শিবসেনার অঞ্চল মহারাষ্ট্রে তাদের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত হতো, আজ তারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে যা স্বাভাবিকভাবেই সেনার গর্বকে খর্ব করে। গত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে বিজেপির কাছে সম্মানের লড়াইতে হার মানতে হয়েছে সেনাকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পদ্মদলের রাষ্ট্রীয় অধ্যক্ষ অমিত শাহের যুগলবন্দীর কাছে উদ্ধভের দলকে অনেকটাই নিষ্প্রভ দেখিয়েছে, যদিও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভাবনা সেনাকে বিজেপির হাত ধরে চলতে বাধ্য করেছে রাজ্যের ক্ষমতার অলিন্দে। আর শাসকদলের বিরুদ্ধে তাই সেনার অনেকদিন থেকেই ক্ষোভ জমে ছিল, আর এবার তারা পাল্টা দেওয়ার সুযোগ পেল অযোধ্যাতে। দু’হাতে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়লেন না উদ্ধভ।
সেনা এই সুযোগটিকে কাজে লাগাতে এতটাই মরিয়া ছিল যে, নিজের রাজ্য মহারাষ্ট্র ছাড়িয়ে তারা উত্তরপ্রদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসে। এর মধ্যে “তুমি আমাকে আমার জায়গায় চোখ রাঙালে, আমিও তোমায় তোমার জায়গায় ছেড়ে কথা কইব না” ধরনের একটি বার্তা ছিল। যদিও উদ্ধভ বলেন যে, তার দলের এই কর্মসূচির মধ্যে কোনো রাজনীতি ছিল না, কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলছে। অযোধ্যায় হিন্দুবাদী ভাবাবেগকে চাগিয়ে তুলে বিজেপিকে কোণঠাসা করার মধ্যে ছিল এক সুচিন্তিত রাজনৈতিক কৌশল।
বহু দশক আগে বিজেপি যে রাজনীতি করেছিল, শিবসেনা আজ তা-ই করছে
সেনা সম্প্রতি অযোধ্যায় যা করল, তা আশির শেষ ও নব্বইয়ের শুরুর দিকে করেছিল বিজেপি স্বয়ং। কংগ্রেসকে ‘সংখ্যালঘু তোষণকারী’ দল হিসেবে আক্রমণ করে এবং সংখ্যাগুরুর ভোট নিজেদের দিকে টানতে বিজেপি সেই সময় এক প্রবল রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ময়দানে নেমেছিল। রথযাত্রার আয়োজন করেছিল নিজেদের রাজনৈতিক অভীষ্ঠকে সফল করতে। এই নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামাও কম হয়নি, কিন্তু অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বিজেপির গেরুয়া রাজনীতি চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা পায় এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে বিজেপি তার পূর্ণ সুযোগ নেয়।
বিজেপির পক্ষে এখন আর ১৯৯২ সালে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়
২০১৮ সালে সেনাও চালল সেই একই চাল। সমস্যা হচ্ছে, বিজেপির পক্ষে এখন আর ১৯৯২ সালে ফিরে গিয়ে পুরোনো সেই কট্টরবাদী গেরুয়া রাজনীতি খেলা সম্ভব নয়। তখন বারো বছর বয়সী দলটির আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার নেতৃত্ব অনেক ঝুঁকি নিলেও, আজ ক্ষমতাসীন বিজেপির পক্ষে সেই সমস্ত ঝুঁকি নেওয়া এককথায় অসম্ভব। বিজেপিকে ভারত শাসন করার হেতু নিজেকে যথেষ্ঠ ঘষেমেজে নিতে হয়েছে- সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের জায়গায় গুরুত্ব দিতে হয়েছে উন্নয়নবাদের উপরে কারণ দেশের উদারবাদী ও অহিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে কট্টরবাদী মুখোশ ছাড়তে হবেই; অটল বিহারি বাজপেয়ির সময়তেই বিজেপির এই উদারীকরণের প্রক্রিয়া দেখা গিয়েছে। এমনকি সংঘ পরিবারের অন্যান্য কট্টরবাদীরা অসন্তুষ্ট হলেও, বিজেপির এই কৌশলের কোনো অন্যথা ঘটেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে অতীতে সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ উঠলেও, তিনি তার উন্নয়নবাদী প্রশাসকের ভূমিকার উপরে জোর দিয়েছেন আগাগোড়া, যাতে কট্টরবাদের ভাবমূর্তি থেকে তিনি নিষ্কৃতি পান; তাকে দেশনায়ক হিসেবে মেনে নেয় বেশিরভাগ মানুষ। তাই রাম মন্দিরের কৃতিত্ব নেওয়ার জন্যে সেনার সঙ্গে সামনাসামনি কুস্তি তারা লড়তে যাবে না, তা পরিষ্কার। আর বিজেপির সেই দুর্বলতার কথা ভালোভাবে অনুধাবন করেই অযোধ্যার চালটি চেলেছেন সেনা নেতৃত্ব।
মোদীর উন্নয়নবাদের মতাদর্শকেই চ্যালেঞ্জ করে বসল বিজেপির জোটসঙ্গী শিবসেনা
“আগে মন্দির, পরে সরকার” স্লোগানটি দিয়ে সেনা যেমন একদিকে মোদীর উন্নয়নবাদী রাজনীতিকেই ধাক্কা দিতে চেয়েছেন, অপরদিকে বিজেপির যারা কট্টরবাদী সমর্থককূল, তাদেরকেও চটিয়ে দিতে চেয়েছে। রাম মন্দির নির্মাণ নিয়ে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে সেনা বিজেপিকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে যে যদি এক বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও তারা তাদের ‘সর্বপ্রধান’ লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারে, তাহলে আর কী উপায় তা হতে পারে? পাশাপাশি এটাও বোঝাতে চেয়েছে যে ইদানিং যে নামবদল বা মূর্তি তৈরির রাজনীতিতে বিজেপি মন দিয়েছে, তা রাম মন্দির নির্মাণের কোনো বিকল্প নয়। সেনার দাবি, রাম মন্দির না বানাতে পারলে বিজেপির ক্ষমতায় থাকার দিনও সীমিত (বিজেপি নেতৃত্বকে খোঁচা দেওয়া হয়েছে কুম্ভকর্ণ বলেও)।
আগামী সাধারণ নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে ভালো ফল করাও শিবসেনার অন্যতম লক্ষ্য
আসলে বিজেপির সঙ্গে মহারাষ্ট্রের হারের বদলা নেওয়ার পাশাপাশি শিবসেনার লক্ষ্য পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনও। মহারাষ্ট্র থেকে ৪৮ জন সাংসদ কেন্দ্রীয় আইনসভায় যান (উত্তরপ্রদেশের ৮০ জনের পরে যা বৃহত্তম) আর সেখানে তাই ভালো ফল করা শিবসেনার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ফল করতে পারলে যেমন একদিকে বিজেপিকে চাপে রাখা যাবে, অন্যদিকে অবস্থা বুঝে মোদী-বিরোধী ঐক্যের সুবিধাও নেওয়া যেতে পারে। আর তাই নির্বাচনের আগে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তপোক্ত করতে শিবসেনা সেই পুরনো হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিতেই মেতেছে। সঙ্গে আছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদও, যারাও মোদীর যুগে রাজনৈতিক আঙিনায় নিজেদের জায়গা তৈরি করতে মরিয়া।
উমা ভারতীর মন্তব্য আরও বিব্রত করবে বিজেপিকে
শিবসেনার অযোধ্যা কৌশল যে কিছুটা হলেও সফল তা প্রমাণিত হয় যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উমা ভারতী ঠাকরেকে সমর্থন করে মন্তব্য করেন যে, রাম মন্দির ইস্যুর উপরে বিজেপির একাধিপত্য নেই। মধ্যপ্রদেশের এই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যিনি নিজেও কিনা অযোধ্যার অতীত আন্দোলনের এক বড় মুখ ছিলেন, বলেছেন রাম মন্দির তৈরি করতে এগিয়ে আসা উচিত প্রত্যেক দল এবং নেতাকে। তার এহেন মন্তব্য যে বিজেপির নেতৃত্বকে যথেষ্ঠ বিব্রত করবে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রকাশ্যে কাউকে পাল্টা দেওয়ার মতো অবস্থাও গেরুয়া দলের নেই কারণ তাতে নিজেদের সমর্থনের ভিত্তিতেই চিড় ধরে যেতে পারে।
বিজেপিকে এখন শিগগিরই রাম মন্দির নিয়ে বাড়তে থাকা অসহিষ্ণুতাকে ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নয়নের স্লোগানে উদারবাদী ভোটারদের মন ভোলানো গেলেও তা দিয়ে যে কট্টর সমর্থকদের মন গলানো বিশেষ যাবে না, তা পদ্মবাহিনীর নেতারা কি বুঝছেন ইতিমধ্যেই?